পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কিম জং-উন ২০১১ তে ক্ষমতায় আসার পরে এর মধ্যেই উত্তর কোরিয়া চার-চারটে পারমাণবিক পরীক্ষা সেরে ফেলেছে। ওদিকে ২০১৫-র শেষে কিম সাড়ম্বরে ঘোষণা দিয়েছিলেন তারা হাইড্রোজেন বোমা বানিয়ে ফেলেছে। পশ্চিমা মিডিয়াতে এ নিয়ে অনুমানের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কিম কি হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষাটা এখনই করে ফেলবেন? আর তার সঙ্গে দেশটি নাকি জোগাড় করে ফেলেছে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক মিসাইল। তাকে দূরপাল্লায় ছোঁড়ার উপযুক্ত রকেটও নাকি তারে আয়ত্তে। আমেরিকার ঘুম চটকে যাবার পক্ষে এটাই তো যথেষ্ট। কিমের লক্ষ্যটা কি পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের মার্কিন যুদ্ধঘাঁটি গুয়াম, যাকে আগুনে আচ্ছাদিত করার হুমকি দিয়েছে তারা? নাকি আরও দূরের বিস্তীর্ণ মার্কিন ভূখন্ড?
উত্তর কোরিয়ার সমস্যাটা অনেকটা কোরিয়ার ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সে এক শতাব্দী পুরনো ঘাত-প্রতিঘাতে বিধ্বস্ত এক জাতির ইতিহাস। জাপানের সাম্রাজ্যবাদ কোরিয়াকে কলোনি করে রেখেছিল দীর্ঘদিন। তারপর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, কোরিয়ার বিভাজন, ১৯৫০ এর কোরিয়ার যুদ্ধ, আর উত্তর কোরিয়ায় দীর্ঘদিনের একনায়কের শাসন-এ সবই একটু একটু করে তৈরি করেছে আজকের উত্তর কোরিয়াকে। দক্ষিণ কোরিয়া আর জাপানে প্রবল মার্কিন সামরিক উপস্থিতিও বোধকরি সে ক্ষেত্রে খানিক অনুঘটকেরই কাজ করেছে। আর এ সব পিয়ংইয়ংকে বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে ক্রমশ রাজনৈতিক আর সামাজিকভাবে। বেড়েছ অর্থনৈতিক সমস্যাও। আর তার জবাবে পারমাণবিক শক্তি বাড়িয়েছে পিয়ংইয়ং। আজকের ডোনাল্ড ট্রাম্পই তাই প্রথম নন, সেই ১৯৯৪-তেই প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টন ইয়ংবিয়ন পারমাণবিক চুল্লিতে বোমা মারার কথা ভেবেছিলেন। তার পরিবর্তে ওয়াশিংটনের সঙ্গে এক চুক্তি হয় পিয়ংইয়ং এর। ৯/১১ র পরে প্রেসিডেন্ট বুশ কিন্তু ইরান, ইরাক, উত্তর কোরিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করেন তার ‘অ্যাক্সিস অব এভিল’-এর মধ্যে। সমীকরণ আবার যায় বদলে।
উত্তর কোরিয়ার উপরে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অবরোধের খাঁড়া নেমে আসে সেই ২০০৬ -এর পারমাণবিক পরীক্ষার পর থেকেই। তা ক্রমে কঠোর হতে থাকে প্রতিটি পারমাণবিক পরীক্ষা আর স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সঙ্গে সঙ্গে। ২০১৭-র সেপ্টেম্বরে তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে এক প্রবল অবরোধে। উদ্দেশ্যটা অবশ্যই অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে পিয়ংইয়ংকে পারমাণবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে পিছু হটানো। সে কৌশল কিন্তু ঠিক কাজে আসেনি কিম জনের এই ক্ষেত্রে। অন্তত এখনও পর্যন্ত। বরং তারা যেন অস্ত্রের ঝনঝনানিকে এর প্রতিরোধ হিসাবেই নিয়ে ফেলেছে। তাই উত্তর কোরিয়ার সমস্যা ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিবেশী দেশগুলোতে। এমনকি, মহাদেশ পেরিয়ে পশ্চিমা দুনিয়াতেও।
এই তো গত বছরের কথা। উত্তর কোরিয়াকে উপলক্ষ করে ঝগড়া হয়ে গেল বেইজিং আর সিওলের মধ্যে। কোরিয়ান উপদ্বীপে উত্তরের সামরিক আস্ফালনের প্রতিরোধ হিসাবে দক্ষিণ কোরিয়া বসিয়েছিল মার্কিন ‘থাড’ মিসাইল। এই অঞ্চলে শক্তির এই ভ্রকুটিতে হলুদ সমুদ্র কেঁপে উঠল। রেগে আগুন হল বেইজিং। এতটাই যে, সে দেশে দক্ষিণ কোরিয়া গান আর টিভির গ্রোগ্রামগুলো পর্যন্ত সব বন্ধ করে দিল। ব্ল্যাকআউট-এর গল্প ভিন্ন, মোদ্দা কথা এটাই যে, ২০১৬-তেই উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং-উন ঢেউ তুলেছেন হলুদ সমুদ্রে, যার এক ধারে চীন আর অন্য দিকে কোরিয়া উপদ্বীপ।
এ দিকে জাপান সমুদ্রের দু’ধারে উত্তর কোরিয়া আর জাপান মোটামুটি হাজার কিলোমিটারের দূরত্বে অবস্থিত। জাপানের উপর দিয়ে পিয়ংইয়ং-এর ছোড়া মিসাইল দুটোর উষ্ণ নিশ্বাসে তাই স্বাভাবিক কারণেই জাপানবাসী কেঁপে-টেপে অস্থির। এক অতি-চেনা নিরাপত্তাহীনতার প্রবল ভয়ে। ওই রকেট দুটোর মতো রাজনৈতিক প্রভাব পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো রকেটের বোধ করি ছিল না, কোনো দিন। রাজনৈতিকভাবে মুমূর্ষু শিনজো অ্যাবেকে কিন্তু রকেট দুটো জুগিয়ে গেল জীবনরেখা, যাকে বলে লাইফলাইন।
আজকের উত্তর কোরিয়া এক অরওয়েলিয়ান সমাজ-ব্যবস্থা। এক বদ্ধ এবং কেন্দ্রীভূত অর্থনীতি। মানবাধিকার নিয়ে অজস্র অভিযোগ। সম্প্রতি ২২ বছর বয়সি আমেরিকান ছাত্র অটো ওয়ার্মবায়ারের ঘটনাও দু’দেশের সম্পর্ককে তলানিতে নিয়ে গিয়েছে। একটি প্রচারমূলক পোস্টার চুরি করার চেষ্টার অভিযোগ তাকে উত্তর কোরিয়ার আটকে রাখা হয় ১৭ মাস। গত জুনে কোমায় আচ্ছন্ন অবস্থায় দেশে ফেরার পরে মৃত্যু হয় তার। ওদিকে পিয়ংইয়ং এর অস্ত্রের পরীক্ষা যতদিন উত্তর পূর্ব এশিয়ার আওতায় আটকে ছিল, এখন সে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইলের অধিকারী হওয়ায় তার ভয়ভীত পশ্চিমা দেশগুলো। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মাথাব্যথার কারণ আছে বৈকি! তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয় না-থাকলে কয়েক সপ্তাহব্যাপী ট্রাম্প-কিমের হুঙ্কার আর প্রতি-হুঙ্কার বেশ উপভোগ্য তরজা হিসাবে দেখতে পারত অনেকেই। ট্রাম্প হুমকি দিলেন ২৬ মিলিয়ন লোকের এই দেশটাকে পুরোপুরি ধ্বংস করার। ব্রিটেনও নাকি তৈরি হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্যে। কোরিয়া উপদ্বীপে আজ যেন প্রাক-পারমাণবিক যুদ্ধের আবহ। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয় পাচ্ছে এমনকি মার্কিনরাও। চীন নিঃসন্দেহে কোরিয়ার কাছাকাছি প্রবল মার্কিন উপস্থিতি খুব একটা পছন্দ করবে না। উত্তর কোরিয়ার খাদ্য আর শক্তির মূল জোগানদার চীন। সে দেশের বাণিজ্যের ৯০ শতাংমই চীনের সঙ্গে। তাই শি জিনপিং এর ভূমিকা সভ্যতার এই মহা-সংকটের প্রেক্ষিতে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলেই মনে করেন অনেকে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্যুইটারে বেশ সাবলীল। তবে কিচির-মিচিরের বদলে সেখানেও তাঁর গর্জন শোনা যায়। কিম-কে তিনি আত্মহত্যার অভিলাষী এক পাগল বলেই মনে করেন। অক্টোবরের ৮ তারিখ ঘোষণা করে দিলেন যে উত্তর কোরিয়াকে সামলাতে একটাই পথ খোলা। আসলে গত ২৫ বছর ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা এবং তাদের প্রশাসন উত্তর কোরিয়ার সাথে ক্লান্তিহীন আলোচনা চালিয়েছে, চুক্তি করেছে, বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়েছে। তাতে কাজ যে কিছুই হয়নি তা তো পরিস্কার। চুক্তির কালি শুকাবার আগেই চুক্তি ভাঙা হয়েছে, বোকা বনেছে মার্কিন আলোচনাকারীরা। ট্রাম্পের কন্ঠস্বরে হতাশা, কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা, আর মরিয়া ভাব যেন মিলেমিশে একাকার।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যের অন্য পিঠে কিন্তু মার্কিন কূটনীতির এক প্রবল ব্যর্থতারই ছবি। কিম জং-ইল বিদায়ী ক্লিন্টন প্রশাসনকে জানিয়েছিলেন যে,তাঁরা ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি শেষ করতে প্রস্তুত। ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট বুশ যখন হোয়াইট হাউসে ঢুকছেন, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি তখন স্তব্ধ। আর আজ উত্তর কোরিয়া হয়ে উঠেছে এক পূর্ণাঙ্গ পারমানিবক শক্তি। পারমাণবিক পরীক্ষা, এমনকি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র বা সন্ত্রাসবাদীদের পরমাণু সামগ্রী সরবরাহ করাও নাকি তাদের কর্ম-প্রকরণ। তাই উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক দীর্ঘমেয়াদি বিদেশ নীতির শোচনীয় বিপর্যয়। ক্লিন্টন যদি পিয়ংইয়ংকে গাজর দিয়ে থাকেন, বুশ দেবার চেষ্টা করেছেন লাঠির আঘাত। আর প্রেসিডেন্ট ওবামা পুরস্কার এবং শাস্তির এক মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। তিনি বোধ করি অপেক্ষা করেছিলেন অনভিজ্ঞ কিম কখন ভেঙে পড়বেন, কখন আত্মসমর্পণ করবেন আন্তর্জাতিক চাপের কাছে, তার জন্যে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে পরিস্থিতি অনেক জটিল হয়ে পড়েছে-দূরপাল্লার মিসাইলগুলো আর কিমের নতুন বাজির নেশা পৃথিবীর নজর ঘুরিয়ে দিয়েছে কোরিয়া উপদ্বীপের দিকে।
কিম জং উন অবশ্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের হুঙ্কারে দমাবার পাত্র নন একেবারে। আমেরিকাকে ‘শোচনীয় সমাপ্তির’- হুমকি দিয়েছেন কিম। তার মতে, তাঁর দেশের পারমাণবিক কর্মসুচী এক ‘বহুমূল্য তলোয়ার’, মার্কিন আগ্রাসনের হাত থেকে দেশের সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করার জন্য। তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মরিয়া কিম। ২০১৩-শেষেও কিম ঘোষণা করেছিলেন যে, উত্তর কোরিয়া ‘একযোগে অর্থনৈতিক নির্মান এবং পরমাণু শক্তিধর সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করতে এক নতুন কৌশলগত পথ গ্রহন করবে।’ প্রশ্ন উঠেছে, উত্তর কোরিয়ার কিমের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্পের আলোচনা ও হ্যান্ডশেক কি বিশ্বশান্তি নিশ্চিত করতে পারবে ?
লেখক: সাংবাদিক- কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।