Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আমাদের চিকিৎসাসেবা ও এক অগ্নিদগ্ধ শিশুর কথা

মেজর (অব.) রেজা উল করিম | প্রকাশের সময় : ৯ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবা নিয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগ অনেক পুরানো। কী সরকারি অথবা বেসরকারি সব জায়গাতেই বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় রোগী ও তার স্বজনদের। সরকারি হাসপাতালগুলোতে দালাল সিন্ডিকেটে জিম্মি হয়ে আছে চিকিৎসা প্রার্থীরা। ঘুষ না দিয়ে একজন সাধারণ মানুষ হয়ত চাঁদে ভ্রমণে যেতে পারে কিন্তু সরকারি হাসপাতালে বেড পাওয়া যাবে না। এছাড়া প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তির নির্দেশনা, ভুরি ভুরি পরীক্ষা, রোগীর সাথে খারাপ ব্যবহার নিত্য নৈমত্তিক। এমনকি এসবের প্রতিবাদ করতে গেলে ঠুনকো অজুহাতে ডাক্তারদের কর্মবিরতি, হাতাহাতি বর্তমান সময়ে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবাকে দুষ্প্রাপ্য করে তুলছে। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে বিল বাড়াতে মৃত রোগীকে লাইফ সাপোর্টে রাখা, হাসপাতালে ডাক্তার না থাকা, বিল আদায় করতে লাশ রেখে নির্মমতা নিত্যনৈমত্তিক আচরণ ভুক্তভোগীদের গা সহ্য হয়ে যাচ্ছে। প্রায়ই রোগীর স্বজনদের সঙ্গে ঝগড়া, মারামারি, ভাঙচুর, হাঙ্গামা লেগেই আছে। ভুরি ভুরি ভুয়া ডাক্তার চেম্বার খুলে বসেছে। এসকল অভিযোগ একটু কান পাতলেই চারদিকে শোনা যায় অথবা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পারা যায়। সাবেক সেনা কর্মকর্তা বা অন্য কোন সামাজিক পরিচিতির কারণেই হোক না কেন আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনো এমন অবস্থারমুখোমুখি হই না। কিন্তু এবার এমন একটা ঘটনার সাথে নিজে জড়িয়ে গেলাম যা চিকিৎসা সেবা সম্পর্কে এতদিনকার নেতিবাচক বর্ণনাকেও হার মানায়।
বর্তমানে সচরাচর স্যোসাল মিডিয়াগুলোতে বিভিন্ন ধরনের পোস্ট দেখতে পাই। কিছু পোস্ট দেখে এড়িয়ে যাই, কিছু পোস্ট দেখে হাসি বা কাঁদি, আবার কিছু পোস্ট চোখে পড়লে পীড়া দেয়, বিশেষ করে বিভিন্ন দুর্ঘটনার ছবি বা খবর দেখলে হতাশ হয়ে পড়ি। যাইহোক, কিছুদিন আগে ফেসবুকে ছয়-সাত বছর বয়সী একটা বাচ্চা মেয়ের ছবি দেখতে পাই, যার বডির প্রায় ৪৭% আগুনে পুড়ে গিয়েছিলো। ফেসবুকে অনেক সময় অনেক পোস্টই এড়িয়ে যাই বা খেয়াল করি না, কিন্তু এই পোস্টটি হঠাৎ নজরে পড়ে। ৪৭% পুড়ে যাওয়ার পরও তখন ও কোথাও স্থানান্তর করা হয়নি। পোস্টটি দেখার পর বিষয়টা আমার আবেগকে নাড়া দেয়। এরপর আমি বিষয়টা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি, যে ব্যক্তি পোস্ট দিয়েছিলেন তার থেকে। এবং আমি চিন্তা করতে থাকি কী করা যায়, কীভাবে সাহায্য করা যায়। এরপর জানতে পারি বাচ্চাটিকে কোন একজনের সহায়তায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী আমি পরদিন বিকাল ৪টায় ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে গেলাম। ইতিপূর্বে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিট দেখার কোন অভিজ্ঞতা ছিলো না, যাবার পর সত্যিকার অর্থে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা কল্পনাতেও ছিলো না যে আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় মেডিকেল সেক্টরের এতোটা শোচনীয় অবস্থা হতে পারে। আসলে এই বিষয়ে আমি কর্তৃপক্ষ বা ডাক্তার কাউকে দোষারোপ করছি না, আমাদের সিস্টেম বা আমাদের পদ্ধতি, আমাদের প্রসেস বিভিন্ন অবকাঠামো বা স্ট্রাকচারগুলোতে আসলে অনেক ত্রæটি আছে। হাসপাতালের মুমূর্ষু রোগী, যেসব রোগীদের থাকার কথা আইসিইউ বা পোস্ট অপারেটিভ ইউনিট-এ, তারা আশ্রয় নিয়েছেন বারান্দা, স্যাতস্যাতে জায়গায় কিংবা সিঁড়ির কাছে। এসব দৃশ্য দেখার পর সত্যিকারার্থে এতো খারাপ লেগেছে, আমরা এতো টাকা পয়সা এতো জায়গায় খরচ করি, অথচ এখানকার কী অবস্থা। একজন ভিআইপিরোগী বা একজন মন্ত্রী মিনিস্টার হলে আমরা তাকে ফুল নিয়ে দেখতে যাই। ভালো নামীদামী প্রাইভেট হাসপাতালে এসি রুমে তারা ভর্তি থাকেন, যেসব জায়গায় অপরিচ্ছন্নতার কিছু নেই। তেলা মাথায় তেল দেয়া আমাদের মনুষ্য জাতির বৈশিষ্ট্য, সেটা মেনেই তাদের সাথে দুই একটা সেলফি তুলে সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে নিজের জায়গাটুকু বোঝাই যে এদের সাথে ভালো সম্পর্ক রয়েছে আমার (যার ইনসাইড মিনিং শুধু এটাই)। প্রকৃত অর্থে এ দেখা শুধু তেলা মাথায় তেল দেই বা নিজের স্বার্থে দেখি। বাস্তবিক অর্থে আমাদের আবেগ থেকে কিংবা মানবিক গুণাবলী থেকে কখনো আমরা যে কাজ করার কথা তা করি না। যেমনটা আমাদের মানবিক অর্থে বাস্তবিক অর্থে যা করার কথা তা করি না। ঠিক যেমনটা হচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ বা অন্যান্য পাবলিক বা সরকারি হাসপাতালগুলোতে। যেখানে সাধারণত দেশের হতদরিদ্র ও গরিব মানুষ যেয়ে থাকেন, যারা আমাদের মতো একটু ভালো অবস্থানে আছেন তারাও যান না, ধনী ব্যক্তি বা ভিআইপিরাতো অনেক দূরের বিষয়। যারা মধ্যবিত্ত তারাও এখন এসব সরকারি হাসপাতাল এড়িয়ে চলেন। দেশটি দারিদ্র্য সীমার নিচের দেশ, আর সেই সিংহ ভাগ দরিদ্র এসব হাসপাতালে যাচ্ছে, যাদের প্রতি আমাদের সবচেয়ে বেশি খেয়াল রাখা উচিত।
বিষয় বস্তুতে ফিরে আসি, যে বাচ্চাটির কথা বলছিলাম, সে বাচ্চাটিকে গ্রিন ইউনিটে ভর্তি করে রাখা হয়েছিলো। যখন আমি গ্রিন ইউনিটে গেলাম, তখন শুনলাম তাকে কিছুক্ষণ আগে এইচডিওতে নেয়া হয়েছে। বিগত তিন দিন বাচ্চাটা সেই গ্রিন ইউনিটেই ছিলো যেখানে অনেক ভীড়, অনেক ভ্যাপসা গরম।
যেখানে একটা মানুষ পুড়ে যাবার পর তাকে ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হয়, কারণ পুড়ে যাবার কারণে তার যন্ত্রণা আরো বাড়তে থাকে। আমি ডাক্তার নই, যতটুকু অনুমানে বোঝা, তারপর হলো তার বিভিন্ন জায়গায় ব্যান্ডেজ লাগানো থাকে, ঐ ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় যদি তার শরীর থেকে ঘাম বের হয়ে আসে বা স্যাতস্যাতে ভাব থাকে, এটা কিন্তু মারাত্মক জ্বালাপোড়া তৈরি করে। সেরকম অবস্থায় একজন রোগী দিনের পর দিন বারান্দা, ওয়ার্ডের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকে। যাইহোক এইচডিইউতে গেলাম । যাবার পর দেখলাম কোন ডাক্তার নেই। পরে দূরে দেখলাম একজন সিস্টার বা স্টাফ রয়েছেন। তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম, বাচ্চাটিকে দেখতে যাবার কারণ ছিলো বাচ্চাটির অভিভাবক স্বচ্ছল না, তাছাড়া দেখার মতো লোক কম ছিলো। দুই একজন স্বেচ্ছাসেবী অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন।
আমি যাবার সময় আমার সাথে ছাত্রলীগের কিছু নেতা ছিলেন, আর কিছু ভাই ব্রাদার। ধন্যবাদ দিবো আরিফুর রহমান লিমন, বাদল, ইকরাম, মাসুদ আরো কয়েকজনকে। যাদের ভূমিকার কথা নাবললেই নয়। ভালো মন্দ নিয়েই জীবন। ডাকার পর তারা যেভাবে রেসপন্স করেছে তা সত্যি প্রশংসনীয়। লিমন সেই সময়ই বার্নইউনিটের ইনচার্জ ডাক্তারের সাথে কথা বলিয়ে দিলেন। ডাক্তার ইমু খুবই অমায়িকভাবে রেসপন্স করে বাচ্চাটির বিষয় দেখবেন বলে জানালেন। কিন্তু সমস্যা হলো শুক্রবার দিন কোন ডাক্তার পেলাম না, এটা ডাক্তারদের দোষ না, এটা হাসপাতালের সিস্টেমের দোষ। একটা বিষয় হলো, যে লোকটা ডাক্তার তারও একটা ক্যাপাসিটির বিষয় আছে। তারপক্ষে তো ২৪ ঘণ্টা বা ৭ দিন সময় দেয়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের বার্ন ইউনিটের মতো এমন সেন্সিটিভ জায়গাগুলোতে, আমাদের পর্যাপ্ত ডাক্তার প্রয়োজন।
অন্ততপক্ষে কোন স্পেশালিস্ট না থাকলেও একজন ডাক্তার যার বেসিক ধারণা আছে, এমন এমবিবিএস ডাক্তার তাদের থাকা দরকার। আমি যতটুকু জানি আমাদের ঢাকা সিএমএইচে ডিফেন্সের সকলের জন্য সবসময় একজন ডিউটি অফিসার থাকেন। এবং ডিউটি অফিসার একজন ডাক্তার হয়ে থাকেন, তিনি হতে পারেন স্পেশালিস্ট কিংবা জেনারেল ডাক্তার।
এটলিস্ট তিনি প্রাথমিকভাবে রেসপন্স করতে পারেন। ঠিক তেমনি সরকারি হাসপাতালগুলোতে এমন থাকা উচিত। একজন ডিউটিরত ডা. সার্বক্ষণিক থাকা উচিত, যাতে ইমার্জেন্সি ক্ষেত্রে তিনি কিছুটা হলেও রেসপন্স করতে পারেন। কারণ, একজন ডাক্তার না থাকলে ইমার্জেন্সিতে কী হয় ওখানে যারা থাকেন তারা বুঝতেও পারবেন না, কার কাছে সাহায্য চাওয়া উচিত। আর প্রত্যেকের উচিত এই ইউনিটগুলো একবার করে দেখা। বড় বিষয়, আমাদের দেশে এখন আপাতত আগুনে দগ্ধ কোন দুর্ঘটনা নেই, তারপরেও বার্ন ইউনিট ভর্তি মানুষ। যদি কোন এক্সিডেন্টাল ইমার্জেন্সি ক্রাইসিস দেখা দেয় বা বড় কোন অগ্নিকান্ড ঘটে। মুহুর্তে ৪/৫শ’ লোক আহত হয়, আগুনে পুড়ে যায় তখন কোথায় নিবো এদের? তখন হয়তো মিডিয়ার চোখ এড়ানোর জন্য আইসিউ রোগীদের সরিয়ে, তাদের ভর্তি করিয়ে দেবে। আমরা হুজুগে বাঙালি, যখন যেটা দরকার বা খুব বেশি আলোচিত হয়, তখন ঐ বিষয়টা আমরা বেশি উপস্থাপন করি। ইতোমধ্যে খবর পেলাম, সেই বাচ্চাটা আর নেই। আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন।
লেখক: নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চিকিৎসাসেবা


আরও
আরও পড়ুন