পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মানুষের জীবনের চালিকাশক্তি হার্ট। আর অর্থনীতির হার্ট ব্যাংক। দেশের সেই অথনীতির হার্ট এখন অস্স্থু। ব্যাংকগুলো এখন দেউলিয়া হতে চলেছে! ফলে মানুষের মধ্যে আতংক সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলো পুঁজি সংকটে পড়েছে। এতে করে বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন মতে, ‘অন্তত ৯টি ব্যাংক তাদের মূলধনও খেয়ে ফেলেছে। ব্যাংকগুলো হচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, বেসিক, রূপালী, কৃষি, রাকাব ও আইসিবি ইসলামিক। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি আরও তিনটি ব্যাংক রয়েছে। ব্যাংকগুলোর মোট মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ১৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। অন্য সূত্রে প্রকাশ, ব্যাংকগুলো মূলধন সংকট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমানত পেতে পীড়াপিড়ি করছে মানুষের কাছে। সে সুযোগে সুদহার বেড়েছে। যা ১৪-১৫% পর্যন্ত পৌঁছেছে। অথচ এর আগে ছিল সিঙ্গেল ডিজিটের মধ্যে। উপরন্তু সরকারি ব্যাংকগুলো বিশ হাজার কোটি টাকা সহায়তা চেয়েছে সরকারের কাছে। আর বেসরকারি ব্যাংক সরকারি আমানতের ৫০% আমানত হিসেবে চেয়েছে সরকারের কাছে। এই অবস্থায় কোন কোন ব্যাংক এলসি খুলতে পারছে না। ব্যাংকের এই নাজুক পরিস্থিতির জন্য ও ব্যাংকিং খাতে মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ঘনঘন পরিবর্তনের কারণে বিদেশি অনেক ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ব্যবসা করতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। এমনকি ব্যবসায়ী ও শিল্পগোষ্ঠীর খোলা ঋণপত্র বাতিল করে দিচ্ছে। এলসি’র অর্থ পরিশোধ করার জন্য অন্য কোনো ব্যাংক প্রতিশ্রুতি দিলেও তা গ্রহণ করছে না। ফলে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। ব্যাংকিং খাতের আর একটি দুঃখজনক খবর হচ্ছে, ব্যাংকসমূহের নেতিবাচক সংবাদ যাতে মিডিয়ায় প্রকাশ হতে না পারে সে লক্ষ্যে বিধান করার জন্য মালিকদের সংগঠন বিএবি পত্র দিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে! সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। টিআইবি বলেছে, তাদের এই প্রস্তাব অগ্রহণযোগ্য।
দেশের ব্যাংকগুলোর বর্তমান করুণ পরিণতির কারণ নানাবিধ। অন্যতম কারণ হচ্ছে, ঋণখেলাপী। বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ, বর্তমানে খেলাপী ঋণ ও ঋণ অবলোপনের পরিমাণ এক লাখ ২৯ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ৫৫ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। যা অর্থঋণ আদালতের মামলায় আটকে আছে। সেখানে বর্তমানে মোট মামলার সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। জানা মতে, অনেক ঋণখেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উচ্চ আদালত থেকে মামলার ওপর স্থগিতাদেশ নিয়েছে। আবার অর্থঋণ আদালতের রায়ে বন্ধকি সম্পত্তি ব্যাংক নিলামে তুললে তার ওপরও স্থগিতাদেশ পাওয়া গেছে উচ্চ আদালত থেকে। যেমন সোনালী ব্যাংক হলমার্কের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিলাম বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর বাকিগুলোর নিলাম উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত হয়ে গেছে। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তোলা হলেও তাতে কেউ অংশগ্রহণ করে না। অন্যদিকে, কোন কোন প্রতিষ্ঠানের জামানতের কাগজপত্র ফলস হওয়ায় মামলা আদালাতে টেকে না। স্মরণীয় যে, দেশের ঋণখেলাপীর হার উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে, এমনকি এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ বলে এক দৈনিকে প্রকাশ। উক্ত খবর মতে, ‘খলাপি ঋণের হার: চীন-১.৭০%, ফিলিপাইন-১.৯০%, ভিয়েতনাম-২.৫০%, থাইল্যান্ড-২.৯০%, ইন্দোনেশিয়া-২.৯০%., শ্রীলংকা-২.৬০%, মালয়েশিয়া-১.৬০%, পাকিস্তান-৯.২০%, ভারত-৯.৩০%, বাংলাদেশ-৯.৩১%।’
আরো জানা গেছে, এই ঋণ খেলাপীর বেশিরভাগই হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ‘ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০০৯ সালে ছিল ২২,৪৮২ কোটি টাকা। আর তা বাড়তে বাড়তে ২০১৭ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে ৭৪,৩০৩ কোটি টাকায়। এছাড়া রয়েছে ঋণ অবলোপন, যার পরিমাণ প্রায় এর অর্ধেকেরও বেশি’। ব্যাংকের এই ঋণ খেলাপীকে নানাজন নানাভাবে অভিহিত করছেন। ব্যাপক জালিয়াতি, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক চাপে ঋণ প্রদানের কারণেই খেলাপী ঋণের পরিমাণ পাহাড়সম হয়েছে বলে অর্থনীতিবিদদের অভিমত। খোদ বর্তমান অর্থমন্ত্রী মুহিত সংসদে বলেছেন, ব্যাংকে এখন পুকুর চুরি নয় সাগর চুরি হচ্ছে। অপরদিকে, আইএমএফর একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসে সবকিছু দেখেশুনে জানিয়েছে, ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের ঘাটতির কারণে এটি হচ্ছে। এজন্য ব্যাংক খাতের তদারকি জোরদার করতে হবে। সংস্থাটি আরো বলেছে, দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংক বিশেষত রাষ্ট্রীয় মালিকানার কয়েকটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ও উচ্চ খেলাপি ঋণ রয়েছে। শুধু রাষ্ট্রীয় ব্যাংক নয়, পুরো ব্যাংক খাতে এখন নানা অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা উদ্ঘাটিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেছেন, ‘২০১৭ সাল ছিল দেশের ব্যাংকিং খাতের কেলেঙ্কারির বছর। ২০১৮ সালে অভ্যন্তরীণভাবে আমরা তার প্রভাব দেখতে পাচ্ছি। এর প্রভাব আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পড়তেই পারে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ দরকার। তা না হলে সামনে আরো সঙ্কট আসবে।’ সমপ্রতি বাংলাদেশে ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, ‘ব্যাংকগুলো সঠিক তথ্য দিচ্ছে না’। অপরদিকে, বিশ্লেষকদের ভাষ্য, বাস্তবে ব্যাংক সুরক্ষার শক্ত ব্যবস্থা দেশে নেই, না আইনে, না ব্যবস্থাপনা-পরিচালনায়। উল্টো পাকাপোক্তভাবে আছে ব্যাংক থেকে জনগণের আমানতের টাকা লুটপাট করে ব্যাংক ফাঁকা করে দেওয়ার ‘সুব্যবস্থা’।
দেশের ব্যাংকগুলোর ঋণ খেলাপীর পরিমাণ জাতীয় বাজেটের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। তাই বিষয়টি খুবই আশংকাজনক। সে কারণেই বিষয়টি সামপ্রতিক সময়ে দেশের সবমহলেই ব্যাপক আলোচিত ও সমালোচিত হচ্ছে। তৎপ্রেক্ষিতে কিছু কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেমন: ব্যাংকরে ঋণ জালিয়াতির বিরুদ্ধে দুদক কর্তৃক অনেক মামলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তি গ্রেফতারও হয়েছে। সমপ্রতি ‘ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিপালন’ শীর্ষক বিআইবিএম এর কর্মশালায় উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কঠোর শাস্তি না হওয়ায় ব্যাংকে অনিয়ম বন্ধ হচ্ছে না। এ ছাড়া পরিচালনা পর্ষদ ও ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে অনেক অনিয়ম চাপাও পড়ে যায়। উক্ত কর্মশালায় বক্তারা আরো বলেন, ব্যাংক খাত অন্যান্য খাতের মতো নয়। এখানে সংকট সৃষ্টি হলে গোটা অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। ব্যাংক খাতের বড় ধরনের অনিয়ম এবং নিয়ম লঙ্ঘনের ঘটনা প্রাথমিক পর্যায়ে চিহ্নিত করতে না পারলে সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। এ জন্য ব্যাংক খাতের সব অনিয়ম বন্ধ করতে সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থ বিভাগের একটি সূত্র মতে, অর্থঋণ আদালতের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আলাদা বেঞ্চ গঠনের অনুরোধ করে বেশ কিছু দিন আগে আইনমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। চিঠিতে তিনি অর্থঋণ সংক্রান্ত রিটের কারণে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেই চিত্রও তুলে ধরেছেন। এছাড়া, অর্থঋণ আদালত আইন সংশোধনের সুপারিশ করেছে আইন কমিশন। সর্বপরি বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে, ঋণের টাকা উদ্ধার করতে এখন দরকার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা। ঋণ কেলেংকারিগেুলোর বিহিত করা না গেলে ভবিষ্যতেও দুর্নীতির ধারা অব্যাহত থাকবে। ব্যাংকিং খাত, তথা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির স্বার্থে ব্যাংকের পরিচালনা পদ্ধতিতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে হবে যেকোন মূল্যেই। পিকেএসএফ’র চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেছেন, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্নিষ্টদের একটি অংশের নৈতিকতার বড় স্খলন ঘটেছে। এ কারণে হলমার্ক এবং বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা ঘটছে। ব্যাংক খাতকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কোনো অনিয়ম প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। সব অনিয়মের বিচার হতে হবে। এ জন্য সরকারের সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথভাবে কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে।
যা’হোক, ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে হবে এবং তা যেকোন মূল্যেই হোক। তাই প্রতিটি ব্যাংকেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে একটি টাকাও খেলাপী না হয়। তবে ব্যাংকগুলোকে পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া ছাড়া তা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত ব্যাংকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পরও যদি কোন ব্যাংক খেলাপী হয়, তাহলে সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিকট থেকে তা আদায় করে তাদেরকে বিদায় করে দেয়া দরকার। এছাড়া, দাখিলকৃত ব্যাংক কমিশনের রিপোর্ট অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। অপরদিকে, এ পর্যন্ত যে পরিমাণ ঋণ খেলাপী হয়েছে, তা আদায়ের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সমুদয় অর্থ আদায়ের ব্যবস্থা করা জরুরি। এবং সে ট্রাইব্যুনালে অর্থ পাচারের বিষয়টিও সংশ্লিষ্ট করা দরকার। উপরন্তু যতদিন ঋণ খেলাপীর সমুদয় টাকা আদায় না হয়, ততদিন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে চীনের মতো শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার দাবি বিবেচনায় নেয়াও দরকার। সর্বশেষ অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘আগামী এক মাসের মধ্যে ব্যাংক ঋণের সুদ হার ১০ শতাংশের মধ্যে আসবে। কারণ, ব্যাংক ঋণের সুদ হার বেশি হলে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। উপরন্তু তিনি আরো বলেছেন, সরকারি আমানতের ৫০% বেসরকারি ব্যাংককে দেয়া হবে। অবশ্য তার শেষের বক্তব্যের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের অভিমত হচ্ছে, ব্যাংকগুলোকে বারবার স্যালাইন দিয়ে বাঁচানো যাবে না। সুষ্ঠুভাবে ব্যবসা করেই তাদের টিকে থাকতে হবে। আর যে থাকতে পারবে না সে বিদায় হয়ে যাবে। সোজা কথায় ব্যাংকগুলোকে বাঁচতে হলে নিয়ম নীতি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করেই বাঁচতে হবে। এটাই ব্যাংক খাতের রক্ষাকবচ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।