শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
অপ্রাপ্তি,দুঃখ,কষ্ট ও ব্যর্থতা যখন জীবনকে ঘিরে এক অমোঘ পরিণতির দিকে নিয়ে যায় তখন শুনতে হয়,মৃত্যু মানুষকে এনে দেয় হাসি ও আনন্দ- তেমনটিই মনে করতেন পাশ্চাত্যের জীবন-নাটকের নাট্যকার ইউজীন ও’ নীল।আবার মৃত্যুর পরিণতি কী হবে সে ভাবনা কোনো সৃষ্টিশীল মানুষকে হয়তো বিচলিত করে না;তার সৃষ্টির গৌরব বহনের সেই অমোঘ ভাবনার পরিণতির জন্য।এ প্রসঙ্গে গ্রীস দেশের প্রাচীন কবি হোমার এবং ভারতবর্ষের কবি বাল্মীকির কথা যদি বলি,তাহলে তাঁরা তাদের সেই সৃষ্টির জন্য দৈবী মহিমার মর্যাদায় বেঁচে আছেন(কারও কারও মতে,কবি মাত্রেয় ত্রিনয়ন বিশিষ্টতার জন্য নবীর মর্য়াদা পেয়ে থাকেন)।আবার প্রেম ও সমাজবোধ যখন কবির জীবনের ক্ষয়িঞ্চু ছালবাকলের হাত ধরে একটু একটু বাকপ্রতিমায় দীর্ঘ হতে থাকে,তখন কবি তার মনভোমরা যেন একটি মৃত্যুমোড়কের মৌনঘ্রাণে নিজের মতো করে বাঁচিয়ে তোলেন।আর তাই তার আত্মতাচ্ছিল্যের যৌক্তিক ভাবনা ও লক্ষ হয়ে ওঠে জীবনমুখী। উল্লেখিত কথাগুলো বলছিলাম কবি আবিদ আজাদ প্রসঙ্গে। কবি আবিদ আজাদ ছিলেন সত্তর দশকের একজন পারিজাত যৌবনের কবি। পারিজাত যৌবনের কবি একারণে বলছি যে,সত্তর দশক ছিলো রাজনীতির উত্তাল সমারোহের উত্তঙ্গ বোহিমিয়ানে পূর্ণ।আর কবি আবিদ আজাদ সেখানে কবিতাকে পরোক্ষ ও মৌন রাজনীতির এক বিস্ময়কর ঝংকারে ‘রাজনীতি’র কবিতা থেকে বাঁচিয়ে দূরে রাখতে পেরেছিলেন। আমরা জানি, এ-দশকে বাংলা কবিতা রাজনৈতিক আদর্শবাদে ঝংকৃত ও উদ্ধত রূপ নিয়েছিলো।কবিতার ঝংকারে ছিলো জীবনের কথা মানুষের সমাজের কথা।সংহার ও দ্রোহের নাচে কবিতা ছিলো উদ্বত ও উন্মূলিত। এবং বাঁধনহারা।কিন্তু আবিদ আজাদের কবিতা এসময় প্রেম,মানুষ ও সমাজবোধের মৌন পাংশুলে হয়ে পড়ে এক ধরনের সার্বজনিন ও নান্দনিক এ্যাবস্ট্রাকশন।কারণ হিসেবে বলা যায়,আবিদ আজাদের ছিলো এমন একটি কালোত্তরণের চোখ যা তাকে সত্তর দশকের অন্যসব কবিদের থেকে আলাদা করে সহজে চেনা যায়।এ-দশকের মাঝামাঝি অর্থাৎ ১৯৭৬ সালে কবি আবিদ আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঘাসের ঘটনা’র প্রকাশ তেমনটিই বলে।এগ্রন্থটি ছিলো বাংলার কাব্যআকাশে আবিদ আজাদকে কবি হিসেবে পরিচিত করার ও জানান দেওয়ার একটি নতুনতর মাইলফলক।তাঁর কবিতা পাঠে পাঠক বুঝতে পারে,কবিতা-কবিতাই।দুঃখ-যাতনা,নিঃসঙ্গতারও যে সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে,সেটি তাঁর কবিতায় বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার স্বরবৃত্তে জানান দিতে থাকে।তবে আবিদ আজাদের ‘ঘাসের ঘটনা’- প্রকাশের পর তিনি কবি ও কবিতার পাঠকের কাছে ব্যাপকভাবে আলোচিত ও আলোড়িত হন।কবি শহীদ কাদরি ‘ঘাসের ঘটনা’র মূল্যায়নে অসম্ভব উচ্ছাস প্রকাশ করে বলেন,‘সত্যিকথা বলতে গেলে ‘ঘাসের ঘটনা’-র ‘জন্মস্মর’ কবিতাটি আমার দৃষ্টির গোচরে আসে।ঐ কবিতার কিছু কিছু পঙ্ক্তি প্রায় আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমার স্মৃতির ভেতর ঠাঁই করে নেয়।এবং তখনই আমি টের পাই আমাদের সাহিত্যের সংসারে শিল্পসমৃদ্ধ কবিতার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।’ কবি আবিদ আজাদ কবিতায় যে প্রেম,জীবন ও সমাজবোধকে আত্মনির্জনতা ও আত্মনিমগ্নতা দিয়ে এক জাদুবাস্তবতায় পাঠককে টেনে নিয়ে যেতে পারেন চিত্র ও চিত্রকল্পের আনাচে-কানাচে,তা’ তাঁর ‘ঘাসের ঘটনা’র কবিতাগুলো পড়লেই সহজে অনুমেয়।আর একথা পুনঃরায় উল্লেখ করতেই হয় যে,সত্তর দশকের কবি যেখানে সামাজিক বৈষম্য,অস্থিরতা,মানষিক যন্ত্রণা,আত্মগত উপলব্ধি,আর্তি ও অস্তিত্বচেতনা নিয়ে মৌলিক মিছিলের বন্ধনায় উন্মূল তখন কবি আবিদ আজাদ তাঁর কবিতায় এক অদ্ভুত ‘স্বপ্নের ভেতর’ জন্ম দিয়েছিলেন ঘাসে-ঘাসে নিঃশব্দের ‘রূপালি আগুন’।তাঁর চোখের সামনে খেলছে একদিকে যেমন রাজনীতির প্রচন্ড স্বপ্নময় জালের রৌদ্রোজ্জল ঝলকানি তেমনি দৌড়ে যাবার এক অপরাভুত প্রেম ও গ্লানি।আর রঙের টুকরো ছিলো তাঁর বেঁচে থাকার একমাত্র হাতছানি।তাই তো গ্রামের শিশির ভেজা পথের বিচ্ছেদে তিনি যেমন কমন ও মৌন তেমনি নখ-বেধাঁ রক্তক্ষরণে কুহকী প্রেমে কাছে টেনে নিয়েছেন এক ‘নীল টুকরোর স্বপ্ন’।তাঁর জানা ছিলো,‘আমার আত্মায় গোসল করেছে বেগানা-বেশর্মা দুই পুরুষ’।সত্যিই জাতকবির জন্য জীবনের অর্থ হলো, বেঁচে থাকা যতটা জরুরি তার চেয়ে জরুরি হলো,বেঁচে থাকার জন্য জীবনের মুখোমুখি হওয়া যুদ্ধ একটি শেষ অস্ত্র।তাই কবিরা তার ত্রিনয়নের জোরে শিখে ফেলে, গ্লানি বহন করার জন্যই তার জন্ম।জীবনের অর্থে কবি মাপজোখ,ওজন,সংখ্যা-গণিতের ধার-ধারে না।মনের বোহিমিয়ানে তার মুক্তি।কবি আবিদ আজাদ তাদেরই একজন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।