চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
\ তিন \
পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি মানুষদের এই মর্মে নির্দেশ দিয়েছি যে, তারা যেন পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করে। তার মা কষ্ট করে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্ট করেই তাকে প্রসব করেছে। তাকে গর্ভে ধারণ ও দুধপান করাতে ত্রিশ মাস লেগেছে। এমন কি যখন সে পূর্ণ যৌবনে পৌঁছেছে এবং তারপর চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হয়েছে তখন বলেছে: “হে আমার রব, তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে যেসব নিয়ামত দান করেছো আমাকে তার শুকরিয়া আদায় করার তাওফীক দাও। আর এমন সৎ কাজ করার তাওফীক দাও যা তুমি পছন্দ করো। আমার জন্য আমার সন্তানদেরকে সৎ বানিয়ে আমি তোমার কাছে তাওবা করছি। আমি নির্দেশের অনুগত (মুসলিম) বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত। “আল-কুরআন, ৪৬;১৫”। আলোচ্য আয়াতে ওসিয়ত শব্দের অর্থ তাকীদপূর্ণ নির্দেশ এবং ইহসান অর্থ সদ্ব্যবহার। এর মধ্যে সেবা-যতœ, আনুগত্য, সম্মান ও সস্ত্রম প্রদর্শনও অন্তর্ভুক্ত। ‘কুরহুন’ শব্দের অর্থ সে কষ্ট যা মানুষ কোন কারণবশত সহ্য করে থাকে অথবা যে কষ্ট সহ্য করতে অন্য কেউ বাধ্য করে। এ বাক্যটি প্রথম বাক্যেরই তাকীদ। “মুফতী মুহাম্মদ শাফী রহ. তাফসীরে মা‘আরেফুল কুরআন, অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (মদীনা মুনাওওয়ারাহ: বাদশাহ ফাহাদ মুদ্রণ প্রকল্প, ১৪১৩ হি.), পৃ. ১২৪৯”। অর্থাৎ পিতা-মাতার সেবা-যতœ ও আনুগত্য জরুরী হবার কারণ এই যে, তারা তোমাদের জন্য অনেক কষ্টই সহ্য করেছেন। এই আয়াতে আরেকটি বিষয়ের প্রতি ইংগিত রয়েছে, তা হলো মাতার হক পিতার অপেক্ষা বেশি, যা আমরা হাদীস থেকে প্রমাণ পাই। আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ স. এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আমার উত্তম সাহচর্যের অধিকতর হকদার কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে বলল, এরপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে পুনরায় বলল, এরপর কে? তিনি বললেন, এরপরেও তোমার মা। সে বলল, অত:পর কে? তিনি বললেন, অত:পর তোমার পিতা। “ইমাম বুখারী, আল জামি‘ আস সহীহ, কিতাবুল আদব, বাবু মান আহাক্কান নাসি বিহুসনিস সুহবাহ, হাদীস নং ৫৬২৬”। পিতা-মাতার সেবা করা এবং তাদের অনুগত হওয়ার সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, যার মাধ্যমে জান্নাতের পথ সুগম হয়। অন্যদিকে তাদের অধিকার পদদলিত কিংবা অবহেলিত হলে তাদের অসন্তুষ্টিরন কারণে জাহান্নামের রাস্তাও খুলে যেতে পারে। পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ। তাদের আনুগত্য করলে আল্লাহর নির্দেশ পালন করা হয়। এর জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে অনেক কল্যাণ ও সওয়াব রয়েছে। পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের ইহকালীন ও পরকালীন উভয় গুরুত্ব রয়েছে। এ জন্য রাসূলুল্লাহ স.Ñ এর একটি হাদীসে এসেছে, ইবনে উমার রা. বলেন, (কারো প্রতি তার) পিতা সন্তুষ্ট থাকলে প্রভুও তার প্রদি সন্তষ্ট থাকেন এবং তার পিতা অসন্তুষ্ট থাকলে প্রভুও অসন্তষ্ট থাকেন। “ ইমাম বুখারী. আল-আদাবুল মুফরাদ, অনুবাদ: মুহাম্মদ মূসা (ঢাকা: আহসান পাবলিকেশন্স, ২০০১), অনুচ্ছেদ: কওলুহু তা‘য়ালা: ওওয়াস-সাইনাল ইনসারনা বি ওয়লিদাইহি ইহসানা, পৃ.৩৩, হাদীস নং ২”। আইনের ৪ নং ধারায় পিতার অবর্তমানে দাদাদাদীকে এবং মাতার অবর্তমানে নানানানীকে ভরণÑপোষণের কথা বলা হয়েছে এবং তাদের এই ভরণ-পোষণ পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ হিসেবে গণ্য হবে। “পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩, ধারা-৪”। আইনের ৪নং ধারায় পিতার অবর্তমানে দাদাদাদীকে এবং মাতার অবর্তমানে নানানানীকে ভরণ-পোষণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোন সন্তানের পিতা ও দাদা একইসাথে বর্তমান থাকাবস্থায় পিতা অক্ষম বা অবসর জীভনযাপন করলে কিংবা পিতা আয় করতে সক্ষম না হলে উক্ত সন্তানের উপরই তার পিতা ও দাদার দায়িত্ব একই সাথে বর্তাব্ েকিনা তা বলা হয়নি। আর যদি এ অবস্থায় পিতা ও দাদার দায়িত্ব বর্তায় তাহলে তার উপর একাধিক দায়িত্ব বর্তাবে। তা পালনে সে সক্ষম না হলে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে তা উল্লেখ করা হয়নি। জমহুর ফকীহ (হানাফী, শাফিঈ, হাম্বলী)Ñএর মতে, পৌত্র ও পৌত্রির উপর দাদার ভরণ-পোষণ দেয় ওয়াজিব। তিনি পিতার দিক থেকে (দাদা) হোন কিংবা মাতার দিক থেকে (নানা)। ওয়ারিস সহ বা না হন এবং অন্য ধর্মের অনুসারী হলেও। যেমন পৌত্র মুসলিম ও দাদা কাফির অথবা দাদা মুসলিম ও পৌত্র কাফির। কেননা আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন, ‘আর পৃথিবীতে তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবনযাপন করো।’ “আলÑকুরআন, ৩১:১৫”। তাদের প্রয়োজন পূরণ করা সদ্ভাবে জীবনযাপনের অংশ। হাদীসে এসেছে, ‘নিশ্চই তোমাদের সন্তানগণ তোমাদের সর্বোত্তম উপার্জন। সুতরাং তোমাদের সন্তানদের উপার্জন ভক্ষণ করো। “আবু দাউদ (সম্পা.ইজ্জত উবাইদ দা‘আস) খ.৩, পৃ.৮০১, ইবনে মাজাহ (সম্পা.আলা হালাবী)( খ.২, পৃ.৭৬৯, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা-এর হাদীস থেকে উদ্ধৃত করেন। আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, খ.১, পৃ.৯৮”। উপরন্ত, দাদা পিতার সাথে সংযুক্ত, যদিও তিনি পিতা শব্দের আওতাভুক্ত নন। আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ, খ.১, পৃ.৯৮”। আইনের ৫নং ধারার ১নং উপধারায় পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ না করার দÐ বর্ণনা করা হয়েছে। কোন সন্তান কর্তৃক ধারা ৩ এর যে কোন উপধারার বিধান কিংবা ৪নং বিধান লংঙ্ঘন অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদÐে দÐিত হবে বা উক্ত অর্থদÐ অনাদায়ের ক্ষেত্রে অনূর্ধ্ব তিন মাস কারাদÐ ভোগের বিধান রাখা হয়েছে। আইনের ৫নং-এর ২নং উপধারায় বলা হয়েছে, কোন সন্তানের স্ত্রী বা ক্ষেত্রে অনুযায়ী স্বামী কিংবা পুত্র কন্যা বা অন্য কোন নিকটাত্মীয়, পিতা-মাতা বা দাদাদাদী বা নানানানী ভরণ-পোষণ প্রদানে বাধা প্রদান করেন অথবা অসহযোগিতা করেন তিনিও অনুরূপ অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেছেন বলে গণ্য হবে এবং উপধারা (১) এ উল্লিখিত দÐে দÐিত হবেন। “পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩, ধারা-৫”।
পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন অনুযায়ী পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ না দিলে অনূর্ধ্ব ১ লক্ষ টাকার অর্থদÐ বা অনাদায়ে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদÐে বিধান রাখা হয়েছৈ। শাস্তি প্রয়োগের দ্বারা অপরাধের জাগতিক প্রায়শ্চিত্ত হতে পারে; কিন্তু তাতে পিতা-মাতার অসহায়ত্বের প্রতিবিধানের কোন ব্যবস্থা নেই। ইসলামে পিতা-মাতার অবাধ্যতাকে বড় পাপ ও কবীরা গুনাহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পিতা-মাতার অবাধ্যতার জন্য কোন শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। তবে সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী শাস্তির বিধান প্রণয়ন করতে পারবেন। এক্ষেত্রে আমিদের সমন্বয়ে গঠিত শরী‘আহ্ কাউন্সিল কুরআন ও সুন্নাহ্র আলোকে তা প্রণয়নের পরামর্শ দিতে পারেন। পিতা-মাতার অবাধ্য হলে তারা কষ্ট পাবেন। তাদের কষ্ট দেয়া হারাম। এজন্য তাদের বৈধ আদেশ যা শরী‘আহ্ পরিপন্থী নয় তা মান্য করা সন্তানের জন্য অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু তাদের আনুগত্য করতে গিয়ে যদি আল্লাহর অবাধ্যতার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তা পালন করা যাবে না। আবু বকরা রা. বলেন রাসূলুল্লাহ স. বলেন: আমি কি তোমাদেরকে কবীরা গুনাহগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মকগুলো সম্পর্কে অবহিত করবো না? কথাটি তিনি তিনবার বললেন। উত্তরে সাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বলেন: আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা এবং পিতা-মাতা অবাধ্যচরণ করা। তিনি হেলান দেয় অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বেস বললেন: এবং মিথ্যা বলা। তিনি এ কথাটি বারবার বলছিলেন। আমি মনে মনে বললাম, আহা! তিনি যদি ক্ষান্ত হতেন। “ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং-৫৪৩৮”। ইসালামে আনুগত্য প্রাপ্তির অধিকার শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলার। পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ আল্লাহর নির্দেশেরই আনুগত্য। তাই পিতা-মাতার অবাধ্যতা প্রকারান্তরে আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘনেরই নামান্তর। পিতা-মাতার বদদোয়া সন্তানের জন্য দুনিয়াতেই কার্যকর হয়ে যায়। আবু বাকরাহ রা. থেকে বর্ণিত, নবী স. বলেছেন: পিতা-মাতার আবাধ্যৗতা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার শাস্তি দুনিয়াতে অন্যান্য পাপের চেয়ে দ্রæত অপরাধীর উপর কার্যকর হয়। পরকালের শাস্তি তো আছেই। ইমাম বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ, অনুচ্ছেদ: উকুবাতি উক্কূকিল ওয়ালিদাইন, হাদীস নং-২৯, পৃ.৪৩”। পিতা-মাতাকে কাঁদানোর অর্থ তাদের সাথে অন্যায় আচরণ করে তাদের মনে কষ্ট দিয়ে তাঁদের কাঁদানো। পবিত্র কুরআনে তাই তাঁদের সম্মুখে উহ্ শব্দটি উচ্চারণ করতে বারণ করা হয়েছে। তায়সালা রহ. থেকে বর্ণিত। তিনি ইবনে উমার রা.- কে বলতে শুনেছেন: পিতা-মাতাকে কাঁদানো তাদের অবাধ্যচরণ ও কবীরা গুনাহ সমূহের শামিল। “ইমামা বুখারী, আলÑআদাবুল মুফরাদ, অনুচ্ছেদ: বুকা-ইল ওয়ালিদাইন, হাদীস নং-৩১, পৃ.৪৩”। আইনের ৬নং ধারায় উল্লিখিত অপরাধকে আমলযোগ্য (Cogniable) জামিনযোগ্য (bailanle) এবং আপোষযোগ্য (Compoundable) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
Compoundable
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।