Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পিতা-মাতার অবর্তমানে অটিস্টিক শিশুদের দায়িত্ব নেবে সরকার প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশের সময় : ৩ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বিশেষ সংবাদদাতা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অটিস্টিক শিশুদের পিতা-মাতার অবর্তমানে তাদের লালন-পালনের জন্য রাষ্ট্রই দায়িত্ব গ্রহণ করবে। আমি সবসময় উপলব্ধি করি অটিস্টিক শিশুদের জন্য সব চেয়ে বেশী কষ্ট হচ্ছে মায়ের। তাই তাদের মা-বাবা যখন থাকবে না, তখন এদের কী হবে। এরা কোথায় যাবে। আমরা এ ব্যাপারে একটা উদ্যোগ নিচ্ছি। বাবা-মা যখন থাকবে না, তখন সরকারের পক্ষ থেকে তাদের লালন-পালনের ব্যবস্থা আমরা করবো। তিনি গতকাল শনিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস-২০১৬ উপলক্ষে সমাজক্যাণ মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
মেধা বিকাশের সুযোগ পেয়ে অটিজমে আক্রান্তরাও যেন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে, সেজন্য সবাইকে আরও উদ্যোগী হওয়ারও আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, অটিস্টিকদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা আছে। সেটাই বিকশিত করে দেয়ার সুযোগ করে দিতে হবে, যেন মেধা বিকাশের মাধ্যমে তারাও সমাজকে কিছু উপহার দিতে পারে। অটিজমে আক্রান্ত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন, চার্লস ডারউইন, আইজ্যাক নিউটনের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, অটিস্টিক শিশুরা যেন অবহেলায় হারিয়ে না যায় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। তারাও মানুষ। তারাও আমাদের সমাজের অংশ, তাদের জন্যও আমাদের কাজ করতে হবে। একটা দেশকে উন্নত করতে হলে সকলকে নিয়ে কাজ করতে হবে, কাউকে অবহেলা করা যাবে না।
শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকারের নেয়া পদক্ষেপের কারণে দেশে অটিজম সচেতনতা বেড়েছে। আমাদের দেশে আগে অটিজম নিয়ে কোনো সচেতনতাই ছিল না। কোনো সন্তান অটিস্টিক থাকলে বাবা-মা সেটা লুকাতেন। সমাজের কাছে বলতে পারতেন না। মাত্র কিছু দিন থেকে এ সচেতনতার ব্যাপারটা সামনে চলে এসেছে। প্রতিবন্ধী শিশুদের মূলধারায় আনতে সরকার কাজ করছে।
’৯৬ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগে চালু করা কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বিএনপি-জামায়াত বন্ধ করে দেয়ার ফলে জনসাধারণের দুর্ভোগের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ফাউন্ডেশন ও ট্রাস্ট করে এমনভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো যাতে ভবিষ্যতে সরকার পরিবর্তন হলেও কেউ তা বন্ধ করতে না পারে। তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও যেন প্রযুক্তির উৎকর্ষের সকল সুবিধা গ্রহণ করতে পারে সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার হার্ডওয়্যার ও ওয়েবসাইট তৈরীতে এগিয়ে আসার জন্যও সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেক জেলা-উপজেলাতে একটি করে অটিজম চিহ্নিতকরণ ও চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনে সরকারের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে বলেন, শুধু ঢাকায় নয় ঢাকার বাইরেও আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। ৬৪ জেলায় এবং ৩৯টি উপজেলায় ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে অটিজম কর্ণার চালু করা হয়েছে। যা থেকে প্রায় ২০ লাখ প্রতিবন্ধী সেবা গ্রহণ করছে। ঢাকায় শিশু হাসপাতাল সহ ১৫টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র স্থাপন করে অটিজম সমস্যা জনিত শিশুদের চিকিৎসা সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে পর্যায়ক্রমে প্রত্যেকটি জেলা এবং উপজেলাতেও একটি অটিজম সনাক্তকর এবং তাদের কাউন্সেলিং করা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। যারা সেবা প্রদান করবেন তাদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বিভিন্ন স্থানে যেমন সেনানিবাসে ‘প্রয়াস’ নামে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় করা হয়েছে। চট্টগ্রাম ও কুমিল্লাসহ প্রতিটি সেনানিবাসে আমি ইতোমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছি আমাদের প্রতিটি সেনানিবাসে এই প্রয়াসের শাখা তৈরী করা হবে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. চৌধুরী মো. বাবুল হাসানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন এমপি। জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসরিন আরা সুরাত আমিন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
অটিজম ও স্নায়বিক সমস্যাজনিত জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপার্সন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন এ উপলক্ষে জাতিসংঘে অটিজম বিষয়ক মূল অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকায় অনুষ্ঠানে তাঁর ধারণকৃত বক্তৃতা পরিবেশন করা হয়।
তিনি তার কন্যা ও সমাজকর্মী সায়মা ওয়াজেদের কাছ থেকেই অটিজম বিষয়ে শিক্ষা পেয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, সোস্যালজিতে লেখাপড়া করা সায়মার আগে থেকেই এসব বিষয়ের প্রতি গভীর টান ছিল। প্রধানমন্ত্রী জানান, যুক্তরাষ্ট্রে সায়মার কর্মপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে তাঁরা কিভাবে কাজ করেন তা তিনি দেখে এসেছেন। তিনি বলেন, জাতিসংঘে প্রথম যে রেজ্যুলুশন হয়েছে সায়মাই সেই উদ্যোগ নিয়েছে। জাতিসংঘ রেজ্যুলুশনগুলো নেয়াতে সারাবিশ্বে এটি সাড়া ফেলেছে। সেটিই আমাদের সবচেয়ে বড়ো অর্জন। কাজেই আজকে আর অটিজম শিশুরা অবহেলায় থাকবে না। তাদের জন্য আমরা একটা সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করে দেব।
প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধীদের জন্য তার সরকারের গৃহিত বিভিন্ন পদক্ষেপের উল্লেখ করে বলেন, আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষা আইন-২০১৩ প্রণয়ন করেছি, নিউরো প্রতিবন্ধী ডেভেলপমেন্ট সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন-২০১৩ পাশ করেছি। অটিজম বক্তিদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য নিউরো প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়েছে এবং ৩ হাজার ১শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মিরপুরে আমাদের যে প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন রয়েছে সেখানে একটি অটিজম রিসোর্স সেন্টার এবং একটি অবৈতনিক বিদ্যালয়ও স্থাপন করা হয়েছে। যাতে প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন সেবা ও ট্রেনিং দেয়া যায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিবন্ধীদের মূল ধারায় আনার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একাডেমি ফর নিউরো ডিজর্ডার নামে একাডেমী প্রতিষ্ঠার জন্য ইতোমধ্যেই জায়গা আমি দিয়ে দিয়েছি এবং এটি যেন খুব তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করা হয় সেই পদক্ষেপও আমরা নিচ্ছি। এখানে অটিস্টিকসহ সব প্রতিবন্ধী মানুষদের একযোগে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।
তিনি বলেন, প্রতিবন্ধীদের পরীক্ষায় যেহেতু একটু সময় বেশি লাগে সেজন্য এস এসসি এবং এইচ এসসিতে আমরা ৩০ মিনিট সময় বেশি প্রদান করছি। তারা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিবন্ধীরা বাংলাদেশের জন্য সুনাম বয়ে আনছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা প্রতিবন্ধীদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে এসেছে। বিশেষ অলিম্পিকে অসংখ্য স্বর্ণপদকসহ দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছে।
তিনি প্রতিবন্ধীদের সহযোগিতার জন্য সরকারের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজর্ডার এর মাধ্যমে উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসকদের অটিজম বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে অটিজম পরিচর্যাকারী হিসেবে মায়েদেরও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অটিজম ও ¯œায়বিক সমস্যা প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত করার জন্য স্ক্রিনিং টুলস তৈরীর কার্যক্রমও এগিয়ে চলেছে।
প্রতিবন্ধী হলেই অটিস্টিক না বলতে সবাইকে পরামর্শ দিয়েছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক ডব্লিউএইচও এক্সপার্ট অ্যাডভাইসরি প্যানেলের সদস্য সায়মা হোসেন পুতুল। তিনি বলেন, অটিজম নামটা এত বেশি পরিচিত হয়ে গেছে যে কোনো কিছু হলে আমরা অটিজম বলি। আমি অনুরোধ করব, এত সহজে সবাইকে অটিস্টিক বলবেন না। অনুষ্ঠানে এক ভিডিও বার্তায় এই আহ্বান জানান তিনি । ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দিবসের জাতীয় অনুষ্ঠানে সায়মা হোসেনের ভিডিও বার্তাটি প্রচার করা হয়।
অটিজমকে জটিল রোগ উল্লেখ করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সায়মা বলেন, এটা একটা কমপ্লেক্স নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিসঅর্ডার। এটা শুধু ওই মানুষটাকে এফেক্ট করে না, পুরো পরিবারকে এফেক্ট করে। অটিস্টিকদের পাশে দাঁড়াতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কাউকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমরা পুরো দেশের উন্নয়ন চাই। আমরা কাউকে ভুলে যাবো না। কাউকে ফেলে রেখে এ দেশ বড় হবে না। তারা (অটিস্টিক) আমাদের দেশের একটা অংশ মনে করে চলতে পারে। তারা যেন নিজেদের ভিন্ন কিছু মনে না করে।
তিনি আরো বলেন, আমরা বাংলাদেশে অনেক বড় করে এই দিনটা পালন করি। খুব কম দেশ আছে যে, এত বড় করে দিনটা পালন করা হয়। এজন্য আমরা গর্বিত
প্রধানমন্ত্রী নীল আলো জালিয়ে প্রতিবন্ধী দিবসের কার্যক্রম উদ্বোধনের পাশাপাশি প্রতিবন্ধিদের পরিবেশনায় ‘আলোর ভূবন’ শীর্ষক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।প্রধানমন্ত্রী এ সময় প্রতিবন্ধি শিশুদের মাঝে গিয়ে তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পিতা-মাতার অবর্তমানে অটিস্টিক শিশুদের দায়িত্ব নেবে সরকার প্রধানমন্ত্রী
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ