Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উড়াল

তা হ মি না কো রা ই শী | প্রকাশের সময় : ২৬ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

গোরস্তানের বাইরে সীমানা বেড়ার পাশে বৃদ্ধ বকুল গাছটির নিচে বসে ঝিমুছিল ময়না। হঠাৎ সারাটা গা কেঁপে উঠে ওর। ভীষণ শীত শীত লাগছে। কিছু মনে করতে পারছে না কখন সে গোরস্তানে এসেছে। কিছু দূর এগিয়ে বাইরের এই গাছটির গোড়ায় বসে পড়ে। আম্বিয়া দেখতে পায় ময়নাকে। ওর মায়ের কবর জিয়ারত করতে এসেছিল সে সকালে। দৌড়ে ওর কাছে যায়- কিরে এখানে বসে ঝিমুচ্ছিস কেন? ওঠ বাড়ি চল। ঘর বাড়ি ছাইড়ে গোরস্তানে পড়ি থাকলি কি তোর মাইয়্যা ফিরে আসপেনে?
ময়না হা করে তাকিয়ে থাকে বড় বোনের দিকে। বলে শীত করতিছে ঠাÐা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঐ যে ওর পিঠে পাখায় ভর দিয়ে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে আইলো। কি সব আবল তাবল বকতিছিস? চল বাড়ি চল। শোন ময়না- আল্লাহর মাল আল্লাহই নিয়ে গেইছে। কারো হাত আইছে ধইরে রাখপের পারে। তুই কি মেয়ে জন্যি পাগল হইয়ে যাচছিস?
ময়না সম্ভিত ফিরে পায়। উঠে দাঁড়ায় বোনকে জড়িয়ে ধরে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বলে নেই আমার মাইয়্যাডা নেই বু। তের বছরের ফুটফুইট্যে সুন্দর লাউ এর ডগার মত লম্বা লকলইক্যা মাইয়্যাডা নেই। দুই দিনের জ¦রে ক্যাবা কইরে মইরে গেলো। ও বু ক কেন গেলো?
বড় বোন আম্বিয়ার চোখ ভেসে যায় জলে। ময়নাকে বুকের ওমে টেনে নেয়। আদর করে। মাথা গা শাপটে দেয়। বলে কি কব ক। এর মইধ্যে কোন ভালো কিচু আইছে না কি? তাই মানতি হবি।
তোর বড় দুইখান সাওয়াল আছে। ওগের দিকে তাকিয়ে বাঁচার পথ খুঁইজে নেয়া লাগবিনে। চল বাড়ি চল। আমার কাছে কিছু দিন থাক। ভালো লাগবিনে। ময়না চুপ করে থাকে। কি করবে ময়না পাঁজরের হাড় এক খÐ পড়ে আছে এখানে। ব্যথায় কুঁকড়ে যায় শরীর মন ওর। তবুও বড় বোনের কথায় দেহটাকে ঠেলে নিয়ে চলে। ময়নার বড় দুই ছেলে অল্প বয়সেই বিয়ে থা করে শ^শুর বাড়ির ভিটা দখলে ব্যস্ত। ওর স্বামী মারা যাওয়ার পরে এই একটি মেয়েকে সম্বল করেই ওর জীবনের পথ পরিক্রম। সেই তার বন্ধু-মা-বোন তার সুখে দুঃখের সঙ্গী। তাকে ঘিরে সে আবর্তিত। জীবনের মানে খুঁজে পায় ময়না তার মেয়ে সোনালীর শরীরের ঘ্রাণে। শোকে তাপে বেহাল অবস্থায় সোনালীকে দেখে দেখে জীবনে শ^াস নিতে পারছিল। রূপে-গুণ মেয়েটি অধরা। লেখপড়াও করেছিল স্কুলে। মেয়ে বড় হবে চাকরি করবে কতই স্বপ্ন ময়নার। মনে মনে ওর জন্য ঘর জামাইও খুঁজে রেখেছে। ওর ফুফাতো বোনের ছেলে আনোয়ার। ভীষণ ভদ্র একটি ছেলে তাকে ভারী সম্মান করে। তারও মনে ধরেছে সোনালীকে কিন্তু মুখ ফুটে কখনও বলেনি। সোনালীও পছন্দ করে আনোয়ার ভাইকে কিন্তু মায়ের পছন্দ মায়ের ঘর জামাই বানানোর স্বপ্ন কাকে দিয়ে পূরণ হবে তা তো জানে না সোনালী। নিজের ইচ্ছেকে প্রকাশ করেনি কখনও। দুঃখের মাঝেও আশার পিদিম জ¦ালিয়ে রেখেছিল আনোয়ার। স্বামী মারা যাবার পর তিনটি সন্তানকে আগলে রেখেছে ময়না যক্ষের ধনের মত। এর মধ্যে বড় দুটো পাখি উড়াল শিখে তাকে ছেড়ে চলে যায় অন্য নীড়ে বাসা তৈরীতে ব্যস্ত। মেয়েটা তার আশা লতা। ভীষণ কষ্ট পেয়েছে ময়না।
ওর ভাবনায় ছেদ পরে। আম্বিয়া বলে- কয়দিন আমার বাড়ি থাকপের পারিস না। মন ভালো ঠেকলি চইলে যাইস। দুই বইন গল্প কইরে কাটাবোনে। পুকুর পাড়ে আড্ডা জমাবোনে। সইন্ধা তামাত বইসে থাকপোনো পানির দিকে চাইয়ে চাইয়ে। বোবা দৃষ্টি ফ্যাল ফ্যাল করে শোনে বড় বোনের কথা। আর ঘাড় কাত করে উত্তর করে। এতটুকুই। দুই চোখে এক পুকুর স্বচ্ছ জল টলমল লাল টুকটুকে গায়ের রঙ। পটে আঁকা ছবি। আম্বিয়া চেয়ে চেয়ে দেখে বোনকে আর বলে এখনও তোক বিয়ে দেয়া যাবেরে ময়না। এতো রূপ নিয়ে কি কইরে পাড় করলি এ জেবন? এহেবারে এহলা এহলা। ব্যাটা মানুষগুলো এখনও তোর জন্নি পাগল হইয়ে ঘুরতিছে। ময়নার ঠোঁট কেঁপে কেঁপে ওঠে। হাসি ভুলে গেছে। আম্বিয়া ওর গায়ে একটু ধাক্কা দিয়ে কয়- নাওয়া খাওয়া, কথা হাসি সবই ভুইলে গেইলে চলবি কেবা কইরে।
এবার মুখ খোলে ময়না বলে- ক বু ক। কার জইন্নি আমার এই জেবন। আমার আইন্ধার ঘরের মানিক সেই তো আমার ছাইড়ে চইলে গেলো। আমি বাঁইচপো কি নিয়ে। যত সুখ কিচ্ছা সব তিন হাত মাটির তলে গাইড়ে রাইখে আলাম।
আবার চুপ করে বসে থাকে। এভাবেই দিনগুলো গড়িয়ে যায়। প্রতি রাতেই ময়নাকে নিশি ডাকে। তার পিছু পিছু দরজা খুলে হেঁটে চলে যায়। ঐ পুকুরপাড় বুড়ো বকুল গাছটির তলায় ঝিম ধরে বসে থাকে। আম্বিয়ার ঘুম ভেঙ্গে যায় বিছানায় ওকে পায় না। শীতে কাঁপা কাঁপা ঠাÐা শরীর আম্বিয়া ওকে চাদরে ঢেকে নিজের দেহের ওম লাগিয়ে ঘর নিয়ে আসে। দুই চোখে জল মুখে বিড়বিড় করে কি যেনো আওরায় ময়না। আম্বিয়ার সংবেদনশীল মনের আয়নায় মেয়ে ও মায়ের বিম্বিত ছায়া চোখে জল হয়ে ঝরে পড়ে। বোনকে আগলে রাখে যত দিন না সে। এই স্মৃতি মুছে বাস্তবতায় ফিরে আসে। হ্যালোসিনেশনে ডুব যাওয়া ময়নার উত্তরণ জরুরি।
নিত্যই উড়ন্ত ডানায় ভর করে উড়াল দেয় যত্রতত্র ময়না। দৃষ্টিতে অন্বেষণ একটিই মুখ একটি শরীরে একটি আত্মা। ওর চোখে ভেসে ওঠে ওর মেয়ে সোনালীর নিত্য দিনের কর্মময় জীবনের বাইসকোপ। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর বলে আয় মা আয় কতদিন দেখি না তোরে। আয় কাছে আয় মাথাটা বাইন্ধা দেই। কি যে উস্কা ঘুসকা কইরা রাখিছিস। কেশবতী কইন্যা আমার মেঘবতী চুল এমনে আওলা বাতাসে উড়াইয়া রাখছোস ক্যান। আয় বেণী গাঁইথ্যা দেই। কতদিন সুনো ক্রীম পড়ে নাই মুখটার মইধ্যে। সোনার বরণ ময়লা হইয়া গেছে। কতদিন দেখি না তোরে বুকটার মইধ্যে খা খা কইরা আগুন জ¦লতাছে। তোর লাইগ্যা খাওন নিয়া যামুনে কাইল। সত্যি সত্যি কিছু খাবার প্যাকেট করে মেয়ের জন্য ময়না। আম্বিয়া কিছু বলে না। ওর কোন কাজেই বাধা দেয় না। মন পোড়া মানুষ যাতে আনন্দ পায় তাই করুক।
সারাটা দিন ভালোই ছিল। রাতে ঘুম আসে না ময়নার। গা গরম জ¦র জ¦র লাগছে। আম্বিয়া রাতে ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে গেছে। সারাটা রাত নিঃঘুমা ময়না আবোল তাবোল বকেছে। রাত পোহানোর অপেক্ষায়। খাবারের পোটলাটি নিয়ে রাতেই শীত কুয়াশায় বেরিয়ে পড়ে। নিশি ডাকে তার পিছু পিছু ছুটছে। পথে যেতে যেতে আওড়াতে থাকে এই উড়াল জীন তুই আমাকে কই নিয়ে যাচ্ছিস। উত্তরও পায় তোর মেয়ের কাছে। কতদিন না তুই ওর জন্য অপেক্ষায় আছিস। আজই তোকে নিয়ে যাবো তোর মেয়ে সাথে দেখা করাতে।
খুশিতে ডগমগ হয়ে যায় ময়না। যাও উড়াল জীন যাও। আরো জোরে আরো জোরে। আমি তোমার পিঠে বইসে ডানা দুটো চাইপে ধইরে রাখছি। কি ঠাÐা বাতাস। সারা শরীর হিম হয়ে আসতিছে। হাতে জোর পাচ্ছি না। এবার একটু আস্তে যাও উড়াল জীন। নইলে পইড়ে যাবোনে। আমার হাত কাঁপতিছে। হাতে-শরীরে জোর কইমে যাচ্ছে। আমি তোরে আর ধইরে রাখতে পালাম না। পইড়ে যাচ্ছি কলাম।
এক সময় সত্যি সে পড়ে যায়। গোরস্তানে মেয়ের কবরের পাশে ছোট্ট একটি বকুল চারার পাশে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ময়না। আশেপাশে কিছু লোকের ভীড়।
চারিদিকে ফজরের নামাজের আজানের ধ্বনি প্রতিধ্বনি তোলে আম্বিয়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ময়নার ঘরে ছুটে আসে। দেখে ময়না বিছানায় নেই খাবারের পোটলাও নেই। সে বুঝতে পারে মেয়ের কাছে ময়না। দৌড়ে বেড়িয়ে পরে আম্বিয়া গোরস্তানের উদ্দেশ্যে। ছুটতে ছুটতে গোরস্তানে পৌঁছে যায়। লোকজনের ভীড় ঠেলে দেখে ময়না মেয়ের কবরের পাশে মুখ থুবড়ে দেহটি পড়ে আছে। খাঁচায় প্রাণ পাখিটি বহু আগেই বেড়িয়ে গেছে। ঠাÐা এক টুকরো শক্ত বরফ হয়ে জমে আছে দেহটি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উড়াল

১৫ জানুয়ারি, ২০২৩
২৬ মার্চ, ২০১৮

আরও
আরও পড়ুন