Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মনুষ্যত্ববোধ

শে খ দ র বা র আ ল ম | প্রকাশের সময় : ২৬ মার্চ, ২০২০, ১২:০১ এএম

এক
মানুষ সাপ দেখলে ভয় পেয়ে সরে যায়। বাঘ দেখলে ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু অচেনা মানুষ দেখলেও ভয় পেয়ে পালিয়ে যায় না। সব মানুষেরই মানুষরূপী যে চেহারা থাকে, সব মানুষেরই দেখতে মানুষের মতো যে চেহারা থাকে, তাতে একটা অপরিচিত মানুষকে দেখলেও মানুষ ভয় পায় না। তা হলে তো বোঝা যায় যে, সাপ কামড়াবে কি কাড়াবে না, বাঘ আক্রমণ করবে কি করবে না, এটা না জেনেও মানুষ সাপ দেখলে ভয় পায়, বাঘ দেখলে ভয় পায়। কোথাও সাপ থাকতে পারে শুনলেও ভয় পায়, কোথাও বাঘ থাকতে পারে শুনলেও ভয় পায়। কিন্তু কোথাও অচেনা মানুষ থাকতে পারে শুনলেও ভয় পায় না। তা হলে দেখা যাচ্ছে যে, স্বাভাবিক মানুষের প্রতি একটা আস্থা, একটা বিশ্বাস অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই স্বাভাবিক মানুষের থাকে।
অতএব দেখা যাচ্ছে যে, স্বাভাবিকভাবে হিন্দু ইহুদি, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, শিখ, পার্জী, মুসলমান নির্বিশেষে সব স্বাভাবিক মানুষের কাছ থেকেই একটা মনুষ্যত্ববোধের প্রত্যাশা, একটা মানবিক অনুভূতির প্রত্যাশা, একটা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিও প্রত্যাশা সব স্বাভাবিক মানুষেরই থাকে।
দুই
আমাদের ইসলামী শিক্ষা আমাদেরকে এই জ্ঞান-গম্যি দেয় যে, সব মানুষই মুসলমান হয়েই জন্মায়। তবে এক একটা পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে মানুষ এক এক রকমের ধর্মীয় পরিচয় পায়। সেই হিসেবেই কেউ হয় ইহুদি, কেউ হয় খ্রিস্টান, কেউ হয় হিন্দু, কেউ হয় পার্জী, কেউ হয় জৈন, কেউ হয় বৌদ্ধ, কেউ হয় মুসলমান, কেউ হয় শিখ ইত্যাদি। আবার সেভাবেই তো কেউ হন উর্দু ভাষী, কেউ হন হিন্দী ভাষী, কেউ হন বাঙলাভাষী, এ রকমই তো? তাহলে এ প্রসঙ্গে-এ দেখা যাচ্ছে যে, ইসলামী চিন্তায় সাম্য ও সহাবস্থানের একটা সংস্থান আছে। যে সব জাতীয়তাবাদীরা মুসলমানদের প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে দেখেন তারাও অনেকেই স্বীকার করেন যে, ইসলামে সাম্য ও সহাবস্থানের সংস্থান আছে। তা সত্তে¡ও তারা জাতীয়তাবাদী হন তাদের আপন জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য কামে স্বার্থে।
আমি ভেবে দেখেছি যে, মানুষ সাম্য ও সহাবস্থানবাসী না হলে কেউ প্রকৃত মুসলমান হন না, কেউ প্রকৃত মানুষও হন না। কিন্তু যারা জাতীয়তাবাদী হন এবং এক জাতি তত্ত¡ আরোপকামী হন, তারা কেউই সাম্য এ সহাবস্থানকামী হন না, মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন হন না, বিবেকবোধ সম্পন্ন হন না, ঔচিত্যবোধ সম্পন্ন হন না, সৎ হন না এবং প্রকৃত গঠনমূলক চিন্তা-ভাবনা সম্পন্ন হন না, কেননা, যে কোনো জাতীয়তাবাদ দাঁড় করাতে হলে এবং সেই জাতীয়তাবাদকে তুঙ্গে তুলতে হলে কোনো জনগোষ্ঠীকে প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসাবে শনাক্ত করতে হয়। জাতীয়তাবাদীরা আবার মানসিকভাবে এক জাতিতত্ত¡ আরোপকামীও হন। বিষয়টা একটা কঠিন বাস্তব উদাহরণ-দিয়ে দেখিয়ে দেয়া যায়।
ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের প্রতিবেশী আর্য বংশোভূত বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রুয়ী মনুসংহিতার সমাজের জাতীয়তাবাদী মহলের আর্য-হিন্দুদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের প্রতিপক্ষ এ শত্রু হিসাবে বিশেষ করে ১৭৫৭ এর ২৩ শে জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসনের সময় থেকে শনাক্ত হয়ে আছেন মুসলমানরা। এই সময় থেকেই আর্য-হিন্দুরা এই জাতীয়তাবাদটা গ্রহণ করেছেন ক্রুসেডের চেতনাসম্পন্ন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজীভাষী শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী খ্রিস্টান বণিকদের সহযোগী সমাজের লোক হিসেবে সান্নিধ্যে এসে। যে কোনো রকমের জাতীয়তাবাদ এবং এক জাতীতত্ত¡ যে সাম্য ও সহাবস্থান চিন্তার পরিপন্থী, মনুষ্যত্ববোধের পরিপন্থী, সে প্রসঙ্গেই এই উল্লেখটা করলাম।
তিন
খুব ছোট্ট বেলায়, মানুষ্যত্ববোধের তালিমটা পেয়েছিলাম আমি আমার আব্বার কাছ থেকে। মনুষ্যত্ববোধের শিক্ষাটা আমার আব্বা আমাদের দিয়েছিলেন খুবই সহজ এবং সরলভাবে। তিনি বলতেন, “তোমার সঙ্গে লোকে যে রকম ভাবে কথা বললে তোমার ভালো লাগে, তুমি অন্যদের সঙ্গে ঠিক সে রকম ভাবেই কথা বলো। তোমার সঙ্গে লোকে যে রকম ব্যবহার করা হলে তোমার ভালো লাগে, তুমিও সব-মানুষের সঙ্গে সে ভাবেই সে ব্যবহার করো।
আব্বার কাছে শেখা এই হলো ব্যবহারিক জীবনের মনুষ্যত্ববোধের, জীবনবোধের মানদন্ড। আব্বার কাছ থেকে পাওয়া এই শিক্ষায় আমি কখনো নিজের জন্য একটা এবং অন্যের জন্য আর এক রকম একটা, এ রকম দুটো মানদন্ড নিয়ে চলতে শিখিনি। আমি কখনো কোনো মানুষের কোনো ক্ষতি করিনি। কারো কোনো ক্ষতি করার কথা কখনও চিন্তাও করিনি। সব সময়ই সংবেদনশীল মন, স্পর্শকাতর মন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলেছি।
অর্থনৈতিক দিকে দিয়ে আমি পুরোপুরিই নিঃস্ব অসহায় এবং তৃণমূল স্তরের মানুষ এই অবস্থায় থেকেও সেবামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে যখন কাউকে সহযোগিতা করতে পারি। তখন খবুই শান্তি পাই, স্বস্তি পাই। আত্মকেন্দ্রীক হওয়ার অনুদার এবং নিষ্ঠুর হওয়ার কোনো রকম মানবিক যোগ্যতা আমার নেই। জীবিকার প্রয়োজন, জীবন ধারনের প্রয়োজন আমার আছে ঠিকই, কিন্তু আমি লেখালিখিও করি গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে। একটু খেয়াল করলে যে কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন যে, মানুষের প্রয়োজনে আসতে পারে এমন কাজের বিষয়েই কেবল আমার লিখতে ইচ্ছে করে। এমন প্রয়োজনীয় লেখার বিষয় অনেক আছে। তাই লেখা আমার কাছে কোনো বিলাসিতা নয়। আমি যে অর্থনৈতিক স্তরের, যে সমাজের সংবেদনশীল মনের মানুষ তাতে লেখাকে বিলাসিতার বিষয় হিসাবে গ্রহণ করার মানসিক যোগ্যতাও আমার নেই।
চার
ইতিহাস চর্চার এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির অভিনয় অনেক গঠনমূলক কাজ-কর্ম করার আছে। এই সব ক্ষেত্রে চর্চার ক্ষেত্রে অভিমুখটা ১৯৪৭-এর ১৪-ই আগস্টের পর অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে পাল্টে দেয়া হয়েছে। এতদঞ্চলের মুসলমানরা ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্ট পূর্ব বর্তীকালের মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সাংস্কৃতির পরম্পর এবং পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন ১৯৪৭-এর ১৪ই আগস্ট পরবর্তীকালে। কোনো ধর্মীয় সমাজের মানুষ যদি তাদের নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক জাতিসত্তার বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের সাম্য সহাবস্থানের নীতিতে স্থিত থাকে তা হলে তারা সুস্থ জীবনবোধে স্থিত থাকতে পারে। আমাদের প্রতিবেশী আর্য-হিন্দুরাও এদিকটা নিজেদের জন্য খেয়াল রাখেন।
প্রত্যেক ধর্মীয় সমাজের মানুষ প্রেরণা পেতে পারে কেবল তাদের নিজ নিজ অতীত ইতিহাস থেকে। ভারতীয় উপমহাদেশের সিংহভাগ মুসলমানকে সেই জায়গাটা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। এই অবস্থায় তৈরী হয় লক্ষ্যভ্রষ্ট ও লক্ষ্যহীন নষ্ট মানুষ! সেটা আমরা এখন দেখছি আমার যে নানান ক্ষেত্রে মূল্য বোধের অবক্ষয়ের কথা শুনি, তার উৎস মুখটা এখানেই। ১৯৪৭-এর ১৪-ই আগস্টের অব্যবহিত পর থেকে আমরা যে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদ গ্রহণ করেছি সেটা কেবল ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টে সৃষ্ট মুসলিম প্রধান দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী প্রধান, মুসলিম প্রধান, প্রদেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাজ করেনি, কাজ করেছে মুসলিম উম্মার ঐক্য ও সংহতির বিরুদ্ধেও এবং মুসলিম সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তার বিরুদ্ধেও মুসলিম জাতিসত্তা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য, সঙ্গীত স্থাপত্য ও অন্যান্য শিল্পের বিরুদ্ধেও, মুসলিম নামাঙ্গিত সব কিছুর বিরুদ্ধেও।
১৯৪৭-এর ১৪ই আগস্টের পর এই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে এবং অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদে উৎসাহ ও প্রেরণা যুগিয়েছেন অনুশীলন সমিতির সভ্য মনি-সিংহের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিও, অনুশীলন সমিতির সভ্য মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সোশ্যালিস্ট পার্টির এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন সভার এবং গঠনপরিষদে যোগ দেয়া ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অনুশীলন সমিতি (১৯০২)-র যুগান্তর দল (১৯০২)-এর এবং অন্যান্য ইসলাম ও মুসলিম উৎখাতকামী আধা-সামরিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের আর্য-হিন্দু সভ্যরা।
ভারতীয় উপমহাদেশের একাধারে আর্য-হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়বাদ, আর্য-হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক এক জাতিতত্ত্ব এবং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ এই সব রকমের জাতীয়তাবাদই জন্ম দিয়েছেন আর্য-হিন্দুরা কারণ এরা আমাদেরকে মুসলিম সভ্যতার জায়গায় আর্য-হিন্দুদের সভ্যতা এবং মুসলিম সাংস্কৃতিক জায়গায় আর্য-হিন্দুদের ধর্মীর সংস্কৃতি আমাদের নিজেদের বলে গ্রহণ করাতে চান। অবশ্য এই একই সঙ্গে এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে, আর্য-হিন্দুদের সবাই কিন্তু আর্য বংশোভূত বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রুয়ী মনু-সংহিতার সমাজের জাতীয়তাবাদী মহলের লোক নন, আর্য-হিন্দুদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠাকামী নন, আর্য-হিন্দুদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক এক জাতিতত্ত্ব আরোপকামী নন। এদের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধে উত্তীর্ণ অনেক মহৎ, উদার, বিবেকবান এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন খুবই সংবেদনশীল মনের, স্পর্শকাতর মনের মানুষও আছেন। এদের অনেকের লেখা না পড়ে এদের কারো কারো কথাবার্তা শুনে এবং এদের কারো কারো মানবিক ব্যবহার থেকে এটা আমি উপলব্ধি করেছি। অতএব, ঢালাওভাবে বলার মতো কোনো বিষয় নয়।
মনুষ্যত্ববোধ প্রসঙ্গেই আমি জাতীয়তাবাদের কথা এবং এক জাতিতত্তের কথা উল্লেখ করলাম। কেননা, যে কোনো রকমের জাতীয়তাবাদ এবং এক জাতিতত্ত¡ মানুষের মনুষ্যত্ববোধ কেড়ে নেয়।
জাতীয়তাবাদ এবং এক জাতিতত্ত্ব থেকেই আসে প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসাবে শনাক্ত জনগোষ্ঠীকে প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসাবে দেখে দেয়া জনগোষ্ঠীকে অধিকার বঞ্চিত করার সাম্প্রদায়িকতা, প্রতিপক্ষ এ শত্রু হিসাবে দেখে দেওয়া জনগোষ্ঠীর জান-মাল কেড়ে নেয়ার নাৎসীবাদ এবং ফ্যাসীবাদ। যেটা আমরা বিশ্বে এবং এই মহাদেশে আগেও দেখেছি এবং এখনও দেখছি। পৃথিবীর কোনো ধর্মীই কিন্তু, অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে সমস্যা নয়, পৃথিবীর কোনো বর্ণ বা গায়ের রঙই কিন্তু অন্য



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: স্বাধীনতা দিবস

২৬ মার্চ, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন