পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
তৈমূর আলম খন্দকার :
রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক অনুশীলন যথা: জনসভা, বিক্ষোভ, পথসভা, মানববন্ধন, এমনকি পার্টি অফিসের সামনে দু’দন্ড দাঁড়িয়ে থাকলেও নোংরা গরম পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয় নেতাকর্মীদের, কি পুরুষ বা মহিলা নেতৃবৃন্দকে সাদা পোশাকধারীরা ধরে আনে পার্টি অফিসের ভিতর থেকে। কেন এসব করা হচ্ছে? তার উত্তর, পুলিশের অনুমতি ছাড়া রাজনৈতিক দল কোন কর্মসূচি পালন করতে পারবে না। তবে এ আইন সরকারি দলের জন্য প্রযোজ্য নয় বরং কঠোরভাবে বিরোধী দলের জন্য প্রযোজ্য। কার্যত স্বীকৃতভাবেই এ দেশে আইন দু’ভাগে প্রয়োগ হয়। সরকারি দলের জন্য আইন একভাবে এবং বিরোধী দলের জন্য প্রয়োগ হয় ভিন্নভাবে এবং কঠোরভাবে। এ দেশে আইন প্রয়োগকারীরা বিরোধী দলের কর্মসূচিতে গ্রেফতার, লাঠি পেটা, গরম পানি ও কাঁদানি গ্যাস নিক্ষেপ করে। অন্যদিকে একই কর্মসূচির জন্য সরকারি দলকে পুলিশ পাহারায় দেয়া হচ্ছে পূর্ণ নিরাপত্তা।
পুলিশ এটা প্রমাণ করেছে যে, ন্যায়-অন্যায় যাই হোক না কেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশ পালন করাই তাদের চাকরির মূল শর্ত। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মনে করেন যে, নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার যাই হোক না কেন যাদের হাতে ঊর্ধ্বতনদের প্রমোশন ও লোভনীয় পদে পোস্টিং তাদের খুশী রাখাই তাদের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে তারা ডান বাম চিন্তা করেন না। নৈতিকতা বোধ, আর্দশিক কোন চিন্তাধারা বা স্বাধীনদেশের একজন নাগরিকের সাথে পরাধীন নাগরিক বা প্রাগৈতিহাসিক যুগের দাসদাসীদের মতো ব্যবহার করার সময় তাদের মন মানসিকতা ও বিবেক একটুও নাড়া দেয় না। বরং কী করলে প্রমোশন ও লোভনীয় পোস্টিং (অর্থাৎ যে পোস্টিংয়ে ভাগ্যের চাকা খুলে যায়) সে দিকেই জনগণের অর্থে লালিত পুলিশসহ সকল রাষ্ট্রীয় বেতনভুখ কর্মকর্তাদের মনোযোগ বেশি। বিচারবিভাগের কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেগণের ক্ষেত্রেও এটা লক্ষ করা যায়। সাংধানিকভাবে বিচারিক সিদ্ধান্ত প্রদানে তারা ‘স্বাধীন’। এ মর্মে ১৯৭৫ সনের ২নং আইনের ২০ ধারা বলে সংবিধান সংশোধন করে অনুচ্ছেদ ১১৬ক সংবিধানে সন্নিবেসিত করা হয়। ১১৬ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।’ বাস্তবে ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবের নির্দেশে অথবা নিজেরাই দলবাজী করেন, এ বিষয়টি তাদের কর্মকান্ডে তারা নিজেরাই প্রমাণ করেছেন। রাজনৈতিক মিথ্যা মোকদ্দমাগুলিতে এজাহারে বর্ণিত ঘটনার সাথে মামলার সংযুক্ত ধারায় কোন সংগতি থাকে না। সে বিষয়গুলিও ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিবেচনায় নেন না, ফলে পুলিশের দেয়া ধারাই শিরোধার্য। ঘটনার সাথে সত্যতার লেশমাত্র থাকুক বা না থাকুক ‘আকাশের যত তারা পুলিশের তত ধারা’ প্রতিবাদ্য হিসেবে পুলিশ যে ধারা সন্নিবেশিত করে সে ধারার উপর ম্যাজিস্ট্রেটগণ নির্ভর করে বিচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মূলতঃ বিচারিক ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটদের চেয়ে পুলিশ শক্তিশালী। বিচারকদের আমরা ণড়ঁৎ ঐড়হড়ঁৎ বলে সম্বোধন ও মাথা ঝুঁকিয়ে শ্রদ্ধা করি এ জন্য যে, বিচারকগণ সকল প্রকারের রাগ, অনুরাগ, ভয়ভীতি, লোভলালসার ঊর্ধ্বে উঠে বিচার প্রার্থীর প্রতি ন্যায়বিচার করবেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটতে দেখা যায়। এ জন্যই সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেছেন যে, ‘নিম্ন আদালত মানেই আইন মন্ত্রণালয়’। আইন মন্ত্রণালয় অর্থাৎ মন্ত্রী ও সচিবের ইচ্ছার প্রতিফলন।
নব নিযুক্ত পুলিশ প্রধান ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী সম্প্রতি চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে এক বক্তৃতায় বলেছেন যে, ‘জনগণের কাছে পুলিশ বাহিনীর জবাবদিহিতায় পুলিশ ও জনগণের দূরত্ব কমে আসবে।’ তিনি একটি মূল্যবান কথা বলেছেন যাতে করে পুলিশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল হবে। পুলিশ প্রধানকে তার উপলব্ধির জন্য ধন্যবাদ জানাই। পুলিশের সাথে জনগণের দূরত্ব রয়েছে এ উপলব্ধি থেকেই তিনি নিশ্চয় এ কথা বলেছেন। তবে তার এ বক্তব্য কি আন্তরিক না লিপ সার্ভিস, এটা তার কর্মকান্ড থেকেই জনগণ উপলদ্ধি করতে পারা যাবে। তিনি যোগদানের পর থেকে দেশব্যাপী প্রতিটি থানায় বিএনপি নেতাকর্মীদের সিরিজ মোকদ্দমা দেয়া হয়েছে। কোন কোন এজাহারে এক আসামীর নাম দু’বার, বিদেশে অবস্থানরত নেতাকর্মী, এমন কি মৃত ব্যক্তির নামেও এজাহার দেয়া হয়েছে। এজাহারের ধরন থেকে মনে হয়, একই ফরমেট অনুসরণ করে মামলাগুলি সৃজন করা হয়েছে। প্রতিয়মান হয় যে, একই স্থান থেকে এজাহারের নমুনা তৈরি করে দেয়া হয়েছে। সবগুলি মামলার বিষয়বস্তু ‘খালেদা জিয়ার রায়কে প্রভাবিত করার জন্য নাশকতার পরিকল্পনা।’ এ লেখকও এমন মামলা থেকে রেহায় পায়নি। ২০১৫ সালের এক নাশকতা মামলায় গত ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলখানায় অন্তরীন হয়ে ২ দিন পর ২৫ জানুয়ারি হাইকোর্টের নির্দেশে জামিনপ্রাপ্ত হই। চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় জানতে পারলাম যে, বিএনপি চেয়ারপার্সন ৫ ফেব্রুয়ারি সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জেয়ারতে যাবেন এবং পূর্বাপরের মতো তাকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুতি নেয়ার সময়ই খবর পেলাম যে, নারায়ণগঞ্জ থানার মামলা নং-১৩ তাং-০৪/২/২০১৮ ধারা ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫(৩) তৎসহ বিস্ফোরক উপাদানাবলী আইন ১৯০৮ সালের ৩(ক) ধারায় মামলা রুজু হয়েছে যার বিবরণে এ নিবন্ধের লেখকসহ নামধারী ৩৪ জন এবং অজ্ঞাত ১০/১৫ জনকে আসামী করে মামলা রুজু করা হয়েছে; যার এজাহারে বলা হয়েছে যে, ‘সন্ত্রাসীরা/দূষ্কৃতিকারীরা সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে রেলপথ, সড়ক পথ, নৌপথসমূহ অচল, মিল কারখানার উৎপাদন বন্ধ করিয়া দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য মিলিত হইয়াছিল। উক্ত আসামীরা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করিয়া নারায়ণগঞ্জ জেলাকে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করার মানসে গোপনে পরিকল্পনা করিতেছিল। উক্ত আসামীরা বর্তমান সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে রেলপথ, সড়ক পথ, নৌপথসমূহ অচল, মিল কারখানার উৎপাদন বন্ধ করিয়া দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে এইরূপ গোপন বৈঠক করিয়া ও পুলিশের উপর ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটাইয়া পালাইয়া যাওয়ার সময় অফিসার ফোর্সদের সহায়তায় উপরোক্ত ১নং আসামীকে ধৃত করা হয়। আমি ঘটনাস্থল হইতে ১৭-০০ ঘটিকার সময় (ক) ০২টি পুরাতন ভাঙা জদ্দার কৌটা, লাল রংয়ের স্কচটেপের টুকরা জব্দ করি। জব্দ তালিকায় সাক্ষীদের স্বাক্ষর নিই এবং আমি নিজেও স্বাক্ষর করি। ধৃত আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদে সে উপরোক্ত নাম-ঠিকানা প্রকাশ করে। উক্ত আসামীরা সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে রেলপথ, সড়ক পথ, নৌপথসমূহ অচল, মিল কারখানার উৎপাদন বন্ধ করিয়া দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য এইরূপ গোপনে বৈঠক করাসহ পুলিশের উপর ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটাইয়া ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫(৩) তৎসহ বিষ্ফোরক উপাদানাবলী আইন, ১৯০৮ সালের এর ৩-ক ধারার অপরাধ করিয়াছে।’
এজাহার অনুযায়ী কথিত ঘটনার সময় ৪ ফেব্রয়ারি ২০১৮ বিকাল অনুমান ১৬-৪০ মিনিট, জব্দ তালিকা প্রস্তুত করার সময় ১৭-০০ ঘটিকা এবং মামলা রেকর্ড করার সময় ১৭-৪৫ মিনিট অর্থাৎ ১-০৫ ঘটিকার মধ্যে ঘটনা, গ্রেফতার, জব্দ তালিকা প্রস্তুত এবং এজাহার দায়ের করা হয়েছে ১-০৫ মিনিট সময়ের মধ্যে। এজাহারটি কম্পিউটারইজইড করা। আসামীদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করে ১-০৫ ঘটিকার মধ্যে এজাহার কম্পিউটার করে এজাহার দায়ের সম্পন্ন করা কি সম্ভব? এ শুধু নারায়ণগঞ্জ থানার ঘটনা নয়, ৮ ফেব্রয়ারি ২০১৮ তারিখে খালেদা জিয়ার রায়কে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সকল থানায় ২ ব্রেয়ারি ২০১৮ থেকে ৮ ফেব্রয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত সিরিজ মোকদ্দমা সৃজন হয়েছে।
কান্না ও মায়া কান্নার তফাৎ মানুষ বোঝে। সমাজে বাহবা পাওয়ার জন্য অনেকেই অনেক কথা বলে যা শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু কার্যকর না হলে বক্তার প্রতি অবিশ্বাস বেড়ে যায়। রাজনীতি চর্চা করায় সাংবিধানিক অধিকার যখন পুলিশ আইনী দোহাই দিয়ে তখনই কেড়ে নেয় যখন সরকার সংবিধানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে রাষ্ট্র শাসন করে। রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের জন্য সাংবিধানিক অনুমতি লাগবে কেন? সরকারি দলের কোন রাজনৈতিক কর্মকান্ডে তো পুলিশের অনুমতি লাগে না, তবে বিরোধী দলের জন্য তা লাগবে কেন?
জনগণের অর্থে লালিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণের কাজে ও কথায় যদি সমন্বয় থাকে তবে জনগণের মনে অবশ্যই স্বস্তি ফিরে আসবে। জনগণ আশার আলো দেখতে পাবে, স্বাধীনতার সুফল গণমানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছবে। মানুষ বুঝতে পারবে বৈদেশিক শত্ররা নয় বরং দেশের সন্তানরা আমাদের শাসক নয় বরং সেবক হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু লিপ সার্ভিস অর্থাৎ মনের নয় বরং ঠোঁটের কথার জন্য মানুষের বিশ্বাস রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উপর থেকে উঠে যাচ্ছে।
লেখক : কলামিস্ট ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।