Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঐতিহাসিক মদীনা সনদ

| প্রকাশের সময় : ১৯ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

কে. এস. সিদ্দিকী: মানবতার সার্বিক কল্যাণে এযাবত অসংখ্য শান্তিচুক্তি হয়েছে। সেগুলো কখনো কোথাও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সুফল বয়ে আনতে সক্ষম হয়নি। ইহুদী-খৃষ্ঠানসহ বিভিন্ন জাতির সাথে অন্যান্য জাতির চুক্তি-অঙ্গীকারনামা সম্পাদিত হয়েছে হাজারে হাজারে। কোনাটির স্থায়িত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ওদের সাথে মুসলমানদের সম্পাদিত চুক্তির সংখ্যাও বিপুল। কিন্তু সকল চুক্তি প্রতিপক্ষের তরফে ভঙ্গ করা হয়েছে। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় সম্পাদিত সকল চুক্তি অহরহ ইসরাইলই ভঙ্গ করে আসছে। মধ্য প্রাচ্যের বুকে বৃহত্তর ইসরাইলী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর ইহুদীদের চুক্তি ভঙ্গের প্রতারণার সুদীর্ঘ ইতিহাস সকলের জানা। ইসলামের শুরু থেকে আজতক মুসলমানদের সাথে সম্পাদিত সকল চুক্তি ভঙ্গের প্রধান নায়ক ইহুদীরাই।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ইসলামের সূচনাকালে মদীনা ছিল ইহুদীদের অন্যতম প্রধান আবাসকেন্দ্র। সেখানে তিনটি প্রধান ইহুদী গোষ্ঠীর বসবাস ছিল। এরা হলো বনি নজির, বনি কোরায়জা এবং বনি কায়নুকা এবং তাদেরই একটি সম্প্রদায় ছিল মোনাফেক বা কপট বিশ্বাসী। ইহুদীরা মক্কার মুসলমানদের বিরুদ্ধে মক্কার পৌত্তলিক কাফেরদের গোপনে উত্তেজিত করতো। যুদ্ধের জন্য উস্কে দিতো এবং কাফের নেতৃবর্গ ইহুদীদের পরামর্শ গ্রহণ করতো। মক্কার মুসলমানদের বিরুদ্ধে মদীনার ইহুদী কপট বিশ্বাসী এবং মক্কার পৌত্তলিক কাফেরদের যোগসাজশ, চক্রান্ত ইতিহাসের এক ঘৃন্যতম অধ্যায়।
বিশ^নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) মদীনায় হিজরত করার পর সেখানকার আনসার ও ইহুদী সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। যাকে ‘সহিফা’ বা সনদ নামে অভিহিত করা হয়। সাধারণত যা ‘মীসাক মদীনা’- ‘মদীনা চুক্তি’ নামে পরিচিত। ৫২ বা ৫৩ দফা সংবলিত বিশে^র এই প্রথম লিখিত সনদের প্রথম ২৫টি দফা মুসলমান ও আরব সম্প্রদায় সংক্রান্ত এবং শেষ ২৭টি দফায় ইহুদী সম্প্রদায়ের অধিকার ও দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। মদীনায় আনসারদের পর ইহুদীরাই ছিল বৃহৎ শক্তি। এই ঐতিহাসিক সনদ বিশের প্রথম লিখিত সাংবিধানিক দলিলরূপে স্বীকৃত। হিজরতের পরপরই এটি সম্পাদন করা হয়। উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার হিজরত করে মদীনায় উপনীত হয়েছিলেন, খৃষ্টাব্দ অনুযায়ী এটি ছিল ৬২২ সাল। তবে তারিখ নিয়ে তিনটি মতের কথা গবেষক ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন ২২, ২৪ ও ২৯ সেপ্টেম্বর। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশে ১৯৯৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড মুসলিম কালচারাল সোসাইটি বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ‘মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর মদীনায় হিজরতের ১৩৭৬তম বার্ষিকী স্মরণে ঐতিহসিক মদীনা দিবস উপলক্ষে একটি সেমিনারের আয়োজন করে। জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সেমিনার উপলক্ষে প্রকাশিত পুস্তিকায় কিতাবুর রাসূল বা মদীনা সনদের মূল পাঠ আরবী, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় সংযোজিত হয়। কালচারাল সোসাইটির ঐতিহাসিক মদীনা দিবস উদযাপনের ঘটনা সম্ভবত মুসলিম বিশে^র বাংলাদেশই প্রথম। আমরা সেই পুস্তিকা হতে মূল পাঠের বাংলা তরজমা নিম্নে সংকলিত করছি।
বিশ^নবী মোহাম্মদ (সা.) পিতৃভ‚মি মক্কা নগরী ছেড়ে মাতুলালয় ইয়াসরিবে পৌঁছেন। এটা ১২ রবিউল, ২৪ সেপ্টেম্বর ৬২২ সালের ঘটনা। সোমবার দ্বিপ্রহরের সময় তিনি ইয়াসরিবের কুবায় পৌঁছেন। ইয়াসরিবের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা তাঁকে আবেগঘন পরিবেশে স্বাগত জানান, করে নেন আপন। জনার্কীণ সংবর্ধনা সভায় ইয়াসরিববাসী নবী করীম (সা.) এর ঐতিহাসিক আগমনকে স্মৃতিবহ করে রাখার জন্য তাদের লালিত ইয়াসরিবের নামকরণ করেন ‘মদীনাতুন্নবী’ বা ‘মদীনাতুর রসূল।’ পরবর্তীতে এ নগরীই ‘মদীনা’ নাম ধারণ করে রাষ্ট্রের রাজধানীতে রূপান্তরিত হয়। এর বক্ষেই নির্মিত হয় মসজিদে নববী। এটিই ছিলো এ রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ভবন, সংসদ ভবন, সুপ্রীম কোর্ট। নবী করীম (সা.) মদীনায় পৌঁছার পর দেখেন এখানে তিন শ্রেণীর লোকের নিবাস রয়েছে। ১. মদীনার আদিম পৌত্তলিক সম্প্রদায়, ২. বিদেশী ইহুদী সম্প্রদায়, ৩. নব বায়আত প্রাপ্ত মুসলিম সম্প্রদায়। এদের আদর্শগত মিল ছিলো না, এছাড়া ছিলো গোষ্ঠীগত হিংসা-বিদ্বেষপূর্ণ মানসিকতার, তাই নবী করীম (সা.) একটি সংবিধান বা চুক্তি প্রণয়ন করেন। চুক্তিটি নিম্বরূপ:
আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি যিনি পরম করুণাময় এবং পরম দয়ালু। আল্লাহর নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক জারিকৃত এটি লিখিত কিতাব বা চুক্তি কুরাইশ এবং ইয়াসরিবের মু’মিন, মুসলিম আর যারা তাদের অনুসরণ করে তাদের পর্যায়ভুক্ত হবে এবং তাদের সাথে জিহাদে অংশগ্রহণ করবে।
১. তারা আর সব লোকের থেকে স্বতন্ত্র একটি উম্মাহ বা জাতি।
২. কুরাইশের মুহাজিরগণ পূর্ব প্রথানুযায়ী তাদের পরস্পরের মধ্যকার রক্তপণ প্রদান করবে। আর মু’মিন-মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত নিয়ম এবং ন্যায়-নীতির নিরিখে মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের বন্দীদের মুক্ত করবে।
৩. বনূ আউফ পূর্ব প্রথানুযায়ী তাদের সদস্যদের জন্য তাদের প্রদত্ত পূর্ব হারে রক্তপণ আদায় করবে, আর প্রতিটি গোত্র মু’মিনদের মধ্যে প্রচলিত নিয়ম-নীতি এবং ন্যায় বিচার ও আদল-ইনসাফের ভিত্তিতে মুক্তিপণের সাহায্যে বন্দীদের মুক্ত করবে।
৪. বনূ সা’ইদা পূর্ব প্রথানুযায়ী সদস্যদের জন্য তাদের পূর্ব হারে রক্তপণ প্রদান করবে, আর প্রতিটি গোত্র মু’মিনের মধ্যে উত্তম পন্থা এবং ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে মুক্তিপণের সাহায্যে বন্দীদের মুক্ত করবে।
৫. বনূ হারিস পূর্ব প্রথানুযায়ী সদস্যদের জন্য তাদের প্রদত্ত পূর্ব হারে রক্তপণ প্রদান করবে, আর প্রতিটি গোত্র মু’মিনের মধ্যে উত্তম পন্থা এবং ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে মুক্তিপণের সাহায্যে বন্দীদের মুক্ত করবে।
৬. বনূ জুশাম পূর্ব প্রথানুযায়ী সদস্যদের জন্য তাদের প্রদত্ত পূর্ব হারে রক্তের মূল্য দেবে, আর প্রতিটি গোত্র মু’মিনদের মধ্যে প্রচলিত কল্যাণকর এবং ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে মুক্তিপণ প্রদানের মাধ্যমে বন্দীদের মুক্ত করবে।
৭. বনূ নাজ্জার পূর্ব প্রথানুযায়ী সদস্যদের জন্য তাদের প্রদত্ত পূর্ব হারে রক্তের মূল্য প্রদান করবে, আর অন্যসব গোত্র মু’মিনদের মধ্যে কল্যাণকর এবং ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে মূল্য পরিশোধ করে বন্দীদের মুক্ত করবে।
৮. বনূ আমর ইবন আউফ পূর্ব প্রথানুযায়ী সদস্যদের জন্য তাদের রক্তের মূল্য পূর্ব হারে প্রদান করবে, আর প্রতিটি গোত্র মু’মিনদের মধ্যে কল্যাণকর এবং ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে মূল্য পরিশোধ করে বন্দীদের মুক্ত করবে।
৯. বনূ নবীত [আননবীত] পূর্ব প্রথানুযায়ী সদস্যদের জন্য তাদের প্রদত্ত পূর্ব হারে রক্তের মূল্য দেবে, আর প্রতিটি গ্রোত্র মু’মিনদের মধ্যে প্রচলিত কল্যাণকর এবং ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে মূল্য দিয়ে বন্দীদের মুক্ত করবে।
১০. বনূ আউস (আল আউস) পূর্ব প্রথানুযায়ী সদস্যদের জন্য তাদের প্রদত্ত পূর্ব হারে রক্তপণ আদায় করবে, আর তাদের প্রতিটি দল মু’মিনদের মধ্যে প্রচলিত নিয়ম-নীতি এবং ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে রক্তপণের মাধ্যমে বন্দীদের মুক্ত করবে।
১১. মু’মিনরা নিজেদের ঋণগ্রস্ত/অভাবগ্রস্ত কাউকেই পরিত্যাগ করবে না এবং মুক্তিপণ ও রক্তপণ আদায়ের জন্য তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে।
১২. কোন মু’মিনই অন্য মু’মিনের আশ্রিত ব্যক্তির সাথে (মাওলা) বন্ধুত্ব স্থাপন করবে না তাকে (আশ্রয়দাতা) বাদ দিয়ে।
১৩. খোদাভীরু (মুত্তাকী) মু’মিনগণের মধ্যে থেকে কেউ বিদ্রোহী হলে তার বিপক্ষে থাকবে অথবা কেউ মু’মিনদের মধ্যে থেকে অত্যাচার, পাপাচার, শত্রুতা বা ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করতে চাইলে সে তাদের মধ্যে থেকে কারো সন্তান হলেও তারা সম্মিলিতভাবেই তার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
১৪. এক মু’মিন অন্য মু’মিনকে কোন কাফিরের জন্য হত্যা করবে না। আর কোন মু’মিনের বিরুদ্ধে কাফিরকে সাহায্যও করবে না।
১৫. আল্লাহ প্রদত্ত জিম্মা বা নিরাপত্তা একটিই। অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে সর্বাপেক্ষা দুর্বলকেই আশ্রয় দেয়া হবে। অন্যান্য লোক ব্যতীত মু’মিনগণ পরস্পর বন্ধু।
১৬. ইহুদীদের মধ্য থেকে যারা আমাদের অনুসরণ করবে তাদের জন্য সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা হবে। আর তাদের সাথে করা হবে সদাচরণ। তাদের উপর অত্যাচার-নিপীড়ন তো হবেই না। অধিকন্তু তাদের শত্রুদেরও সাহায্য করা হবে না।
১৭. মু’মিনদের একটিই মাত্র চুক্তি। কোন মু’মিন অন্য মু’মিন ব্যতীত আল্লাহর রাহে জিহাদ করার লক্ষ্যে চুক্তি করবে না। ঐ চুক্তি যতক্ষণ না সমতা এবং ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে সম্পাদিত হবে।
১৮. আমাদের সাথী হয়ে যুদ্ধ করবে। এমন প্রতিটি সেনা দল পরস্পরানুসারে একে অন্যের পেছনে থাকবে।
১৯. আল্লাহর রাহে দেয়া রক্তের প্রতিশোধ নেয়ার অদম্য স্পৃহায় মু’মিনগণ পরস্পর সাহায্য করবে।
২০. মুত্তাকী বা খোদাভীরু মু’মিনগণই সর্বোত্তম এবং সঠিক হিদায়েতের উপর প্রতিষ্ঠিত।
২১. কোন মুশরিকই কুরাইশদের জান অথবা মালের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে না বা মু’মিনের বিরুদ্ধে কোন কুরাইশের পক্ষাবলম্বন করবে না।
২২. কোন মু’মিনকে কেউ অন্যায়ভাবে হত্যা করলে এবং তা প্রমাণিত হলে প্রতিদানে তাকেও হত্যা করা হবে। তবে হ্যাঁ নিহত ব্যক্তির ওলী বা উত্তরাধিকারী যদি রক্তপণ গ্রহণে সন্তুষ্ট হয় সেটা ভিন্ন কথা।
২৩. এ সহীফায় সন্নিবেশিত বিষয়ে ঐকমত্য পোষণকারী এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ^াস স্থাপনকারী কোন মু’মিনের জন্যই কোন অন্যায়কারীকে সাহায্য করা বা আশ্রয় দেয়া বৈধ হবে না। কেউ এমন লোককে সাহায্য বা আশ্রয় প্রদান করলে তার উপর আল্লাহর লা’নত এবং গজব আপতিত হবে। তার কাছ থেকে কোন বিনিময় এবং বদলা গ্রহণ করা হবে না।
২৪. তোমাদের মধ্যে কখনো কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে একমাত্র আল্লাহ এবং মোহাম্মদ (সা.) এর দিকে (মীমাংসার) প্রত্যাবর্তন করবে।
২৫. যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইহুদীরা মু’মিনদের সাথে যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ করবে।
২৬. বনূ আউফের ইহুদীরা মু’মিনদের সাথে একই উম্মাহ। ইহুদীদের জন্য তাদের ধর্ম আর মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম, তাদের মাওয়ালী বা আশ্রিত এবং তারা নিজেরাও। অবশ্য, যে-ই অন্যায় বা অপরাধ করবে, সে নিজের এবং তার পরিবার-পরিজনের ক্ষতিই করবে।
২৭. বনূ নাজ্জারের ইহুদীরাও বনূ আউফের ইহুদীদের মতোই।
২৮. বনূ হারিসের ইহুদীরাও বনূ আউফের ইহুদীদের মতোই।
২৯. বনূ সা’ইদার ইহুদীরাও বনূ আউফের ইহুদীদের মতোই।
৩০. বনূ জুশামের ইহুদীরাও বনূ আউফের ইহুদীদের মতোই।
৩১. বনূ আউসের ইহুদীরাও বনূ আউফের ইহুদীদের মতোই।
৩২. বনূ সালাবার ইহুদীরাও বনূ আউফের ইহুদীদের মতোই। অবশ্য, যে অত্যাচার করবে আর বিশ^াসঘাতকতা করবে, সে নিজের এবং পরিবার-পরিজনের জন্য ক্ষতিসাধন করবে।
৩৩. বনূ সালাবার শাখাগোত্র জাফনার ইহুদীরাও বনূ সালাবারই অনুরূপ।
৩৪. বনূ ওতাইবার ইহুদীরাও বনূ আউফের ইহুদীদের মতোই। পাপাচার নয়, পুণ্যই কাম্য।
৩৫. বনূ সালাবার মাওয়ালী বা আশ্রিত ব্যক্তিবর্গ তাদেরই মতো।
৩৬. ইহুদীদের বন্ধুরাও (চুক্তিবদ্ধ) তাদের মতোই।
৩৭. মোহাম্মদ (সা.) এর অনুমতি ছাড়া তাদের কেউই যুদ্ধের জন্য বেরুবে না।
৩৮. কারো ক্ষতির প্রতিশোধ নেয়ার লক্ষ্যে কাউকেই বাধা দেয়া হবে না। কেউ হঠকারিতা প্রদর্শন করলে সে নিজে এবং তার পরিবারই হবে দায়ী। তবে হ্যাঁ, কেউ অত্যাচারিত হলে তার জন্য এটা প্রযোজ্য নয়। এ চুক্তিনামায় যা আছে, তার সর্বাধিক হিফাজতকারী একমাত্র আল্লাহ।
৩৯. ইহুদী এবং মুসলমানগণ নিজ নিজ ব্যয় নির্বাহ করবে।
৪০. এ সহীফা বা দলিল গ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করবে, তাদের বিরুদ্ধে তারা সম্মিলিতভাবে পরস্পরকে সাহায্য করবে। পরস্পরকে সদুপদেশ এবং কল্যাণকর কাজেই তারা সাহায্য করবে, পাপ কাজে নয়।
৪১. বন্ধুর দুষ্কর্মের জন্য কেউই দায়ী হবে না। আর মজলুম বা অত্যাচারিতকে করা হবে সাহায্য।
৪২. যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইহুদীরা মু’মিনদের সাথে যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ করবে।
৪৩. সহীফায় অঙ্গীকারবদ্ধদের জন্য ইয়াসরিবের উপত্যকা পবিত্র।
৪৪. আশ্রিতরা আশ্রয়দানকারীদের নিজেদের মতোই, যে পর্যন্ত তারা কোন অন্যায় বা বিশ^াসঘাতকতা না করে।
৪৫. কোন নারীকে তার গোত্রের বা পরিবারের অনুমতি ছাড়া আশ্রয় দেয়া যাবে না।
৪৬. এ সহীফায় অঙ্গীকারবদ্ধ গোত্রের মধ্যে শান্তি বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে- এমন কোন ঘটনা ঘটলে আল্লাহ এবং রাসূল মোহাম্মদ (সা.) এর কাছে (মীমাংসার জন্য) সমর্পণ করতে হবে। এ সহীফায় যা আছে তা রক্ষার ও পূর্ণতা দানের জন্য আল্লাহই সর্বোত্তম রক্ষক।
৪৭. কুরাইশ বা তাদের সাহায্যকারীদের আশ্রয় দেয়া যাবে না।
৪৮. ইয়াসরিবের উপর অতর্কিত হামলাকারীদের বিরুদ্ধে তারা একে অন্যকে সাহায্য করবে।
৪৯. তাদেরকে যে কোন চুক্তি করার আহবান জানানো হলে চুক্তি করবে এবং মেনে চলবে। মু’মিনদেরকে চুক্তি করার আহবান জানালে, তারাও অনুরূপই করবে।
৫০. প্রতিটি মানুষই স্বপক্ষের কাছ থেকে তার প্রাপ্য অংশ পাবে।
৫১. বনূ আউসের ইহুদীরা তাদের মাওয়ালী এবং তারা নিজেরা এ সহীফার শরীক দলের মতোই হবে। তারা সহীফার শরীক দলের ন্যায় সম্মানজনক আচরণ করবে।
[ইবনে হিশাম বলেন: কারো কারো মতে, এই ধারা-এর স্থলে হবে, এর অর্থ হচ্ছে অধিকতর সম্মানজনক।] ইবনে ইসহাক বলেন: কারো কারো মতে এ অংশ হবে নিম্নরূপ: ‘বিশ^স্ততাই কাম্য, বিশাসঘাতকতা নয়। যে এটা আয়ত্ত করে, সে নিজের জন্যই করে। এ সহীফায় যা রয়েছে, আল্লাহই তার সত্যতার সাক্ষী এবং রক্ষাকারী।’
৫২. এ কিতাব বাস্তবায়নে অত্যাচারী এবং পাপী ছাড়া কেউই বাধা প্রদান করবে না। যে-ই যুদ্ধের জন্য বেরুবে আর যে-ই মদীনায় থাকবে। সবাই থাকবে শান্তিতে। যারা অত্যাচার করবে এবং বিশ্বাসঘাতকতা করবে একমাত্র তারা ব্যতীত।
৫৩. আল্লাহই সৎ ও ধর্মভীরুদের রক্ষাকারী বা আশ্রয়দাতা। আর মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসূল।
ইতিহাস সাক্ষ্য বহন করে যে, মদীনায় বসবাসরত তদানীন্তন তিন শ্রেণীর জনগোষ্ঠির প্রতি এ লিখিত দলিল জারি করা হয়েছে: ১. কুরাইশ (মুহাজির) এবং ইয়াসরিবের (আনসার) মু’মিন ও মুসলিমগণ, ২. যারা তাদের অনুসরণ করবে, ৩। সঙ্গে বা পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে।
মানব ইতিহাসের শুরু থেকে ৬ষ্ঠ শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত সময়কালে মানবাধিকার আদায়ের সংগ্রামের কোন ধারাবাহিক ইতিহাস জানা যায় না। তদানীন্তন সময়ে বিশে^র সরকার তথা শাসন পদ্ধতি ছিলো ব্যক্তি কেন্দ্রিক। বিধিবদ্ধ শাসনতন্ত্র ছিলো না বিধায় তৎকালীন শাসকদের খেয়াল-খুশীমতো মুখোচ্চারিত বাণীই ছিলো রাষ্ট্রের আইন। কাজেই, সেখানে জনস্বার্থের পরিপন্থী শাসকের যথেচ্ছারের অবকাশ থাকাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু, সপ্তম শতকে নবী করীম (সা.) বিশ^বাসীর সামনে নতুন আশা, নতুন আকাঙ্খার বাণী নিয়ে হাজির হন। তিনি বিশ^াস করতেন, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ঐক্য এবং সম্প্রীতি না থাকলে দেশের কল্যাণ সাধিত হতে পারে না। তাঁর মতে, যে দেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর বাস, সে দেশে পরমতসহিষ্ণুতার প্রয়োজন। ‘নিজে বাঁচ এবং অন্যকে বাঁচতে দাও’ নাগরিক জীবনে এ নীতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করেই নবী করীম (সা.) বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দকে আহবান করে বৈঠকে বসে সর্বসম্মতিক্রমে এ লিখিত দলিলে স্বাক্ষর করেন। এটাই ঈযধৎঃবৎ ড়ভ সধফরহধ নামে জগদ্বিখ্যাত দলিল।
ঐতিহাসিক মদীনা সনদের ধারা বা দফাগুলো সকলের সামনে। আধুনিক যুগের লেখক, গবেষক এবং বিশ্লেষকগণ এই সনদকে নজরে রেখে নিরপেক্ষ মূল্যায়ণ করে বলেছেন যে, বিশে^র লিখিত দলিলগুলোর মধ্যে মদীনা সনদ সর্বশ্রেষ্ঠ। কিন্তু ইহুদীরা বিশাসঘাকতা বশত এ সনদ বা চুক্তি ভঙ্গ করে এবং মক্কার পৌত্তলিক কাফেরদের সঙ্গে মিলে যায় এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় ও মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে এমনকি খোদ রসূলুল্লাহ (সা.) কে হত্যার ঘৃন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। পরিণতিতে তারা মদীনা হতে বহিষ্কৃত হয় এবং বলা হয়, ‘আখরিজুল ইহুদা মিন জাজিরাতিল আরব।’ অর্থাৎ ‘ইহুদীদের আরব ভ‚খন্ড হতে বহিষ্কার করো।’ আরব মুসলমানগণ যারা পরাশক্তি বর্গের লেজুড় বৃত্তিতে লিপ্ত, তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুললে ইসলাইলের আগ্রাসী তৎপরতা প্রতিহত করে তাদেরকে আরব ভ‚খন্ড হতে বিতাড়িত করা কঠিন নয়, কিন্তু সেই বৃহত্তর আরব-মুসলিম ঐক্য কোথায়?



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঐতিহাসিক

৬ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন