চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
॥ পাঁচ ॥
প্রিয়নবী (সা.) ইরশাদ করেন ঃ “কোন আরবের প্রাধান্য নেই অনারবের উপর, কোন অনারবের প্রাধান্য নেই কৃষ্ণাঙ্গদের উপর, কিংবা কৃষ্ণাদের প্রাধান্য নেই শ্বেতাঙ্গদের উপর। বরং তোমরা সকলে আদমের সন্তান এবং আদমকে সৃষ্টি করা হয় মাটি থেকে। ইসলাম সকল মানুষকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সকলের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠা করেছে, আইনের দৃষ্টিতে পুরোপুরি পক্ষপাতহীন করেছে। চুরির অপরাধে সম্ভ্রান্ত বংশীয় জনৈকা ফাতেমা অভিযুক্ত হলে কয়েকজন সাহাবা নবীজীকে অনুরোধ করলেন সম্ভ্রান্ত বংশের এ মহিলাকে যেন কম শাস্তি প্রদান করা হয়। নবীজী (সা.) এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে সাহাবাদের হুশিয়ার করে দেন, তোমাদের পূর্বে বহু জাতি ধ্বংস হয়েছে এরকম পক্ষপাতমূলক বিচারের জন্য। প্রিয়নবী (সা.) ইরশাদ করেন “আজ যদি আমার মেয়ে ফাতিমাও চুরির অপরাধে অভিযুক্ত হত, আল্লাহর শপথ, আমি তারও হাত কেটে ফেলার নির্দেশ দিতাম। আইনের দৃষ্টিতে সমতার এ বিরল দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তবে ইসলাম অবশ্য একটি মানদন্ডের ভিত্তিতে একে অপরের উপর প্রাধান্যকে স্বীকার করে। প্রিয়নবী (সা.) মানবজাতির সামনে আল্লাহর ফরমান পেশ করেনঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সেই সর্বাধিক সম্মানিত যে সর্বাধিক পরহেজগার।’’ প্রত্যেকের জন্য তাদের কৃতকর্ম অনুযায়ী বিভিন্ন স্তর রয়েছে, যাতে আল্লাহ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিফল দেন। বস্তুত: তাদের প্রতি যুলুম করা হবে না। আইনের দৃষ্টিতে সমতা নীতিটি কার্যকর করার পাশাপাশি একে অপরের উপর প্রাধান্য সম্পর্কিত উল্লেখিত মানদন্ডের মাধ্যমে ইসলাম মূলত: প্রত্যেক মানুষকে সৎকর্মে প্রতিযোগী করে সর্বাঙ্গীণ সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
শুধু জীবনের নিরাপত্তা নয়, বরং মান-মর্যাদার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা হযরত মুহাম্মদ (সা.) প্রদান করেন। মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত-এর মর্যাদা দেয়া হয়েছে। মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি এবং এ মানুষ সম্পর্কে ইসলামের ভাষ্য ঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষকে সর্বোত্তম আদর্শরূপে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের মান-মর্যাদার নিশ্চয়তা প্রদান করতে যেয়ে প্রিয়নবী (সা.) আল্লাহর বাণী পেশ করেন ঃ “হে ঈমানদারগণ! কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে উপহাস না করে। কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর কোন নারীকে যেন উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় উপহাসকারিনী অপেক্ষা সে উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। তোমরা একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের কেউ কি তার আপন মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করতে পছন্দ কর? বস্তুত: তোমরা তা অপছন্দ কর।’
ইসলাম এভাবে সকল মানুষের মান-মর্যাদার নিরাপত্তা প্রদান করছে। উল্লেখ্য, নারীর মান-মর্যাদা সংরক্ষণে ইসলাম এবং তার নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিশেষ যত্নশীল ছিলেন। আল-কুরআনের বানী তিনি পেশ করেন ঃ “যারা সতী-সাধ্বী, নিরীহ ঈমানদার নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারা ইহকাল ও পরকালে ধিকৃত এবং তাদের জন্য রয়েছে গুরুতর শাস্তি।’
‘যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে। রাসূলে করীম (সা.) তার অসংখ্য হাদীসেও মানুষকে অহেতুক মারধর, অবমাননা ও অপমান করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। প্রিয়নবী (সা.) আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগেই সকল মানুষের সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা করা একটি সুশীল সমাজ, আদর্শরাষ্ট্র এবং সৌহার্দময় বিশ্ব গড়ার রূপরেখার বাস্তবায়ন করে গেছেন। আল্লাহর ফরমান তিনি বিশ্ববাসীকে শোনান ঃ “তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ করো না এবং জনগণের সম্পদের কিয়দংশ জেনে-শুনে পাপ পন্থায় আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে শাসন কর্তৃপক্ষের হাতেও তুলে দিও না।’’ নবীজী (সা.) ঘোষণা করেন ঃ “যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ রক্ষা করতে যেয়ে নিহত হয় সে শহীদ’। রাসূলে আকরাম (সা.) মানুষকে মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেন। শধু তাই নয়, ভয়-ভীতি এবং পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে থেকে সত্য প্রকাশ করা মুসলমানদের ঈমানী দায়িত্ব বটে। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে ঃ “আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে।... “আল্লাহ কোন মন্দ বিষয় প্রকাশ পছন্দ করেন না। তবে কারো প্রতি যুলুম হয়ে থাকলে সে কথা আলাদা। আল্লাহ শ্রবণকারী, বিজ্ঞ।’’ নবীজী (সা.) ইরশাদ করেন ঃ “সবচেয়ে সম্মানজনক জেহাদ হল অত্যাচারী শাসকের সমানে সত্য বলা। সুতরাং ইসলাম কেবল মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাই প্রদান করেনি, বরং এটিকে একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হিসেবেও গণ্য করে।
সৎ উদ্দেশ্যে সংগঠিত হওয়ার মৌলিক অধিকার প্রিয়নবী (সা.) প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তবে তা অবশ্যই কোন অসৎ উদ্দেশ্যে হবে না। রাসূলে করীম (সা.) মানবজাতির সামনে আল্লাহর হুঁশিয়ারী পেশ করেন ঃ “আর তাদের মত হয়ো না, যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং নিদর্শনসমূহ আসার পরেও বিরোধিতা করতে শুরু করেছে-তাদের জন্য রয়েছে ভয়ংকর আযাব। হযরত মুহাম্মদ (সা.) সকল মানুষকে এ মৌলিক অধিকারটি প্রদান করেন। আল্লাহর ফরমান তিনি মানবজাতির সামনে পেশ করেন ঃ “তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে সুগম করেছেন, অতএব, তোমরা তার কাঁধে বিচরণ কর এবং তার দেয়া যিকি আহার কর।’’ জাতি-ধর্ম-বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের ন্যায়বিচার লাভের অধিকার রাসূলে করীম (সা.) প্রদান করেন। এক্ষেত্রে কোরআনী বক্তব্যঃ “আর যখন তোমরা মানুষের কোন বিচার মীমাংসা করতে আরম্ভ কর। তখন মীমাংসা কর ন্যায়ভিত্তিক। “আমি (নবী) তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করতে আদিষ্টি হয়েছি।’’ প্রিয়নবী (সা.) প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। ইসলামে আইনের সুস্পষ্ট বিধান ছাড়া কাউকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার, আটক বা বল প্রয়োগ করা নিষেধ এবং একের দায় অন্যের উপর চাপানো অবৈধ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।