চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
জন্ম, মৃত্যু ও রোগ মহান বিধাতার নিয়ন্ত্রিত মহিমা। কে, কখন, কোথায় জন্ম গ্রহণ করবে? কখন, কোথায়, কীভাবে মৃত্যু বরণ করবে? কখন, কোথায়, কীভাবে আক্রান্ত, রোগাক্রান্ত ও অসুস্থ হবে তা কারো ইচ্ছাধীন নয়। এটি একমাত্র বিধাতার বিধান। তারই পরিজ্ঞাত, নিয়ন্ত্রাধীন ও ইচ্ছাধীন। অতএব, যে বিষয়টি মানুষের নিয়ন্ত্রাধীন ও ইচ্ছাধীন নয় তার জন্য বিপদগ্রস্ত, অসুস্থ ও অসহায় ব্যক্তিকে অবমূল্যায়ণ, অবজ্ঞা ও অবহেলা করা যুক্তিযুক্ত নয়। সাদা-কালো, ধনী-গরীব ও সুস্থ-অসুস্থ এগুলো মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির অপার রহস্য ও পরীক্ষা। এখানে মানুষের কোনো হাত নেই। বিনা বাক্যে তা মাথাপেতে নিতে বাধ্য। এজন্য মানুষের মাঝে শ্রেণিবিন্যাস, ভেদাবেদ ও পার্থক্য করা উচিত নয়। শিক্ষা ও চিকিৎসা নাগরিকের মৌলিক অধিকার। উন্নত রাষ্ট্রে এ অধিকার জনগণকে বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। আর উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে তা নামমাত্র মূল্যে প্রদান করা হয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। অপ্রিয় হলেও সত্য স্বাস্থ্যসেবা এখন পরিপূর্ণ বাণিজ্যিকখাতে রূপান্তরিত হয়েগেছে! যা অত্যন্ত দুঃখজনক। নীতি-আদর্শ, সেবার মানসিকতা ও মানবিকতা একেবারে লোপ পেয়েছে। এমনকি সংশ্লিষ্টদের মাইনসেটও কনভারটেড হয়েগেছে। যার জ¦লন্ত প্রমাণ তিনটি হাসপাতাল ঘুরে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রসূতি পারভীনের রাস্তায় সন্তান প্রসব! যা চিকিৎসা খাতের জন্য এক কলঙ্কিত অধ্যায়! এর মাধ্যমে আমাদের স্বাস্থ্যসেবার চিত্র ফুটে উঠেছে। চিকিৎসাখাতকে কালিমা লিপ্ত করেছে। গুটি কয়েক ব্যক্তির জন্য পুরোখাতকে বদনামের গ্লানী বহন করতে হচ্ছে। কথায় বলে বিচারের বাণী নিরবে কাদেঁ। এ রকম অহরহ ঘটনা আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। স্বাস্থ্যসেবা প্রার্থীরা হয়রানীর শিকার হচ্ছে। একতো অসুস্থতার জন্য শারিরিক কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে আবার টাকার অভাবে গরীব ও অসুস্থ মানুষ গুলো স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিপদগ্রস্ত, রোগী ও অসহায় লোকদের জিম্মি করে টাকা আদায় করা তা এখন স্বাস্থ্যসেবার সেবায় পরিণত হয়েছে। গরীব বলে কী তাদের বাচাঁর অধিকার নেই? আশা করি উর্ধ্বতন মহল বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন এবং তদন্ত করে যথাযত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রসূতি পারভীনের এ অপমান কীভাবে সহ্য করবে? এ লজ্জ্বা কোথায় রাখবে? এ গøানী কীভাবে বহন করবে? স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূলনীতি পদে পদে লংঘিত হচ্ছে। যেখানে ধনী রোগীকে হাসপাতাল গুলো স্যার স্যার করে অর্ভ্যথনা জানাতে জানাতে গলার পানি শুকিয়ে ফেলে, সেখানে গরীব রোগীকে সরকারী হাসপাতাল থেকে অর্ধচন্দ্রিমা দিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করতে বাধ্য করা হচ্ছে! এ থেকে স্পষ্ট চিকিৎসা খাতে আমাদের প্রাপ্তি, খ্যাতি ও অর্জন! উদ্বেগের কথা হচ্ছে এ খাতে বেসরকারীভাবে যারা এগিয়ে আসছেন, বিনিয়োগ করছেন, বলা যায় তারাও সেবার মানসিকতা নিয়ে নয় বরং ব্যবসা-বাণিজ্য, টাকা উর্পাজন ও মুনাফার উদ্যেশ্যে বিনিয়োগ করছেন যা অপ্রত্যাশিত, অনভিপ্রেত ও অনাকাক্সক্ষীত। চিকিৎসা খাতকে পুজি করে এক শ্রেণির লোক আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাচ্ছে। চিকিৎসাখাত এখন দেশের প্রধান বাণিজ্যিক খাতে পরিণত হয়েছে। এখাতে অনিয়ম ও প্রতারণা এখন নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার। এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই মনেকরে এটি একটি বাণিজ্যক খাত। টাকা দিবে আর বিনিময়ে স্বাস্থ্যসেবা পাবে। যার টাকা নেই তার স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার নেই। শিক্ষা ও চিকিৎসা যে অমূল্য সম্পদ ও নাগরিক অধিকার তা দাতা ও গ্রহিতা সকলে ভুলতে বসেছে। শিক্ষা ও চিকিৎসার মূল্য ও বিনিময় যে টাকা বা মুদ্রা দিয়ে সম্ভব নয় তা কিন্তু বাস্তব সত্য। এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। যদিওবা টাকার লোভ ও মোহে পড়ে আমরা এ সত্যকে স্বীকার করতে চাই না। আমাদের পাশর্^বর্তী রাষ্ট্র ভারত তাদের চিকিৎসা ও সেবার সাথে যদি আমাদের দেশের চিকিৎসা ও সেবার মান তুলনা করা হয় তাহলে দেখা যায় আমরা কত পিছিয়ে? তাদের চিকিৎসা উন্নত, সেবার মান ভাল, তুলনামূলক খরচও কম। পাশের দেশের সাথে চিকিৎসা খাতে কেনো আমাদের এত দূরত্ব, ব্যবধান ও পার্থক্য? কথায় কথায় আমরা তাদের উপমা দিই কিন্তু চিকিৎসা ক্ষেত্রে কেনো আমরা তাদের অনুসরন ও অনুকরন করি না? তাদের প্রশিক্ষণ ও আদর্শ কোনো আমরা গ্রহণ করি না? কেনো তাদের প্রযুক্তি, গবেষণা ও সেবাগুলো আমরা গ্রহণ করি না? মন্ত্রী-এমপি, উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা বিদেশে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভারতে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। এজন্য তাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসাখাত নিয়ে মাথাব্যথা কম। সমাজের মধ্যমশ্রেণির লোকেরা প্রাইভেট হাসপাতালে আর গরীব ও নিম্ন শ্রেণির লোকেরা সরকারী হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকেন। আর এ যদি হয় দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান তাহলে গরীব ও নিম্ন শ্রেণির লোকগুলো যাবে কোথায়?
মনে রাখা দরকার শিক্ষা ও চিকিৎসা এ দু’টি খাত হচ্ছে পরিপূর্ণ সেবামূলক খাত। যাদের সেবার মানসিকতা আছে তাদেরই এসব খাতে জড়িত হওয়া উচিত। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. জাফর ইকবাল স্যার একটি কথা প্রায় বলে থাকেন, যে ছাত্রের যে বিষয়ে পড়ার আগ্রহ আছে তাকে সে বিষয়ে পড়তে দেয়া অবিভাবকের দায়িত্ব। সেবার মানসিকতা যারা লালন করেন, সেসব মহান ব্যক্তিদের চিকিৎসাখাতে এগিয়ে আসা উচিত। বাণিজ্যিক মনোভাব নিয়ে যারা এ সেক্টরের সাথে যুক্ত হয় তাদের কাছ থেকে সেবা ও মানবিকতা আশা করা অরণ্যে রোদন! সেনাবাহিনীতে লোক নিয়োগের সময় শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি শারিরিক ফিটনেস দেখা হয়। অনুরূপভাবে মেডিকেল সায়েন্সেও ভর্তি প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি মাইন্ডও পরীক্ষা করা উচিত। যাদের জনগণের সেবা করার মত মহৎ ও উদার মানসিকতা আছে তাদেরই কেবল ভর্তির সুযোগ দেয়া উচিত। সেবামূলক মনোভাব ও মানবিকতার আদর্শ যারা লালন করে তাদেরই মেডিকেল সায়েন্সে পড়া উচিত। টাকা উপার্জন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বাণিজ্যিক সেক্টরের অভাব নেই। চিকিৎসা খাতকে একমাত্র উপার্জন খাত মনে করা ভুল। যারা টাকা উপার্জন ও বাণিজ্যিক উদ্যেশ্য নিয়ে চিকিৎসা খাতের সাথে জড়িত হয়, তাদের হাতে এ খাতের উন্নয়ন, উন্নতি ও অগ্রগতি আশা করা যায় না।
আর যারা সেবামূলক মনোভাব ও মানবিকতার মানসিকতা নিয়ে এ সেক্টরে এগিয়ে আসবে তাদের জন্য রয়েছে দু’টি পুরস্কার। একটি ইহকালে অন্যটি পরকালে। হাশরের ময়দানে দায়িত্বশীলদের জবাবদিহি করতে হবে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, “তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর প্রত্যেকেই অবশ্যই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে”- বুখারী ও মুসলিম। সেবা একটি মহানব্রত যা ইসলামের মহান শিক্ষা। হযরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, “ যে মানুষকে দয়া করে না, আল্লাহপাক তাকে দয়া করেন না” -বুখারী ও মুসলিম। জীবে দয়া করে যে জন সেই জন সেবিছে ঈশ^র। মনে রাখতে হবে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নেই’।
মানুষ রোগাক্রান্ত, অসুস্থ ও বিপদে পড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। চিকিৎসক রোগীর প্রতি সমবেদনা না জানিয়ে, উল্টো অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে বাণিজ্য করা মানে মরার ওপর খাড়ার ঘা! তখন অসুস্থ ব্যক্তি ডাক্তারকে বন্ধু না ভেবে বরং অন্য কিছু ভাবতে শুরু করবেন, যা অপ্রত্যাশিত। অপরের দুঃখে যদি আমরা দুঃখিত হতে না পারি, অপরের ব্যথায় যদি ব্যথিত হতে না পারি, মানুষের বিপদে যদি পাশে না দাঁড়াই, তাহলে এত উন্নয়ন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা ও মানবতা সবকিছু বৃথা। স্বাস্থ্যসেবার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে বিনীত অনুরোধ প্লিজ সেবামূলক খাতকে বাণিজ্যিক খাতে পরিণত করবেন না। চিকিৎসকের মত সম্মানী ও মহৎ পেশাকে কলঙ্কিত ও বিতর্কিত করবেন না। কথায় বলে ভোগে সুখ নেই ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বীবিত হয়ে এবং সেবার মহানব্রত ও মানবিকতার উদার মানসিকতা নিয়ে দেশের চিকিৎসাখাত ও সংশ্লিষ্ট মহল এগিয়ে যাবে এ আমাদের প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।