Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ভোগ দখলের পরম্পরা

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৬ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

দূর অতীতের মানব-ইতিহাস, মধ্যযুগের রাজ-ইতিহাস এবং বর্তমান যুগের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনায় আমরা কী দেখতে পাই? দেখতে পাই দখলের লড়াই। এ লড়াইয়ে কোনো পার্থক্য নজরে পড়ে না। সর্বত্র একই ছবি- দখল করো, ভোগ করো। সুদূর অতীতে গুহাবাসীদের জীবনে ছিল সীমানা বা অঞ্চল দখলের জীবন-মরণ লড়াই। পরবর্তীকালে মধ্যযুগে ছিল সম্রাট, শাহানশাহ, রাজা, মহারাজাদের ওই সীমানা বা রাজ্য দখলের লড়াই। যুদ্ধের পর যুদ্ধ। বর্তমান গণতন্ত্রের যুগেও অতীতের সেই একই দখলের ধারা উত্তাল তরঙ্গে বহমান। সেই একই ধারা। নতুন বোতলে পুরনো মদ। এলাকা-অঞ্চল-দেশ মেকি গণতন্ত্রে দখল করো এবং ভোগ করো।
মধ্যযুগের সমাজ জীবনের রাজনৈতিক ইতিহাসের ছবিগুলো লোমহর্ষক, বীভৎস; যা দৃশ্যপটে ভেসে উঠলে চেতনা অসাড় হওয়ার উপক্রম হয়। যেখানে লক্ষ্য করি কত অন্যায়, অত্যাচার-অবিচার, কত অমানবিকতা-পাশবিকতা, কত খুন-জখম। এত নৃশংসতা, এত নির্মমতা, এত নিষ্ঠুরতা কেন? সেখানে লক্ষ করি, নর অপেক্ষা নারীই বেশি লাঞ্চিতা, নির্যাতিতা। মানুষের মধ্যে মানব-হৃদয় খুঁজে পাওয়া বড়ই কঠিন।
মধ্যযুগে লড়াইয়ের মূল লক্ষ্য ছিল রাজ্য দখল, দেশ দখল, সম্পদ দখল, নর-নারী দখল। সে যুগে যাদের দাস-দাসী রূপে ব্যবহার করা হতো, তাদের দুর্ভোগের কোনো সীমা থাকত না। তারা খোয়াড়ে গাদাগাদি করে থাকত। তারা মানুষ হলেও তাদেরকে অন্যান্য জীবের মতোই ব্যবহার করা হতো। জীবদেরও কিছু রেহাই ছিল। দাসীদের মধ্যে যারা সুন্দরী ছিল, তাদের সামান্য রেহাইও মিলত না। তারা ত্রিশ দিনই দিবারাত্র লালসার শিকার হতো। অকালে যখন অকেজো হয়ে যেত, রাস্তার ধারে ফেলে দেওয়া হতো।
এ তো গেল দাস-দাসীদের কথা। রানী বা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলাদেরও নিস্তার ছিল না। পরাজিত রাজা-উজির, সেনাপতি, আমির-উমরাগণের পরমা সুন্দরী স্ত্রী ও কন্যাদের দুর্দশাও একেবারে কম ছিল না। দখলদাররা তাঁদের নিয়ে কী যে রোমহর্ষক রূপে ব্যবহার করতেন, তা কেবল অনুমান করাই শ্রেয়। দেখা যেত, একই মাসে ওই সমস্ত রাজ পরিবারের রমণীদের তিন থেকে পাঁচ বার মালিক পরিবর্তন হতো, যেহেতু তাঁরা দখলদারের দখলীকৃত সম্পদ। এহেন ঘৃণ্য কাজ পশুকেও হার মানায়। মানবতার অপমৃত্যু ও অপমান এর থেকে বেশি আর কী হতে পারে! এখানে একটিই লক্ষ্য সকলের মধ্যে পরিলক্ষিত হতে দেখা যেত, কেবল ‘দখলদারী’। কে কতটা দখল করেছে, করছে ও করবে, এটাই ছিল মূল কথা। অতীতে, মধ্য ও বর্তমান যুগেও সেই একই প্রথা বহমান।
পশু-পাখি, জীব-জন্তু জঙ্গলে জীবনেও লক্ষ্য করা যায়, সেই একই দখলের লড়াই। কেউ কাউকে আপন এলাকা বা অঞ্চল ছাড়তে রাজি নয়। আবার আপন আপন অঞ্চলেও চলে দখলের পর ভোগের লড়াই। কে কাকে ধরবে, মারবে বা খাবে। কে কাকে ভোগ করবে। দিবারাত্রি অহরহ এ লড়াই চলছেই। জঙ্গলের এটাই যেন একমাত্র ধর্ম। যেহেতু তারা পশু ও জানোয়ার, তাদের কোনো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নেই, তাদের বিবেক-বুদ্ধি-জ্ঞান-গরিমা, চিন্তা-চেতনা নেই, তাই ওই দখলিপনায় তারা অপরাধী হয়েও নিরপরাধ। আর এ যুগের বিদ্বান-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিবিদ মানুষের কথা- সে তো অমৃত সমান।
মানুষ নানা কারণে পরাধীন হতে পারে। কিন্তু বিনা কারণে প্রতিটি মানুষের মনটি স্বাধীন। এ কথা মহামানব-মহাপুরুষ, নবি-রসুলগণ বলে গেছেন। ওখানে কেউই লাগাম পরাতে পারে না। রাজা-বাদশাকেও একজন দীনাতিদীন চাকর ঘৃণার চোখে দেখতেই পারে। তাই মানুষের অবোধ মনে প্রশ্ন জাগে, বনের পশু জানোয়াররা ‘দখলে ও ভোগে’ মেতে আছে ঠিকই। কিন্তু সভ্য-শিক্ষিত-সুশিক্ষিত সচেতন সমাজ এবং জ্ঞান-গরিমার দাবিদার মানুষ কি ওই দখল ও ভোগের লড়াইয়ে এতটুকুও কম মেতে আছে? তাই যদি না হবে, তাহলে দেশের নব্বই শতাংশ সম্পদ মাত্র দশ শতাংশ মানুষ ভোগ করে কীভাবে? দেশের কিছু মানুষ মাসে পঞ্চাশ হাজার থেকে দু’লক্ষ টাকা মাস মাইনে পাচ্ছে, যেখানে অগণিত হতভাগা মানুষ মাসে মাত্র দেড় থেকে দু’হাজার টাকা মাস মাইনে পায়। এও কি ‘দখল ও ভোগের’ চিত্র নয়? সব জিনিসের একটা সীমারেখা থাকা প্রয়োজন। আজ দেশে দখল ও ভোগ ‘লক্ষ্যসীমা’ অতিক্রম করেছে। জনরোষও আজ জাগ্রত। সচেতন মানুষ আজ প্রতিবিধান এবং প্রতিকার চায়।
হতভাগা এই পৃথিবীর পানে তাকিয়ে দেখুন, কী সকরুণ দৃশ্য! এই পৃথিবীর কত দুর্বল দেশ সবল দখলকারীর যাঁতাকলে পড়ে অসহায় জীবজন্তুর ন্যায় আকাশ-ভাঙা আর্তনাদ করছে। তাদের যুগ-যুগান্তের আর্তনাদ কি ওই সমস্ত দখলকারী দানবের কানে পৌঁছায় না?
মানুষের মন যেমন মন্দপ্রবণ, তেমনি প্রশ্নপ্রবণও। মনে প্রশ্ন জাগে, একই জঙ্গলে বাঘ-সিংহ, নিরীহ হরিণ-জেব্রা ও বোকা বাইসন কেন? আবার একই পৃথিবীতে আমেরিকা, অবলুপ্ত প্রায় পানামা, বিধ্বস্ত ইরাক ও আড়ষ্ট ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং হতদরিদ্র দেশগুলো কেন? সারা পৃথিবীতে এরূপ উপমার কোনো অভাব নেই। এ যেন কেবল ‘দখল ও ভোগের’ পরিশুদ্ধ উন্নতমানের সীমাহীন হৃদয়হীন সর্বগ্রাসী সংগ্রাম। এটাই কি মানব সভ্যতার আধুনিক রূপ?
আমাদের দেশ স্বাধীন হল। বেনিয়ার জাত ইংরেজ আমাদের দেশকে প্রায় দুশো বছর ভোগ-দখলে রেখে মনের সুখে শাসন করল। তাদের সেই দখলদারী ছাড়াতে দেশের মানুষের কালঘাম ছুটে গেল। অগণিত প্রাণ, আকালে ঝরে পড়ল। কত সহস্র সন্তান পিতৃহারা হলো। কত রমণী বিধবা হলো। কত মাতা ও পিতা সন্তানহারা হলো। কত শিশু অনাথ হলো। কাদের পাপে তারা প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করল, সে বিচার এক মহাবিচারক ছাড়া আর কেইবা করবেন। দেশবাসীই দেশকে একদিন পরাধীন করেছিল নইলে গুটিকতক ইংরেজের কিছু করার ছিল না।
ফের দেশ স্বাধীন হলো। দেশ পরিচালনায় দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো। অনেকগুলো রাজনৈতিক দল গড়ে উঠল। এবার সেই পুরনো মদ নতুন বোতলে এসে গেল। দখল ও ভোগের সংগ্রাম। কোন দল দেশের কতটা দখল করবে, কোন দল দেশের কত মানুষ দখলে রাখবে, এসবই যেন রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য ও ব্রত হয়ে উঠল। যার জন্য আজও স্বাধীন দেশের কত নিরীহ নিরপরাধ প্রাণ প্রত্যহ লুটিয়ে পড়ছে। দেশের শ্রীবৃদ্ধি নেই, উন্নতিও নেই। কেবল আছে ‘দখল ও ভোগের’ কুৎসিত কামনা, লোলুপ বাসনা। এ পরিবর্তন শুধু পালা বদলের পালা মাত্র। দলগুলো একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ মাত্র। এই পরিবর্তন দেশেরও নয়, সমাজের নয়। দেশের জনসাধারণ সার্বিকভাবে সজাগ না-হওয়া পর্যন্ত এ ধারা চলতেই থাকবে।
প্রতিটি দল এখন আপন আপন দলের পোক্ত লেঠেল ও একান্ত অনুগত ‘দলদাস’ বানাতে ও বাড়াতে ভীষণ ব্যস্ত। জনগণ ঘুরে না-দাঁড়ালে বার বার নির্বাচন হবে আর প্রমাণ হবে বাংলাদেশীরা গণতন্ত্রের অযোগ্য। যে সংগ্রামে ভালো কাজের জন্য আকাক্সক্ষা নেই, হৃদয়ের কোনো আকুতি নেই, মনের আকুলি-বিকুলি নেই তা পশুদের সংগ্রাম থেকেও কতই না নিকৃষ্ট মানের! যে সংগ্রাম কেবল ‘দখল ও ভোগে’র জন্য নির্বিচারে মানুষ খুন করতে ওস্তাদ, দেশের প্রতিটি মানুষের প্রতি যার এতটুকুও সহমর্মিতা বা সমবেদনা নেই, তা দূর অতীতের দানবের লড়াই ও পশুর সংগ্রাম ছাড়া আর কী! মানুষ তার দুঃখময় পারিবারিক জীবনে দু’মঠো অন্ন ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেতে বসেছে, সেই মানুষটিকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে দিবালোকে ঠান্ডা মাথায় খুন করা, এ কোন হিংস্রতা? এরই নাম কী দেশসেবা, দেশ গঠন। তা হলে গভীর জঙ্গলে জানোয়ারের কাজটি কী?
মনে প্রশ্ন জাগে, সকল ধর্মই তো একই কথা বলে। স্রষ্টা সর্বশক্তিমান, সর্বস্রষ্টা, সর্বশ্রোতা, সর্বনিয়ন্তা- যাঁর আদি নেই, অন্ত নেই, দিন নেই, রাত নেই। তিনি একক সর্বনিয়ন্তা। চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, সবই তাঁর নিয়ন্ত্রণে। তা হলে এই পৃথিবীটা কি তাঁর বাইরে চলে গেছে? মানুষের জ্ঞানের পরিধি তো খুবই কম। তাই আমরা কি ভাবব, নরকহীন এই পৃথিবীতে এই সব নারকীয় তান্ডবলীলা দিবা-রাত্রি দেখে শুনে? আমাদের মনে হত্যাশার সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের মন যেন সন্দেহের সাদা মেঘে আচ্ছন্ন ও আড়ষ্ট হয়ে উঠছে। এখানে আমরা নিরুপায়। মন ও আত্মার উপর আমাদের কোনো অধিকার নেই। তারা স্বাধীন।
তা হলে, এসবকে মানুষের জ্ঞানাতীত জগতের জন্ম-জন্মান্তরের নিখিল বিশ্বস্রষ্টার নিরন্তর বিচারের সুদূর কুহেলিকা ভরা হাতছানি মাত্র। প্রশ্ন জাগে, তাহলে বিধাতার এই বিচিত্র চির নাট্যশালার নানা বৈচিত্র্যভরা রঙ্গমঞ্চের নায়ক-নায়িকারা কি তাদের নির্ধারিত পাঠ করেই চলেছে? সভ্য আধুনিক যুগেও ভোগের লড়াইয়ের কোনো শেষ দেখা যাচ্ছে না। এখানে মানবকল্যাণ ও সেবা বিতরণের লক্ষণ কদাচিৎ দেখা যায়। সেই একই কথা দখল আর ভোগ।
আবার বিধির এই নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে একটু ফিরে তাকালে স্বস্তি জাগে। কই, কোথায় গেল বিশ্বের তাবড়-তাবড় গগনস্পর্শী সাম্রাজ্যগুলো? কে তাদের যথাসময়ে অস্তাচলে নিয়ন্ত্রিত করলেন? যারা ভেবেছিল তাদের উদয় আছে অস্ত নেই, পৃথিবীতে তাদের প্রসাদ-অট্টালিকা-দুর্গগুলো চিরস্থায়ী। কে তাদের চিরবিদায় দিয়ে আজকের এই ভোগ দখলের ‘দলতন্ত্র’ বাগীশদের আমন্ত্রণ জানালেন। আমরা জানি পৃথিবীর প্রাণ মানব জাতি। আবার জাতির প্রাণ তার মনুষ্যত্ব-মানবতা। মানুষের এই মনুষ্যত্বের ও মানবতার প্রকাশ ঘটে তার দৈনন্দিন আচরণে, সকল সৃষ্টির প্রতি দায়দায়িত্ব পালনে, সকল মানুষের প্রতি তার সহমর্মিতা, সহনশীলতায়, ভালোবাসায়।
মানুষের প্রথম পরিচয় হোক, সে একজন মানুষ। সে পরিচয় জাতি-ধর্ম-বর্ণে নয়, শিক্ষা, দীক্ষাতে নয়, টাকা-পয়সা পদ ও পদবীতে নয়, বংশ গোত্র ও সমাজে নয়, কাল ও যুগে নয়, দেশে বিদেশে নয়, মানুষের পরিচয় হোক কেবল মানুষ বলেই। মানুষের জন্য থাক মানুষের অকপট ভালোবাসা, সহমর্মিতা, স্নেহ-শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, দয়া-মায়া-ক্ষমা প্রভৃতি। সেগুলো মানব চরিত্রের শ্রেষ্ঠ ভূষণ। এই সহমর্মিতা ব্যতীত পৃথিবী বেঁচে থাকতে পারে না। সহমর্মিতাই পৃথিবীর প্রাণ। মানুষের প্রতি মানুষের লক্ষ্য হোক বিচ্ছেদ নয়, মিলন; বিবাদ নয়, বন্ধন; সংঘর্ষ নয়, সংহতি; ধ্বংস নয়, প্রগতি; হিংসা নয় ভালোবাসা; হত্যা নয়, রক্ষা। মানুষ জানুক, সারা পৃথিবীতে একটাই জাতি-মানবজাতি। মানুষ জানুক, মানুষের একটাই ধর্ম- মনুষ্যত্ব-মানবতা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দখল

১৩ ডিসেম্বর, ২০২২
১৩ এপ্রিল, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন