পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মোবায়েদুর রহমান:
রবিবার ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৫ টায় এই লেখা শুরু করেছি। বেলা ২:১২ মিনিটে বেগম জিয়ার জামিনের শুনানি শুরু হয় এবং সাড়ে ৩ টায় শেষ হয়। শুনানি শেষে বিচারপতি এনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি শহিদুল করিম সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সিদ্ধান্ত দেন যে নিম্ন আদালত থেকে মামলার নথি তাদের আদালতে পাঠালে জামিন সংক্রান্ত আদেশ দেওয়া হবে। ফলে বেগম জিয়ার কারাবাস দীর্ঘায়িত হলো। কতদিনের মধ্যে বিচারিক আদালত নথি পাঠাবেন সেটি পরিষ্কার হয়নি। তবে গত বৃহস্পতিবার হাইকোর্টে যখন জামিনের আবেদন ফাইল করা হয় তখন হাইকোর্ট মামলা তথা রায়ের রেকর্ড পত্র ১৫ দিনের মধ্যে উচ্চ আদালতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট আইনজীবি এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ জনাব শাহ্দ্বীন মালিক নিউজ২৪ টেলিভিশনকে গত রবিবার সন্ধ্যায় বলেন, আদালতের নথি ছাড়াই জামিন সম্পর্কে রায় দেওয়া যায়। কতগুলি শর্ত সাপেক্ষে জামিন দেওয়া বা না দেওয়া আদালতের এখতিয়ার। উচ্চ আদালতে রায়ের সার্টিফায়েড কপি তো দেওয়াই হয়েছে। সেটির ভিত্তিতেই আদালত সিদ্ধান্ত দিতে পারতেন। এখন যদি নিম্ন আদালত ১৫ দিনের আগে নথি না পাঠায় তাহলে বেগম জিয়াকে আরো ১৫ দিন কারাগারে থাকতে হবে।
এটি গেল আইন আদালত এবং বিচারের দিক। কিন্তু এই মামলায় আগাম নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের মতলব ধরা পড়েছে। এর আগেও আমি আরেকটি লেখায় বলেছি যে, বেগম জিয়াকে কারাদন্ড দিয়ে এবং কারাগারে ঢুকিয়ে সরকার বিরাট সংকটে পড়েছে। জেল খানায় ঢুকানোর আগে সরকার বুঝতে পারেনি যে, এই কারাদন্ড সরকারের জন্য শাঁখের করাত হয়ে দাঁড়াবে। মাথা মোটা ব্যক্তিরা যেরকম হিসেব করে সরকারও সেরকম একটি সহজ-সরল হিসেব করেছিল। তারা ভেবেছিল, বেগম জিয়াকে কারাগারে ঢুকানো হবে, আর সাথে সাথে বিএনপির নেতাকর্মী এবং ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা ফুঁসে উঠবেন। তারা রাস্তাঘাটে একটি দক্ষযজ্ঞ কান্ড বাধিয়ে দেবেন। কিন্তু বেগম জিয়া লা মেরিডিয়ানে অনুষ্ঠিত বিএনপি কার্য নির্বাহী কমিটির সভায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় হুকুম দিয়েছিলেন যে, তার রায়ের বিরুদ্ধে যে প্রতিক্রিয়া দেখানো হবে সেটি যেন শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক এবং নিয়মতান্ত্রিক হয়। নাজিমউদ্দিন রোডের জেলখানায় প্রবেশের পরও তিনি এ্যাডভোকেট পাটোয়ারি এবং সানাউল্লাহ মিয়া এবং পরের দিন যেসব সিনিয়র আইনজীবি তার সাথে দেখা করতে যান তাদেরকেও স্পষ্ট ভাষায় বলেন যে তারা যে আন্দোলন করবেন সেটি যেন অহিংস হয়। তার পরেও আওয়ামী লীগ তাদের অতীতের কীর্তিকলাপের ট্র্যাডিশন ধরে ভেবেছিল যে, আন্দোলন কোনোদিন শান্তিপূর্ণ হয় নাকি? জ্বালাও পোড়াও এবং ভাংচুর না করলে কি কোনো দিন আন্দোলন হয়? কিন্তু সুপ্রিম লিডার এবং দেশনেত্রী থেকে দেশমাতায় রূপান্তরিত বেগম জিয়ার নির্দেশ মত বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের এক বিরল নজির সৃষ্টি করে।
বেগম জিয়ার কারাদন্ড ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া এমন তরিৎ হয় যে সেটি খোদ বিএনপিরও প্রত্যাশার বাইরে ছিল। মূহুর্তের মধ্যেই সারাদেশে বিদ্যুৎ তরঙ্গের মত সহানুভূতি ও সমর্থনের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। মানব বন্ধন, অবস্থান ঘর্মঘট এবং অনশন ধর্মঘট প্রভৃতি প্রতিটি কর্মসূচিতেই যে বিপুল জন সমাগম ঘটে সেটি মানুষের কল্পনাকেও হার মানায়। শত শত থেকে হাজার হাজার এবং হাজার হাজার থেকে লক্ষ মানুষ ঐসব কর্মসূচিতে অংশ নেয়। বেগম জিয়ার কারাদন্ডের বিরুদ্ধে জনরোষ এবং তার সপক্ষে অভ‚তপূর্ব জনসমর্থন লক্ষ্য করে সরকারের মাথা খারাপ হয়ে যায়। সরকারের নির্দেশে পুলিশও ঐ তিনটি কর্মসূচিতে সহিংস হামলা করা থেকে নিজেদেরকে কিছুটা সংযত রাখে। কিন্তু তারপর তাদের সংযমের মুখোশ খসে পড়ে।
\দুই\
ঐ তিনটি কর্মসূচি পালনের পর যেদিন সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয় ঐ দিন হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, রাজশাহীসহ অন্তত ৭ টি জেলায় বিএনপির শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ হামলা চালায়। একাধিক জেলায় রাবার বুলেট ছোঁড়া হয় এবং অনেক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হন। পুলিশ বেধড়ক লাঠিপেটা করে এবং কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে। অথচ প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বিএনপির মিছিল ছিল শান্তিপূর্ণ, নিরস্ত্র এবং অহিংস। তারপরেও পুলিশ অযাচিত সংহিংস হামলা চালায়। পরিষ্কার হয়ে যায় যে, জনসমর্থন এবং জনসহানুভ‚তির সাথে সরকার কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তাই তাদের আসল চেহারা এবং মতলব বেরিয়ে এসেছে। পুলিশের এই সংহিংস হামলার পেছনে সরকারের যে গোপন নির্দেশ রয়েছে, সেটি বুঝতে আর কারো বাকি থাকে না।
সরকার পড়েছে এক চরম অশ্বস্তিতে। বেগম জিয়াকে কারাগারে থাকায় প্রতিদিন তার জনসমর্থন হুহু করে বাড়ছে। অন্যদিকে তার কারাদন্ডের বিরোধিতা করে এবং কারামুক্তি দাবি করে যে অহিংস ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন শুরু হয়েছে সেটি যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে সেই অহিংস আন্দোলনেও অতি শীঘ্রই শুধুমাত্র লক্ষ লোক শামিল হবে না, লক্ষ লক্ষ লোক শামিল হবে। সাবেক বিএনপি নেতা এবং মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা দুদিন আগে একটি টকশোতে বলেছেন যে, আওয়ামী লীগ বিএনপির অহিংস আন্দোলনের ট্র্যাপে অর্থাৎ ফাঁদে পড়ে গেছে। আওয়ামী লীগও বুঝেছে যে, বিএনপি যদি শান্তিপূর্ণভাবেও রাস্তায় নামতে পারে তাহলে কয়েক লক্ষ লোক রাস্তায় যে নীরব রায় দেবে সেটি শুধু বেগম জিয়ার পক্ষেই যাবে না, বর্তমান সরকারের অপসারণের কথাও নীরবেই উচ্চারণ করবে। অন্যকথায় আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগেই জনগণ নীরব ভাষায় এই সরকারের অপসারণের দাবিতে রায় দেবে।
এমন একটি পরিস্থিতিতে সরকারের সামনে এখন একটি মাত্র পথই খোলা আছে। আর সেটি হলো, যে কোনো মূল্যে বিরোধীদলকে সম্পূর্ণ দাবিয়ে রাখা। বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি শান্তিপূর্ণ জনসভা অনুষ্ঠানের অনুমতি চেয়েছিল। তাকে সেই অনুমতি দেওয়া হয়নি। তখন দলের পক্ষে নয়া পল্টন অফিসের সামনে অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। সেটিও দেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, ঢাকা মহানগরীর কোথায় কোনো স্পটেই জনসভা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এর প্রতিবাদে বিএনপি কালো পতাকা প্রদর্শনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। সরকার সম্ভবত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন তো দূরের কথা, রাজপথে শান্তিপূর্ণ পদচারনা তো দূরের কথা, বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদেরকে রাস্তায় দাঁড়াতেই দেওয়া হবে না। জুলুমের স্টীম রোলারের ডেমোনেস্ট্রেশন তারা দেখিয়েছে শুক্রবার ২৩ তারিখে। ঐদিনের জুলুমের কথা সকলেই জানেন। অথচ সেদিন কোনো মিছিলেরও চেষ্টা হয়নি। ঐ দিন কোনো কালো পতাকা মিছিলও ছিল না। ঐ দিন ছিল নীরবে দাঁড়িয়ে কালো পতাকা প্রদর্শনের কর্মসূচি। কিন্তু সেটিও পুলিশ করতে দেয়নি। বিএনপি সেদিন নয়াপল্টনে তার অফিসের সামনে রাস্তায় সভা সমাবেশ কিছুই করেনি। মাত্র কয়েক শত নেতাকর্মী ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন, যাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিলেন মহিলা। সেই ফুটপাতেও তাদের ওপর পুলিশ হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং মারপিট করে বিএনপি অফিসের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। বিএনপির তরফ থেকে একটি ঢিলও ছোঁড়া হয়নি। তারপরেও পুলিশ জল কামান থেকে রঙ্গিন গরম পানি ছিঁটিয়ে দেয়, টিয়ার গ্যাস মারে এবং বেধড়ক লাঠি পেটা করে। সাবেক এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ ১৫৭ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে এবং প্রায় আড়াইশ’ জনকে আহত করে।
পুলিশ কমিশনারের যুক্তি ছিল অদ্ভুত। তিনি বলেন, কালো পতাকা প্রদর্শন নাকি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির আওতায় পড়ে না। এই কর্মসূচির জন্য নাকি পুলিশের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। কর্মসূচি পালনের নামে বাড়াবাড়ি করলে পুলিশের যা করা উচিৎ এখানে তাই করা হয়েছে। বাংলাদেশের কোটি কোটি লোক সেদিন টেলিভিশনে সমস্ত ঘটনার দৃশ্য দেখেছে। কোনো কর্মসূচিই পালিত হলো না, সেখানে আবার বাড়াবাড়ি হলো কোত্থেকে? কালো পতাকা প্রদর্শন নাকি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির আওতায় পড়ে না, এই আইন কোথায় পেলেন পুলিশ কমিশনার?
বাংলাদেশ সরকার সম্ভবত ভুলে গেছে যে ব্ল্যাক ফ্ল্যাগ ডেমোনেস্ট্রেশন বা কালো পতাকা বিক্ষোভ নামে একটি রাজনৈতিক পরিভাষা পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশে বৃটিশ আমল থেকেই চলে আসছে। ভারতে তো অহরহ প্রধানমন্ত্রীকে কালো পতাকা প্রদর্শন করা হচ্ছে। আর সেটিও করা হচ্ছে, ঘরের মধ্যে নয়, ফুটপাতেও নয়, রাস্তায় মিছিল করে উচ্চকণ্ঠে শ্লোগান দিয়ে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক যখন ৫৪-৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন আওয়ামী লীগ কি তার বিরুদ্ধে কালো পতাকা প্রদর্শন করেনি?
\ তিন \
ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে কালো পতাকা প্রদর্শনের জন্য পারমিশন লাগবে, এমন আইন কোথায় পেলেন পুলিশ কমিশনার? আমাদের সংবিধানের ৩৬, ৩৭ ও ৩৮ অনুচ্ছেদে চলা ফেরা করা, সামবেশ করা এবং সংগঠন করার স্বাধীনতা রয়েছে। ৩৯ নং অনুচ্ছেদে বাক স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। পুলিশ অফিসার যেসব কথা বলছেন সেগুলো সংবিধানের এই চারটি অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। গত ২৪ ফেব্রæয়ারি শনিবার বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যথার্থই বলেছেন যে, সভা সমাবেশ বা মিছিল করার জন্য পুলিশের অনুমতি লাগবে কেন? এখন মনে হচ্ছে যে ঘরের মধ্যে ৫/৭ জন কথা বলতে গেলেও পুলিশের অনুমোদন লাগবে। তার প্রশ্ন, দেশটি কি পুলিশী রাষ্ট্র হয়ে গেল?
শান্তিপূর্ণ বিরোধিতার ক্ষেত্রেও সরকার হঠাৎ করে রুদ্রমূর্তি ধারণ করল কেন? বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখার মতো। সরকার তার চিন্তাভাবনার ক্যানভাসে নানান রকম দৃশ্যপট আঁকছেন। যদি নির্বাচন পর্যন্ত বেগম জিয়া কারাবন্দী থাকেন তাহলে তার জনপ্রিয়তা বাড়তে বাড়তে তিনি Colossus হয়ে যাবেন। ইংরেজী কলোসাসের বাংলা হলো অতিকায় মূর্তি। অর্থাৎ জনপ্রিয়তার ফলে তার ইমেজ হবে একজন কলোসাসের। সে ক্ষেত্রে বেগম জিয়ার নামের টানে কলাগাছও পাশ করে যাবে। আবার তিনি যদি জামিনেও বাইরে থাকেন তাহলে তার প্রতিটি জনসভা হবে এক একটি করে জনসমুদ্র। তখন সেই কবিতা এবং গানের ভাষায়, ‘সমুদ্র উত্তাল জনতা তরঙ্গকে’ রুখবে কে? এই পরিস্থিতিতে ডিক্টেটরের মত লৌহ কঠিন হস্তে আওয়ামী সরকারের পক্ষে বিরোধী দলকে দমন করা ছাড়া আর কোনো পথ নাই।
তাই শুরুতেই বলেছি যে বেগম জিয়ার কারাদন্ড হয়েছে শাঁখের করাত। আওয়ামী লীগের জন্য বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘের মত। রাজনীতির অমোঘ বিধান তার খেলা দেখাতে শুরু করেছে মাত্র। একটি হিন্দী সিনেমায় ভিলেন ওমরেশপুরি বলেছেন, ‘দেখতে যাও’। বাংলাদেশের রাজনীতির গতি ধারাও, আসুন, আমরা দেখতে থাকি।
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।