পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.)
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
আরও পরে সম্রাট আওরঙ্গজেবের হাতে বাংলার সুবাদার এবং তাঁরই ছোট ভাই শাহ সুজার পরাজয় হলে ১৬৫৯ সালে শাহ সুজা সদলবলে আরাকান রাজের আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরে তাকে, শাহ সুজাকে, হত্যাও করা হয় এই আরাকানে ১৬৬০ সালে। শাহ সুজার হত্যার পর কবি আলাওয়ালকে সুজার সাথে নৈকট্যের কারণে দরবার হতে বিতাড়িত করা হয়। শাহ সুজার সাথে যে বিশাল বহর ছিল তার সাথে বদ্বীপ অঞ্চলের বাংলা ভাষীরা ছিলেন। তারা যে পথে আরাকানের মারুক ইউতে প্রবেশ করেন, সে পথ এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্ব দক্ষিণ নাইক্ষংছড়িতে প্রবেশের পথ।
শাহ সুজার হত্যার কারণ বিশদভাবে না পাওয়া গেলেও আরাকান রাজ সম্রাট আওরঙ্গজেবের রোষানল থেকে নিজেকে বাঁচাতে এমন কাজ করে থাকতে পারেন বলে মনে করা হয়। আবার অনেকে মনে করেন, শাহ সুজার অগাধ ধন-রতেœর জন্যও হত্যা করে থাকতে পারে। যাহোক, পরে আওরঙ্গজেব পর্তুগীজ জলদস্যুদের বাংলা হতে বিতাড়িত করার জন্য বাংলার সুবাদারের শায়েস্তা খানকে পাঠালে তিনি বর্তমানের চট্টগ্রাম আরাকান সাম্রাজ্য পুনঃরুদ্ধার করেন। সমগ্র অঞ্চল মোগল রাজত্বের অংশে পরিণত হয়।
সুবাদার শায়েস্তা খাঁ শুধু চট্টগ্রাম অঞ্চলেই দখল করেননি ২৮৮টি যুদ্ধজাহাজ আর ছয় হাজার সৈনিক এবং কয়েক হাজার স্থানীয় অনুগামীদের নিয়ে কালাদান নদী পর্যন্ত দখল করেন। মোগল প্রশাসন উত্তর রাখাইন অঞ্চল কয়েক বছর দখলে রেখে ওই রাজ্যকে করদ রাজ্যে পরিণত করেছিল। কিন্তু শাহ সুজা কর্তৃক বাংলা হতে নিয়ে যাওয়া ধনদৌলত আর পাওয়া যায়নি।
ইতিহাসের এত ঘটনার কারণে মুসলমান জনগোষ্ঠী বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মোগল সেনাদের অনুগামীরা আরাকানে বসতি গড়ে তোলেন। শাহ সুজার সাথে যে সব সৈনিক আরাকানে এসেছিলেন তাদের অনেকেই আকিয়াব অঞ্চলে থেকে যান, যা থেকে এখন মিয়ানমারের দক্ষিণ অঞ্চলে ‘কামান’ মুসলমান বলে পরিচিত। এ ঐতিহাসিক পটভূমিকে ১৯৬০ সালে উ নু-এর স্বাস্থমন্ত্রী সুলতান মাহমুদ কালাদান নদীর উত্তরাংশকে রোহিঙ্গাঞ্চল বলে উল্লেখ করেছিলেন।
সুলতান মাহমুদ (১৯০০-১৯৮২) আরাকান অঞ্চলের রাজনীতিবিদ ছিলেন। ব্রিটিশ রাজের সময় তিনি কেন্দ্রীয় আইন-পরিষদের ক্যাবিনেট সচিব ছিলেন। বার্মা স্বাধীন হবার পর ১৯৫৭ সালে উপ-নির্বাচনের মাধ্যমে বুথিডং হতে বার্মার সংসদে সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬০ সালের নির্বাচনে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হয়ে উ নু-এর মন্ত্রিসভায় ১৯৬২ সালের সামরিক অভ্যুত্থান পর্যন্ত ইউনিয়ন অব বার্মার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী উ নু-এর সময় যখন বার্মা ফেডারেল রাষ্ট্র হবার পথে ছিল তখন সুলতান মাহমুদ ভারতীয় মূলের আরাকানদের জন্য উত্তর রাখাইন রাজ্য গঠনের প্রস্তাব রেখেছিলেন। এর পরিধি নাফ নদী হতে কালাদান পর্যন্ত বিস্তৃত করার দাবি জানিয়েছিলেন। অন্যথায় সমগ্র আরাকান একটি রাজ্য হলে সে ক্ষেত্রে পালা করে রাজ্যে মুসলিম এবং বুদ্ধিষ্ট গভর্নর নিয়োগের পরামর্শও দিয়েছিলেন।
সুলতান মাহমুদ উ নু-এর বার্মার জাতিগত বৈচিত্র্যের ধারণার অনুকূলে আরাকান রাজ্য গঠন লগ্নে বৌদ্ধ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় রাখতে একটি বিস্তারিত প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ওই প্রস্তাবে তিনি বলেছিলেন যে, যদি উত্তর ও দক্ষিণ রাখাইন না করা হয় তবে গভর্নর যে ধর্মাবলম্বী হবেন তার বিপরীতে স্পিকার অন্য ধর্মের এবং ডেপুটি স্পিকার গভর্নরের ধর্মের হবে; এমনিভাবে ক্যাবিনেটও ভাগাভাগি হবে। কিন্তু সাময়িক জান্তা প্রধান জেনারেল নে উইন সে পথে হাঁটেননি।
সুলতান মাহমুদের জন্ম হয়েছিল আকিয়াবে সিতওয়ে এবং লেখাপড়া শেষ করেন কলকাতায়। তিনি রোহিঙ্গা ভাষা এবং সংস্কৃতিকে আলাদা মর্যাদা দেবার দাবিও তুলেছেন।
ভারতে মুসলিম লীগের পাকিস্তানের আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করে আরাকের ‘ভি ফোর্সের’ সদস্যরা আকিয়াবে আরাকান মুসলিম লীগ গঠন করে পাকিস্তানে যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করলেও তৎকালীন পূর্ব-বাংলার মুসলিম লীগ রাজি হয়নি, যার প্রেক্ষিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তখনও বার্মা স্বাধীন হয়নি।
যাহোক, সুলতান মাহমুদ ছাড়াও ১৯৪৭ সালে বার্মার আইন পরিষদে আরাকান অঞ্চলের আরেক মুসলমান সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন যার নাম ছিল এমএ গফফার। তিনি রোহিঙ্গাদের আলাদা উপজাতি মর্যাদা দেবার আহŸান জানিয়েছিলেন। আরও পরে ১৯৫১ সালে স্বাধীন বার্মার জাতীয় নির্বাচনে রোহিঙ্গা অঞ্চল হতে পাঁচজন রোহিঙ্গা সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে সমগ্র বার্মায় যে দু’জন নারী সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে একজন ছিলেন রোহিঙ্গা অঞ্চলের জুরা বেগম। অপরজন ছিলেন নিহত আং সাং-এর বিধবা পত্মী, সু চি-এর মাতা ‘খিন কি’; যিনি পরে ভারতে বার্মার রাষ্ট্রদূত ছিলেন। অথচ রোহিঙ্গারা যারা আং সাং সু চির জন্য জীবনবাজি রেখেছিলেন, আজ সেই জনগোষ্ঠী এই নেতার কাছে বহিরাগত ‘বাঙালি’।
রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব ইতিহাসের পাতায় বহুবার বহুভাবে উল্লেখিত হলেও মিয়ানমার সে ইতিহাসকে মানতে রাজি নয়। কিন্তু মিয়ানমার জেনারেলরা ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগেও অভিযুক্ত হতে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেও যেমন জটিল ছিল তেমনি বর্তমানের জটিল। মিয়ানমার বাংলাদেশকে দুর্বল প্রতিপক্ষই মনে করে বলে অনেকের ধারণা। মিয়ানমার একটি জটিল রাষ্ট্র। কাজেই এ রাষ্ট্র সম্বন্ধে অতি সংক্ষেপে কিছু বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা না থাকলে রোহিঙ্গা সমস্যার সঙ্কট অস্পষ্ট থেকে যাবে।
১৯৫১-এর আরও পরে ১৯৫৬ সালে বার্মার সাধারণ নির্বাচনে এর অঞ্চল হতে ছয়জন সংসদ সদস্য ছিলেন যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুলতান মাহমুদ, যার আলোচনা আমরা করেছি। পুনরায় ১৯৯০ সালে বার্মার সাধারণ নির্বাচনে রোহিঙ্গা পার্টি, ‘ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ফর হিউম্যান রাইটস’-এর চারজন সদস্য সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সামসুল, আনোয়ারুল হক ওরফে কিয়া মিন, তিনি রোহিঙ্গা নেতা ছিলেন। যিনি পরে ১৯৮২ সালের নাগরিক আইন ভঙ্গ করার দায়ে ১৯৯২ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান কালে গ্রেফতার হন এবং ৪৭ বছর কারাদÐে দÐিত হন। এমনকি তার স্ত্রী এবং দুই কন্যা ও এক পুত্রকে একই কারণে ১৭ বছর কারাদÐ দেয়া হয়।
অপর তিনজন হলেন, চিৎ লইন ইব্রাহিম, ফজল আহমেদ এবং নুর আহমেদ। পরবর্তীতে এদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, এই রোহিঙ্গা পার্টিও সূ চির এনএলডি-এর সমর্থক ছিল। ১৯৯২ সালে সু চিকে রোহিঙ্গাদের পুনঃসমর্থনের কারণেই সামরিক জান্তা তাদের উপর আক্রমণ করে এবং বর্তমানের মাপে না হলেও, অনেক ঘরবাড়ি তখনও পুড়িয়ে দিয়েছিল মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এবং জান্তার দোসররা। ওই সময়েও বাংলাদেশে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়, যার মধ্যে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা এখনও বাংলাদেশে রয়েছে। এরপর রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকা হতে বাদ দেয়া হয়। কাজেই নির্বাচিত হবার পর মিয়ানমারের মূলধারার রাজনীতিতে সক্রিয় যোগ দেবার কোনো পথ খোলা রাখেনি।
২০১৫ সালের একজন রোহিঙ্গা মূলের, ইউনিয়ন সলিডারিট এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির সদস্য মসংকে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের আওতায় নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করাতে আর কোনো রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাজনৈতিক অঙ্গনে নেই।
কালাদান উত্তর অঞ্চল এখনও রোহিঙ্গা প্রধান অঞ্চল। মংডু, বুথিডং এবং রাথিডং এখনও রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত প্রধানঞ্চল। আগস্ট ২৫, ২০১৭ সালের পর হয়তো এখন আর তেমন নেই। কারণ, মোট ৮ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে উপস্থিতি। প্রায় ৬ লাখ এবারের এবং ২ লাখের উপরে ১৯৯২ সালের পর যাদের মিয়ানমার ফিরিয়ে নিয়ে যায়নি। তথ্যে প্রকাশ- নভেম্বর ২৩, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য বাংলাদেশে-মিয়ানমার যে দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি হয়েছে, সে চুক্তিতেই ২০১৬ সাল হতে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের শর্ত পূরণের পর ফিরিয়ে নেবার কথা রয়েছে মাত্র। প্রশ্ন থাকে যে, গত ২৫ বছর হতে যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কুতুপালং ক্যাম্পে রয়েছে তাদের ভাগ্যও ১৯৭১ হতে বাংলাদেশে থেকে যাওয়া উর্দু ভাষাভাষীদের মতো বিস্তৃত জনগোষ্ঠীর মত হবে?
ঐতিহাসিক ও দালিলিক প্রমাণে রোহিঙ্গারা শত শত বছর ধরে উত্তর রাখাইনে স্থায়ী বসবাসরত থাকলেও সে ইতিহাস মিয়ানমারের সামরিক জান্তা গায়ের জোরে অস্বীকার করে আসছে। আং সাং সু চিও যোগ দিলেন মিয়ানমারের অঘোষিত সামরিক জান্তার সাথে। (সমাপ্ত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।