ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
ইসলামী শিক্ষা যা আমাদের দেশে ‘মাদরাসা শিক্ষা’ নামে পরিচিত, আর এর সূচনা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময় থেকে। মক্কী জীবনে তিনি ‘দারে আরকামে’ এবং মাদানী জীবনে ‘মসজিদে নববীতে’ শিক্ষাদনের মহান কাজ আঞ্জাম দেন। ইসলাম যেহেতু পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান তাই ইসলামী শিক্ষার পরিসরও ছিল ব্যাপক। পার্থিব জীবন ও পারলৌকিক জীবনকে সুন্দর করা, তথা জীবনে সার্বিক প্রয়োজন মিটানোর উপযোগী দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করাই ইসলামী শিক্ষার মূল লক্ষ্য। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওফাতের পরে ইসলামী খিলাফতের যেমন ব্যাপক প্রসার ঘটে, তেমনি ইসলামী শিক্ষারও চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। মুসলমানগণ যেমন কুরআন, হাদীস, উসূলে ফিকহের গবেষণালব্ধ জ্ঞানের দ্বারা যুগের ধর্মীয় চাহিদা পূরণের উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন, তেমনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক চর্চার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের অনুকরণীয় জ্ঞান বিতরণে সক্ষম হন। আল জাবেরের মতো গণিতবিদ, ইবনে সিনার মতো চিকিৎসা বিজ্ঞানী, আলকেমীর মতো রসায়নবিদ, খাওয়ারিজিমির মতো ভ‚তত্ববিদ, আবু রুশদ, গাযালী, তুসী, আল বিরুনীর মতো বিজ্ঞানী ও দার্শনিক, রুমী, হাফিজ, জামি, খাইয়্যামের মতো কবি ও মনীষীগণ আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও মানুষ গড়ার সাংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক সোনালী যুগ সৃষ্টি করেন। মুসলমানদের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের জনক বললেও অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু কালক্রমে ইসলামী শিক্ষা সেই গৌরবময় ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে। জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা, বৈষয়িক বিষয়াবলীতে উৎকর্ষ লাভের দিকটি উপক্ষিত হতে থাকে। এভাবে ধর্মীয় শিক্ষা ও বৈষয়িক শিক্ষা দুটি আলাদা রূপ পরিগ্রহ করে। এ দু’য়ের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি হয়। এটা মুসলিম জাতির জন্য কিছুতেই কল্যাণকর হতে পারে না। আজ মুসলমানদের দেশের সংখ্যা, জনসংখ্যা বিপুল হওয়া এবং তাদের অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্তে¡ও তারা পশ্চাৎপদ। এ দূরবস্থা কাটিয়ে অতীতের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে হলে ইসলামী শিক্ষা তথা মাদরাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার বিকল্প নেই। মাদরাসা শিক্ষায় কুরআন, হাদীস, ফিকহ, আরবী সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে যেমন জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা থাকতে হবে, তেমনি বিজ্ঞান-প্রযুক্তিসহ আধুনিক বৈষয়িক বিষয়াবলীতেও পারদর্শিতা অর্জনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এক কথায় মাদরাসার স্বকীয়তা ঠিক রেখে দুনিয়ার হাসানা বা কল্যাণ ও আখিরাতের হাসানা বা কল্যাণ উভয় জগতের কল্যাণ লাভের নিশ্চয়তা বিধানই হবে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শিক্ষার লক্ষ্য।
এই লক্ষ্য অর্জন সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এ জন্য ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে। সাধন করতে হবে শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়ন। বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের প্রতিষ্ঠা মূলতঃ এ উদ্দেশ্যেই। প্রায় শতবর্ষ পূর্বে এ সংগঠনের জন্ম হয়। দেশের পীর-মাশায়েখ, ওলামায়ে কেরাম মাদরাসা শিক্ষকদের একটি প্লাটফর্ম ঐক্যবদ্ধ করে অরাজনৈতিকভাবে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর হযরত মাওলানা এম এ মান্নান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে একে বলিষ্ঠ ও প্রাণবন্ত করে তোলেন এবং ব্যাপক উদ্যম ও গতিপ্রবাহ সৃষ্টি করেন। দেশের ইবতেদায়ী থেকে কামিল স্তর পর্যন্ত সর্বস্তরে সরকার অনুমোদিত সকল মাদরাসার প্রায় তিন লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারী এ সংগঠনের সদস্য।
মাদরাসা শিক্ষা জাতিকে কী দিয়েছে
সন্দেহাতীত কুরআন, সর্বোত্তম আদর্শ প্রিয় নবীজির বিজ্ঞানসম্মত সুন্নাহ ও বিশ্ব বরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক, বৈজ্ঞানিকদের দিক নির্দেশনায় দেড় হাজার বছর ধরে মাদরাসা শিক্ষা তার লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের একক নেতৃত্বে, বর্তমান সরকারের আন্তরিক সহযোগিতায় এ শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নের রাজপথে উপনীত হয়েছে। আদর্শ নীতিবান, যুগোপযোগী, দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ জনগোষ্ঠি তৈরিতে এ শিক্ষা ব্যবস্থা সব দিক থেকে অগ্রগামী। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্বের শ্রমবাজারে অতিদ্রæত অগ্রসরমান এ শিক্ষা ব্যবস্থা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের ছোবল যখন সমগ্রবিশ্ব, বিশেষ করে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে, সে মুহূর্তে এ মাদরাসা শিক্ষার একজন লোককেও জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসে লিপ্ত হওয়ার নজির আছে বলে আমাদের জানা নেই। জমিয়াতের নেতৃত্বে সমগ্র বাংলাদেশে জঙ্গিবাদবিরোধী যত প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধন, জুমার খোতবায় আলোচনা, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের নেতৃত্বে সমাবেশ হয়েছে তা ছিল চোখে পড়ার মতো। এ শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে অন্য কোন শিক্ষা ব্যবস্থার তুলনা করা কোন দিক থেকে ঠিক হবে না। এ শিক্ষা ব্যবস্থা উপহার দিয়েছে বড় বড় পীর-মাশায়েখ, ঈদ ও জুমার খতিব, কুরআন, সুন্নাহ ও ইসলামী আইনে অভিজ্ঞ লক্ষ লক্ষ মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফকীহ। যাঁরা দ্বীনি দাওয়াতের মাধ্যমে প্রচার করে যাচ্ছেন শান্তির বাণী। অন্যায়, জুলুম প্রতিরোধ করে সমাজের মানুষকে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার দিকে দাওয়াত দিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার কাজে পালন করে যাচ্ছেন অগ্রণী ভ‚মিকা। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে মাদরাসা শিক্ষা পিছিয়ে নেই। মেধা বিকাশে রেখে যাচ্ছে অনন্য ভ‚মিকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মাদরাসার ছাত্ররা যে অবস্থান সৃষ্টি করেছে তা জাতির কাছে স্পষ্ট। মাদরাসা থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি ক্যাডার সার্ভিসে যুক্ত হচ্ছে। সর্বোপরি এ শিক্ষা ব্যবস্থা জাতির কল্যাণে, নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দানে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করণে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন-২১ ও ভিশন-৪১ পূরণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাচ্ছে।
মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে বর্তমান সরকারের অবদান
১. শতাব্দীকাল ধরে যে দাবি ব্রিটিশ সরকার পূরণ করেনি, পাকিস্তান সরকার গুরুত্ব দেয়নি, বাংলাদেশ আমলেও সরকারের পর সরকার এসেছে কিন্তু যে দাবি আলোর মুখ দেখেনি, সে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তাওফীক আল্লাহ বর্তমান সরকারকে দিয়েছেন যাতে সম্পূর্ণ মুসলিম জনগোষ্ঠি, দেশের লক্ষ লক্ষ আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ কৃতজ্ঞ। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল স্তরে বিজ্ঞ আলেমদের স্থান করে দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিশরের আল আজহার ইউনিভার্সিটির মতো একটি আন্তর্জাতিক ইউনিভার্সিটি হিসেবে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
২. বেতন বৈষম্য দূর করে মাদরাসার শিক্ষক কর্মচারীদের যে আসনে আসীন করা হয়েছে তার জন্য জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের নেতৃত্বে শুকরিয়া মিছিল ও কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে শুকরিয়া সমাবেশ করে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে লাখ লাখ শিক্ষক কর্মচারী।
৩. জরাজীর্ণ অবকাঠামো দূর করে মাদরাসার চকচকে নতুন ভবন যে শোভা পাচ্ছে তা এ সরকারের অবদান।। ৪. ৬৭টি মাদরাসায় অনার্স কোর্স, ২৯টি মাদরাসায় মাস্টার্স কোর্স চালু করা ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
৫. ৫ম ও ৮ম শ্রেণিতে বৃত্তি প্রদান বহুদিনের আকাক্সক্ষা পূরণ করেছে। ৩৫টি মডেল মাদরাসাসহ উল্লেখযোগ্যভাবে কম্পিউটার ল্যাব, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম দ্বীনি শিক্ষাঙ্গনকে ডিজিটালাইজেশনে অতিদ্রুত অগ্রসরমান ধারা সৃষ্টিতে অনন্য ভ‚মিকা পালন করেছে।
৬. মাদরাসা অঙ্গনে আরবী ও ইসলামী বিষয়ে প্রশিক্ষণ না হলেও বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞানসহ সাধারণ বিষয়সমূহে ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে এবং বর্তমানেও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে।
৭. মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটের অধীনে বিএমএড কোর্স চালু করে শিক্ষকগণকে প্রশিক্ষিত করার জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
৮. শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ঘঈঞই এর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় যুগোপযোগী আধুনিক কারিকুলাম, সিলেবাস ও পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশনার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে সর্বশেষ তথ্যসহ যুগের চাহিদা মেটাতে পাঠদান অব্যাহত রয়েছে। ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় কারিকুলাম ও সিলেবাস উন্নয়নের কাজ চলছে।
৯. একসময় মাদরাসার ছাত্রদের নতুন বই দেয়ার জন্য তিন মাস ধরে চাঁদা কালেকশন করেও যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই দেয়া সম্ভব হতো না। বছরের প্রথম দেড় মাস চলে যেত ক্লাস শুরু করতে। বর্তমান সরকার নতুন কারিকুলাম, নতুন সিলেবাসে নতুন তত্ত¡ ও তথ্য সমৃদ্ধ বই ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে দিতে পেরেছে। এটা এ সরকারের অন্যতম অর্জন।
১০. মাদরাসা শিক্ষা পরিচালনার অন্যতম সেক্টর ছিল মাদরাসা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা। জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ও জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়াসহ ছাত্র সংগঠনসমূহের এ দাবি বহুদিনের। বর্তমান সরকার যুগযুগ ধরে চলে আসা এ দাবি পূরণ করে এ শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের ইতিহাসে নিজেদের নাম লিখানোর সৌভাগ্য অর্জন করেছে।
(চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।