শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
কু তু ব উ দ্দি ন আ হ মে দ
কবি জীবনানন্দের সেই বহুল প্রচলিত বিখ্যাত উক্তিটিই মাথায় ঘুরেফিরে চলে আসে Ñ ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ কবি সনাক্তকরণে এরচে’ সার্থক কোন উক্তি সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে আছে কি-না, আমার তা জানা নেই।
কবি জীবনানন্দের যথার্থ এই উক্তিটি মাথার ভেতর ভাজতে ভাজতে মনে প্রায়ই প্রশ্ন চলে আসে Ñ কবিত্ব কি তবে প্রাকৃতিক বা দৈব কোন শক্তি নাকি মানুষের অর্জিত সাধনালব্ধ কোন পরাবাস্তব অভিজ্ঞান? জীবনানন্দের কথা মেনে নিলে মেনে নিতেই হয় যে, কবিতা কোন দৈব বা অর্পিত কোন শক্তি। কিন্তু কথা হল, কবিতা কি আসলেই দৈব কোন শক্তি? বিষয়টি বিশ্বাস করতে মন জোরালো কোন সায় দেয় না। মনকে বোঝানোর মতো সামথ্যবান কোন যুক্তি খুঁজে পাই না। কিন্তু পৃথিবীর চির অমর কবিতাগুলো যখন পড়ি; পড়ে সত্যি মনে হয় যে, এ-তো সাধারণ কোন আটপৌরে স্যাঁতসেতে মানুষের ভাবনাপ্রসূত বিষয় হতে পারে না। সাধারণ কোন মানুষের মস্তিষ্ক দিয়ে কাব্যের এমন অপার অসামান্য সৌন্দর্য বেরুতেই পারে না। কখনই না, কোনভাবেই না। ঠিক এমন মুহূর্তেই কবি জীবনানন্দের কথা মনে পড়ে। তিনি তো যথার্থ কথাটিই বলেছেনÑ সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।
কবি জসীম উদ্্দীন [১৯০৩Ñ১৯৭৬] এমনই একজন অবিসংবাদিত মাধুর্যবান কবি। অন্তর থেকে উৎসারিত হয় যার শব্দের জলতরঙ্গ ও উপমা-উৎপ্রেক্ষারূপ সৌন্দর্যময় একেকটি মণিমুক্তা; মনের ভেতরে বাস করে যার অযুত মানুষের মন। চোখ যার নিবিষ্ট থাকে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে। প্রকৃতি, নর-নারীর সৃষ্টি-রহস্যের অপার সৌন্দর্য আর মানুষে মানুষে হার্দিক সম্পর্ক যার তৃষ্ণার পেয়ালা। জসীমউদ্দীনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থখানিই এইসকল অতিকথনের জ্বলজ্বলে পোস্টার। এই কাব্যগ্রন্থটির ঘটনাপ্রবাহ কেবল বাংলা ভাষাভাষিদের নয়, জয় করতে সক্ষম হয়েছে বিশ্বের অসংখ্য সাহিত্যপ্রেমিকের অন্তর। আর এই কাব্যগ্রন্থটি পড়ে মনে হয়, কবিতা আসলে অন্য কিছু নয়, বরাবরই একটি ঐশ্বরিক শক্তি। একজন সাধারণ মানুষ সে যতই সাধনা করুক না কেন, নক্সী কাঁথার মাঠের মতো করে মানুষের জীবনচিত্র ফুটিয়ে তোলা কি আদৌ সম্ভব? নক্সী কাঁথার মাঠ -এ প্রকাশ পেয়েছে মানবমনের গহীন অরণ্যের চরম ধারাবাহিকতা এবং পরম পরম্পরা। এই একই কাব্যে একইসঙ্গে প্রকট হয়েছে মানবপ্রেম ও অপ্রেমের চরম পরাকাষ্ঠা। কাব্যটির পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মানুষের হাসি-কান্না, দুঃখ-ভালোবাসা, জয়-পরাজয়ের চরম উচ্ছ¡াস ও উৎকণ্ঠা।
কাব্যটির প্রধানতম সার্থকতা এইযে, এটি গ্রামের সহজ-সরল-অবোধ মানুষের জীবনযাপনের প্রামাণ্য দলিল। এই মানুষগুলো যেমন অতি সহজেই যখন-তখন অপরের প্রতি ভালবাসায় গদগদ হয়ে উঠতে পারে তেমনি অন্যের ওপর চড়াও হতেও সময় বা অপরিহার্য কোন কারণের প্রয়োজন হয় না। অনেকটা বলা যায়, এই মেঘ ও এই বৃষ্টির মতো ঘটনা। সকালে দেখা যায় এদের গলায় গলায় মাখামাখিরকমের পিরিতি, বিকেলেই কাঠে-কুড়ালে লড়াই। ভালোবাসা আর হিংসা এদের হৃদয়ে পাশাপাশি বাস করে। নক্সী কাঁথার মাঠ কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্র রূপাই। প্রকৃতি লালিত মৃত্তিকার সন্তান সে। মাঠ, মাটি, নদী, ধানখেত; এদের সঙ্গেই তার অহোরাত্র মিতালি। গ্রামের মানুষ আর প্রকৃতির ভালোবাসায় আস্তে-ধীরে যুবক হয়ে উঠেছে সে। মানুষ আর প্রকৃতির সঙ্গে হয়েছে একাকার। ঘটনা¯্রােতে কোন একদিন পাশের গ্রামে যায় বাশঝাড় থেকে বাঁশ কাটতে। সেখানে এই গ্রামেরই যুবতি কন্যা সাজুর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। রূপাইয়ের দূর সম্পর্কের খালা এই সাজুর মা। সাজুর মায়ের সঙ্গেও রূপাইয়ের কথা হয়; এখানে রূপাইয়ের আন্তরিক আদর-যতেœর অন্ত নেই। কবির ভাষায়:
রূপাই বলে, ‘মা দিয়েছেন কোচায় বেঁধে চিড়া’
‘ওমা, তুই বলিস কিরে? মুখখানা তোর ফিরা।
আমি হেথা থাকতে খালা, তুই থাকবি ভুখে,
শুনলে ’পরে তোর মা মোরে দুষবে কত রুখে!
ও সাজু, তুই মোরগ ধরগে যেয়ে বাড়ি,
ওই গাঁ হতে আমি এদিক দুধ আনি এক হাঁড়ি।’
কবি জসীম উদ্্দীন এদেশের প্রান্তিক মানুষগুলোর এই যে, একে অপরের প্রতি আন্তরিকতা, সহমর্মিতা, ভালোবাসা তুলে ধরেছেন, যা একেবারেই যথার্থ, খাঁটি ও অনবদ্য।
কাব্যটির ঘটনাপ্রবাহে সাজু-রূপাইয়ের প্রেম হয় এবং সে প্রেম বিয়ে পর্যন্তও গড়ায়। কিন্তু গ্রাম্য কায়জার ফাঁদে পড়ে রূাইয়ের খুনের আসামী হয়ে জেলখানায় আটকা পড়ে। এদিকে বিরহিণী সাজু বিরহের জ্বালা সইতে না পেরে তিলে তিলে, ধুকে ধুকে মৃত্যুর প্রহর গোনে; একসময় তার মৃত্যুও হয়। এদিকে জেল থেকে ফিরে রূাইয়ের আহাজারির শেষ থাকে না। সাজুর বিরহে রূপাইয়ের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। এভাবে তাজা দুটি প্রেমিকপ্রাণ নিঃশেষ হয়ে যায়। এ জনপদের মানুষের মনে তারা স্থান পায় চিরন্তণ অমর প্রেমিক জুটি হিসেবে; যে প্রেমিক জুটি আজও মানুষকে সমানভাবে ভাবায়, কাঁদায়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।