হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
রাজনীতি হচ্ছে রেস্টলেস বা অবিশ্রান্ত কর্ম। এর কোনো থামাথামি নেই। এখানে স্থবিরতাই মৃত্যু, গতিই জীবন। কোনো রাজনৈতিক দলের যতই জনসমর্থন থাকুক না কেন, যদি তার কর্মসূচি ও কর্মচাঞ্চল্য না থাকে তবে তা স্থবির হয়ে পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশে প্রধানত দুটি রাজনৈতিক দল। একটি আওয়ামী লীগ, অন্যটি বিএনপি। পালাবদলের মাধ্যমে এ দুটি দলই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতায় ছিল এবং আছে। ভবিষ্যতেও ক্ষমতায় যাবে বা থাকবে। স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এর ব্যত্যয় ঘটার সুযোগ খুব কম। দল দুইটিও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একে অপরের মূল প্রতিপক্ষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে প্রধানত দুইটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতার রাজনীতিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। একটি দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দেশগুলোর শাসন ব্যবস্থা আবর্তিত হয়। বাংলাদেশেও এ ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলছে এবং চলবে বলেই মনে হয়। তবে এটা নির্ভর করে দল দুইটির মধ্যকার আদর্শ ও জনকল্যাণমুখী কর্মসূচির মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে কতটা আকর্ষণ করা যায়, তার উপর। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও কর্মসূচিকে সামনে রেখে রাজনীতি করছে। প্রশ্ন উঠেছে, আওয়ামী লীগ যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে রাজনীতি করছে, বিএনপি কি জিয়াউর রহমানকে সামনে রেখে সেভাবে রাজনীতি করতে পারছে? আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে ব্যাপকভাবে তরুণ প্রজন্মের সামনে নিয়ে এসেছে। এর বিপরীতে বিএনপি তার প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে সেভাবে তুলে ধরতে পারছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। এটা অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যেভাবে রাজনীতি করছে, বিএনপি সেভাবে পারছে না বা তাকে করতে দেয়া হচ্ছে না। বিএনপি বেশ কয়েক বছর ধরেই অভিযোগ করে আসছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার প্রশাসন বিএনপিকে প্রকাশ্য রাজনীতি করতে দিচ্ছে না। মাঠে নামলেই গুলি করে। সভা-সমাবেশের অনুমতি দেয় না। একটা সময় পর্যন্ত দেশের মানুষ ও দলটির সাধারণ সমর্থকরা তা বিশ্বাস করেছে এবং মেনেও নিয়েছে। তবে যারা সচেতন তারা এটাও মনে করছে, সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে বিএনপি তার প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের আদর্শ, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যকে আঁকড়ে ধরে এবং ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর কর্মসূচি নিতে পারত। ক্রিকেট খেলায় পেশাদার দল ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়লে কেউ না কেউ কোনো না কোনোভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে বিপর্যয় সামাল দেয়। খারাপ সময়কে ধৈর্য্যরে সাথে মোকাবেলা করে নতুন কৌশল নির্ধারণ করে। রাজনীতিতে যে কোনো দলের উপর বিপর্যয় আসা স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগও অনেক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে প্রায় নিঃশেষ অবস্থার মধ্যে চলে গিয়েছিল। ধৈর্য্য ও কৌশলের মাধ্যমে দলটি সেখানে থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। মূল আদর্শ ও তার বাস্তবায়নের কর্মসূচি নিয়ে মানুষের কাছে বারবার গিয়েছে। দিনের পর দিন মানুষকে বুঝিয়েছে। শুনতে না চাইলেও শুনিয়েছে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপিও ভয়াবহ দুর্দশার মধ্যে পড়েছিল। দলের অনেক নেতা দল ছেড়ে এরশাদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। দল একেবারে নাজুক পরিস্থিতিতে চলে গিয়েছিল। সাংগঠনিক অবস্থা বলতে তেমন কিছু ছিল না। এ অবস্থায় দলটির হাল ধরেন বেগম খালেদা জিয়া। জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও কর্মসূচি সামনে নিয়ে তিনি রাজপথে হাঁটতে থাকেন, মানুষের দুয়ারে দুয়ারে যান। মানুষের মন জয় করে হয়ে উঠেন ‘মা, মাটি ও মানুষের’ নেত্রী। এরশাদের বিরুদ্ধে নয় বছর রাজপথে আন্দোলনের পাশাপাশি মানুষের কাছে দলের আদর্শ ও কর্মসূচি পৌঁছে দেন তিনি । সাধারণ মানুষের কাছে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। এরশাদের পতনের পর অত্যন্ত দুর্বল সাংগঠনিক শক্তি নিয়েও অভাবনীয়ভাবে দলটি ক্ষমতায় আসে শুধুমাত্র খালেদা জিয়ার ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের গুণে। অথচ তখন বিএনপির লোকজনেরও প্রস্তুতি ছিল তারা বিরোধী দলের আসনে বসবে, আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হবে। ভোটে এ হিসাব উল্টে যায়। এর কারণ সাধারণ মানুষের কাছে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও বিপুল জনপ্রিয়তা এবং বেগম খালেদা জিয়ার পরিশ্রমী কর্মকান্ড ও আপসহীন নেতৃত্ব। এ ধারাবাহিকতায় দলটি আরও দুইবার ক্ষমতায় আসে। দলটি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে দলটি যেন অনেকটা দিকভ্রান্ত ও এলোমেলো হয়ে পড়ে। ক্ষমতাসীনদের কূটকৌশল ও নিপীড়ন-নির্যাতনের মধ্যে পড়ে সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তারপরও দলটির জনসমর্থনে ভাটা পড়েনি। ভাটা পড়ে সাংগঠনিক কার্যক্রমে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক স্বীকার করে বলেছেন, সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হলেও বিএনপির ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। তারপরও বিএনপির মতো জনসমর্থিত একটি দল কেন ঘরোয়া দলে পরিণত হলো? এ প্রশ্নের উত্তরে বিএনপির নেতা-কর্মীরা হয়তো সেই পুরনো উত্তরই দেবেন। সরকার রাস্তায় নামতে দেয় না, নির্যাতন করে। তাহলে কি বিএনপি ঘরেই বসে থাকবে? ঘরে বসে বসেই ক্যামেরার সামনে কথা বলবে? প্রশ্ন উঠতে পারে, যদি আগের মতো এত টেলিভিশন, পত্রিকা, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম না থাকত, তাহলে তাদের এসব কথা সাধারণ মানুষের কছে কীভাবে পৌঁছত? রাজনীতির মাঠেও নাই, মিডিয়াও নাই-এ অবস্থায় দলটি কী করত? হাতগুটিয়ে বসে থাকত? অথচ রাজনীতির মূল কথাই হচ্ছে, সরাসরি সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়া। এটা কোনো সিনেমা বা নাটক নয় যে ঘরে বসে উপভোগ করার বিষয়। মানুষ চায় নেতাদের সামনাসামনি দেখতে, তাদের সাথে হাত মেলাতে, কথা বলতে। বিএনপিতে এখন রাজনীতির এ চর্চার অনুপস্থিতি খুবই চোখে পড়ছে। বিএনপির চারদেয়ালের এই রাজনীতি যদি চলতে থাকে, তবে তাদের এবং সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী আগামী নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য করে তোলার বিষয়টি কঠিন হয়ে পড়বে।
দুই.
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতাসীন হন, তখন রাজনীতি বুঝতেন না। কীভাবে রাজনীতি করতে হবে এবং সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে, এ সম্পর্কে কোনো ধারনা ছিল না। একজন আর্মি ম্যান হিসেবে এ ধারনা না থাকাই স্বাভাবিক। যুদ্ধক্ষেত্রে কীভাবে নেতৃত্ব দিতে হবে, যুদ্ধ কৌশল কী হবে এবং কীভাবে জয়ী হতে হবে-এ সম্পর্কে তাঁর দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। তবে রাজনীতির মাঠে ছিলেন একেবারেই আনকোরা ও অনভিজ্ঞ। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর কীভাবে রাজনীতি করতে হবে এবং জনগণের কাছে পৌঁছতে হবে, এ ব্যাপারে জানতে তিনি প্রখ্যাত রাজনীতিক মশিউর রহমান জাদু মিয়ার কাছে গিয়েছিলেন। জাদু মিয়া বুঝতে পেরেছিলেন, স্বল্প সময়ে রাজনীতির বিশাল বিষয় জিয়াউর রহমানকে শেখানো যাবে না। তিনি তাঁকে ছোট্ট ও সংক্ষিপ্ত একটি টিপস দিয়ে বলেছিলেন, হাঁটেন। জিয়াউর রহমান তাঁর এ কথা বুঝতে পারেননি। জাদু মিয়া বলেছিলেন, আপনার একটাই রাজনীতি আর তা হচ্ছে, ‘হাঁটা’। পথে, ঘাটে, মাঠে হাঁটতে থাকেন। জিয়াউর রহমান, জাদু মিয়ার এই সহজ সূত্র ধরেই হাঁটা শুরু করেন। গ্রামের পর গ্রাম হাঁটতে থাকেন। প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো জায়গায় গিয়ে হাঁটেন। তার সাথে থাকা সরকারি আমলা থেকে শুরু করে দলের নেতা-কর্মীরাও হেঁটে কুলাতে পারতেন না। জিয়াউর রহমানা মাইলের পর মাইল হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের অতি সাধারণ মানুষের সাথে হাত মেলানো, দাঁড়িয়ে কথা বলা, কারো বাড়িতে হুট করে ঢুকে পড়া শুরু করেন। মেঠোপথ ধরে, বাড়ির আঙ্গিনা দিয়ে দেশের প্রেসিডেন্টের এমন চলাফেরায় সাধারণ মানুষ অভিভূত হয়ে পড়েন। তারা তাঁকে অতি আপন করে নেন। তিনি হয়ে উঠেন মাটি ও মানুষের নেতা। একজন সামরিক বাহিনীর লোকের পক্ষে একেবারে সাধারণ মানুষের পর্যায়ে নেমে এসে নেতা হওয়া সহজ ব্যাপার নয়। জিয়াউর রহমান অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করে জনমানুষের নেতা হয়েছিলেন। তিনি খাল কাটার কর্মসূচি নিয়ে নিজে কোদাল হাতে নেমে পড়েন। সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করেন। স্বল্প সময়ের শাসনকালে (দুই বছরের কিছু সময় বেশি) তিনি সারা দেশে ৯২ হাজার খাল কাটেন। এই কর্মসূচির ফলে বন্যা হতো না, বন্যার পানি খাল দিয়ে বের হয়ে যেত। শীতকালেও খালে পানি থাকত। ক্ষেতে পানি দেয়ার সংকট হতো না। এই খাল কাটতে গিয়ে সরকারি অর্থ তেমন খরচ হয়নি। জনগণকে ডেকে এনে স্বেচ্ছাশ্রম ভিত্তিতে খাল কেটেছেন। দেশের অশিক্ষা দূর করার জন্য সন্ধ্যার পর গ্রামে গ্রামে গিয়ে হারিকেন জ্বালিয়ে নিজে বø্যাকবোর্ডে বর্ণমালা লিখতেন। বাংলাদেশের মানুষ যে স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন ভূখন্ডের মালিক এটা বোঝানোর জন্য ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’-এর দর্শন তুলে ধরেন। ইংরেজি ভাষায় কথা বললেই যেমন একজন অস্ট্রেলিয়ান, আমেরিকান বা অন্য কোনো দেশের অধিবাসী ইংরেজ জাতি হয়ে যায় না, তেমনি বাংলা ভাষায় কথা বললেই যে বাংলাদেশী হয়ে যায় না-এটাই তার জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র ছিল। বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশী এবং স্বাধীন ও স্বতন্ত্র জাতিÑএ বোধ মানুষের মধ্যে তিনি জাগিয়ে তুলেছিলেন। দেশের মানুষ তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে ধরে। তাঁর এই দর্শন প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলও উপেক্ষা করতে পারেনি। পাসপোর্টে নাগরিকত্ব বাঙালি নয় ‘বাংলাদেশী’ই রাখা হয়েছে। দেশকে উন্নত এবং মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে তুলে ধরার জন্য জিয়াউর রহমান ১৯ দফা কর্মসূচি দিয়েছিলেন। এই ১৯ দফা দেশের মানুষ বিপুলভাবে গ্রহণ করেছিল বলেই তাঁর গড়া দল বিএনপিও মানুষের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। পরবর্তীতে এরশাদও তাঁর অনুকরণে ১৮ দফা দিয়েছিলেন। তবে জিয়াউর রহমানের দর্শন, আদর্শ ও কর্মজীবন বিএনপির এ সময়ের নেতা-কর্মীরা কতটা ধারণ করে বা করতে পারছে, তা নিয়ে দ্বিধার অবকাশ রয়েছে। মাঝে তার পুত্র তারেক জিয়া কিছুটা শুরু করলেও নানা ঘটনাচক্রে পড়ে ছিটকে যান। এছাড়া আর কোনো নেতাকে জিয়াউর রহমানের মতো রাজনীতি করতে খুব একটা দেখা যায়নি। অথচ হওয়া উচিত ছিল জিয়াউর রহমানের পথ অনুসরণ করে নেতাদের দেশের পথে পথে হাঁটা, সাধারণ মানুষের সাথে মেশা, বাড়িতে গিয়ে হাজির হওয়া। তাঁর এ কাজটি দলের কেউ এখন করেন বলে মনে হয় না। জিয়াউর রহমানের রাজনীতির কিছুটা ছায়া দেখেছিলাম, বিএনপির সাবেক মন্ত্রী মরহুম মীর শওকত আলীর মধ্যে। ’৯১ সালে তিনি রাজধানীর লালবাগ থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি থাকতেন ইস্কাটনে। অথচ প্রতিদিন তিনি তার নির্বাচনী এলাকায় যেতেন। সন্ধ্যার পর লালবাগ গিয়ে নেতা-কর্মীদের নিয়ে অলি-গলিতে হাঁটতেন। মানুষের বাড়ির সামনে গিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে মানুষের খোঁজ নিতেন। ঘরের দরজায় মন্ত্রীকে দেখে বাসিন্দারা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়তেন। অতি সাধারণ সেলুনে গিয়ে চুল কাটাতেন, দোকানদারদের সাথে বসে চা খেতেন। তার এই মাটিঘেঁষা রাজনীতির কারণে তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকায় বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। এখনো ঐ এলাকার মানুষ তাঁকে স্মরণ করে। আসলে রাজনীতি করতে হলে এমন রাজনীতিবিদই হওয়া উচিত। মীর শওকতও একজন আর্মি অফিসার ছিলেন। তবে তিনি জিয়াউর রহমানের পথ ধরেছিলেন এবং তা অনুসরণ করেছিলেন বলেই এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।
তিন.
সময়ের সাথে রাজনীতির ধরণ ও কৌশল বদলানো স্বাভাবিক। তবে দলের আদর্শ ও দর্শনকে মূল ভিত্তি ধরেই পরিবর্তন আনতে হয়। নেতৃত্ব বদল হতে পারে, তবে আদর্শ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক থাকা জরুরী। বীজ যদি ঠিক না থাকে, তবে ভাল ফল আশা করা যায় না। অনেক দিন ধরেই একটা কথা প্রচলিত, বিএনপি জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও দর্শন থেকে সরে গেছে। এজন্যই দলটির উপর বিপর্যয় নেমে এসেছে। প্রতিপক্ষও সুযোগ পেয়েছে জিয়াউর রহমানকে নিয়ে ব্যাপক অপপ্রচার এবং বদনাম করার। এমনকি জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তানের চর এবং স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করতেও দ্বিধা করছে না। অথচ জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে প্রথমে নিজেকে ‘হেড অফ স্টেট’ পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি সেক্টর কমান্ডার হন, মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন জেড ফোর্সের প্রধান হন, বীর উত্তম খেতাব লাভ করেন। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ গ্রন্থের ১৭২ পৃষ্ঠার এক অংশে লিখেছেন, ‘মেজর জিয়াউর রহমান নামের মানুষটার জন্যে গর্বে আমাদের বুক ফুলে উঠল।’ মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ঐতিহাসিক ভূমিকা চিরকালের জন্য রেকর্ড হয়ে আছে। অথচ এ সত্য এড়িয়ে তাঁকে নিয়ে ক্রমাগত অপপ্রচার নতুন প্রজন্মের মধ্যে দ্বিধার জন্ম দিচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতা-কর্মী দলের আদর্শ ও লক্ষ্য এমনভাবে আঁকড়ে ধরে আছে যে, জীবন গেলেও এ থেকে তাদের বিচ্যুতি ঘটবে না। তাদের মনোভাব এমন যে, তাদের একজন কর্মী প্রতিপক্ষের দশ জন কর্মীর সমান। দুঃখের বিষয়, বিএনপির নেতৃবৃন্দ জিয়াউর রহমানকে নিয়ে অপপ্রচারের যৌক্তিক জবাব যেমন দিতে পারছে না, তেমনি জিয়াউর রহমানের আদর্শ এবং দর্শনও নতুন প্রজন্মের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হচ্ছে না। বরং ক্ষমতাসীন দলের রোষানলে পড়ে দলটির অনেক নেতার মধ্যে ভেতরে ভেতরে আপসকামী হয়ে উঠার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। তাদের প্রবণতা দেখে মনে হতে পারে, তারা মন্ত্রী-এমপি হওয়ার জন্যই বিএনপিতে এসেছিলেন এবং বিএনপি করছেন। জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও দর্শন তাদের মূল লক্ষ্য নয়। এর বিপরীত চিত্র দেখা যায় আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে থাকে। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা তাদের আদর্শ ও লক্ষ্যে অবিচল থাকে। বিএনপির অনেকে বলতে পারেন, তখন রাস্তায় নামলে গুলি করা হতো না, এখন করা হয়। এর জবাবে বলা যায়, রাজনীতি একটা অদৃশ্য যুদ্ধও বটে! যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের আক্রমণের ধরণ দেখে কৌশলে পরিবর্তন আনতে হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি যে আন্দোলন করে এবং তাতে যে স্যাবোটাজ হয়, তার দায়দায়িত্বও দলটির উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ক্রমাগত প্রচার সাধারণ মানুষের মধ্যেও সংশয়ের সৃষ্টি হয়। এই প্রপাগান্ডার জবাব বিএনপি কার্যকরভাবে দিতে পারেনি। সম্প্রতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও বলেছেন, বিএনপি এই স্যাবোটাজের ঘটনা জনগণকে বোঝাতে পারেনি। ফলে এর রেশ দলটিকে এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। অথচ সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে গুছিয়ে উঠে জনসাধারণের কাছে যাওয়া এবং তাদের বোঝানোর জন্য যে ধরনের রাজনৈতিক কৌশল প্রয়োজন, তা দলটি যথাযথভাবে করতে পারছে না। যদি ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের বাধা উপেক্ষা করে বা বাধার মুখে পড়লে, সাধারণ মানুষ যেমন বিএনপির প্রতি আরও বেশি সহনুভুতিশীল হতো, তেমনি সরকারের প্রতি আরও বিরূপ ধারণা পোষণ করত। সাধারণ মানুষ সরকারের উপর চরম বিরক্ত হলেও এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে বিএনপিকে মনে করলেও তাদের মধ্যে বিএনপিকে নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। অনেককে বলতে শুনেছি, বিএনপির দ্বারা আসলে কি কিছু হবে? অর্থাৎ একমাত্র বিএনপিই পারে সরকারের ব্যর্থতার জবাব দিতে-এ বিশ্বাস রেখেও তারা দ্বিধা প্রকাশ করছে, শুধুমাত্র সরকারের কৌশল মোকাবেলায় দলটির যথোপযুক্ত রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন না করায়। সাধারণ মানুষের এই অনুভূতি কতটা বিএনপি উপলব্ধি করতে পারছে, তা তার কর্মকান্ডে খুব একটা প্রকাশিত হচ্ছে না। অথচ সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতনে ভীত হয়ে থাকলে রাজনীতি হয় না। সাধারণ মানুষও জানে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলকে দাবী আদায়ে আন্দোলন করতে গিয়ে সরকারের হাতে মার খেতে হয়। এছাড়া কখনো দাবী আদায় করা যায়নি।
চার.
বিএনপির সুহৃদ হিসেবে পরিচিত বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রায়ই বিএনপিকে উদ্দেশ করে একটা কথা বলেন। তার কথাটি হচ্ছে, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে ঘর থেকে বের হতে হবে। সারা দেশ ঘুরে বেড়াতে হবে। মানুষের কাছে যেতে হবে। তার এ কথার মধ্যে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শ ও দর্শনই ফুটে উঠেছে। তিনি বিএনপিকে জিয়াউর রহমানের রাজনীতিকে ধারণ করতে আহ্বান করেছেন। নিপীড়নমূলক রাজনৈতিক পরিবেশে বিএনপির রাজনীতিকে উজ্জীবীত করতে এটাই এখন মূল মন্ত্র হওয়া উচিত। দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে মাঠে নামতে হবে। জিয়াউর রহমানের মতো সোজা পথ ধরতে হবে। হাঁটার রাজনীতি শুরু করতে হবে। গ্রামের পর গ্রাম চষে বেড়াতে হবে। সরকারের তরফ থেকে যতই বাধা আসুক, থেমে গেলে চলবে না। বাধা পেয়ে মাঠ ছেড়ে যাওয়া যাবে না। মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে। সরকার কত বাধা দেবে, কতক্ষণ বাধা দেবে? কত হামলা-মামলা, গ্রেফতার, নির্যাতন করবে? সরকার তো তা করবেই। সব সরকারের আমলেই বিরোধী দলের উপর কম-বেশি নির্যাতন ও নিপীড়ন হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, মাঠে না থেকেও কি বিএনপির নেতা-কর্মীরা গ্রেফতার-নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে? পাচ্ছে না। তার চেয়ে কি জনগণের কাছে পৌঁছানোর কর্মসূচি দিয়ে গ্রেফতার-নির্যাতনের শিকার হওয়া হওয়া ভাল নয়? বিএনপির নেতৃবৃন্দ সাধারণ মানুষ ও তার বিপুল সমর্থকদের মনোভাব ও মনোবাসনা যদি কান পেতে শোনে তবে তারা এ কথাই শুনবে, ঘরে বসে বক্তব্য-বিবৃতির রাজনীতি নয়, জিয়াউর রহমানের রাজনীতি করুন, তাঁর পথ অনুসরণ করুন, তাঁর মতো সোজা পথে হাঁটুন। মাঠে নামুন, সাধারণ মানুষের সাথে সম্পৃক্ত হোন।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।