Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কিছু আরবের জন্যই উম্মাহর আজ এ দুর্দশা

উবায়দুর রহমান খান নদভী : | প্রকাশের সময় : ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নবী করিম সা. কে আল্লাহ বলেছিলেন, “আপনি চাইলে ওহুদ পাহাড়কে স্বর্ণে পরিণত করে দেই!” প্রিয় নবী সা. জবাবে বলেছিলেন, “আমি দুনিয়া চাইনা, আখেরাতকেই বেছে নিয়েছি।” আমার এক শ্রদ্ধেয়জন কিছুদিন আগে সপরিবারে লন্ডন ঘুরে এসে আমাকে যা বললেন, তাতে আমার মনে জমে থাকা দীর্ঘদিনের মেঘ আরও গভীর ঘনঘটায় রূপান্তরিত হল। তিনি যা বললেন, তা বিশ্বাস করতে প্রতিটি সাধারণ মুসলমানেরই কষ্ট হবে। আমার এই শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি বাংলাদেশের এমন একজন সুপ্রতিষ্ঠিত ও অভিজাত মানুষ যার পরিবার গত ৬০ বছর যাবত সবদিক দিয়েই রাজধানীর নাম্বার ওয়ান পরিবারগুলোর একটি। অবশ্য তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য শতাধিক বছরের। এই শুভার্থী নিজে একজন ভালো বিত্তবান ও তার পরিবারের লোকজন নিজ নিজ জায়গায় কোটিপতি হওয়া সত্তে¡ও লন্ডনে কোনো কোনো পশ এরিয়ায় শপিংয়ে গিয়ে আরবদের সামনে কত যে অসহায় হয়ে যান, সে কাহিনীই আমাকে বললেন। তার ভাষায়, লন্ডনে যেসব জায়গায় ইন্ডিয়ান ও বাংলাদেশীরা কম যান। যেখানে শুধু সাদারাই থাকে বা চলাফেরা করে। সেসব এক্সক্লুসিভ জায়গায় আমরা যখন শপিং করতে যাই, তখন কোনো একটি পছন্দের জিনিস হাতে নিয়ে দেখার চেষ্টা করি, হয়তো কেনার ইচ্ছে হলে এর দাম সম্পর্কে খোঁজ নেই। দাম বেশী হলে কিনবো কি না ভাবতে থাকি। এবার গিয়ে দেখলাম, অনেক সুপার মলে আমরা দু’চার মিনিট দাঁড়ানো বা পছন্দ করার সুযোগটিও পাচ্ছি না। আরবরা দলে দলে এসব দামী মার্কেটে অঢেল কেনাকাটা করছে। নারী পুরুষ শিশুরা পন্যের স্তুপ সংগ্রহ করছে আর ঠেলে নিয়ে বের হচ্ছে। যে পারফিউম এক দুটি কিনতে আমরা পাউন্ডের হিসাব মিলাই, তারা সেসব মুড়িমুড়কির মতো কিনে নিচ্ছে। দামের পরোয়া করছে না। বিভিন্ন আরব দেশের লোক তারা। জর্দান, সিরিয়া, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান, বাহরাইন, মিশর সব দেশেরই বিত্তবানেরা লন্ডনে এসে বসবাস করে, ছুটি কাটায়, বিনোদন করে, কেনাকাটা করে।
মুসলমানরা কমপক্ষে ১৪০০ বছর পৃথিবী শাসন করেছে। আটলান্টিক থেকে চীনের প্রাচীর পর্যন্ত আর উত্তর মেরু থেকে আরব সাগর পর্যন্ত ছিল তাদের রাজত্ব। রাসূল সা. ও চার খলিফার ৩০ বছরের পর উমাইয়াদের শতাধিক বছর, আব্বাসীয়দের ৫০০ বছর, উসমানীয় তুর্কিদের ৭০০ বছর দুনিয়া ছিল মুসলমানের করতলে। আমাদের উপমহাদেশে ৮০০ বছর, বাংলাদেশে প্রায় হাজার বছর মুসলিম কর্তৃত্ব ইতিহাসের সাক্ষী। কিছু উদাসী, অযোগ্য ও বিলাসি শাসক দেখা গেলেও মূল শাসন ব্যবস্থা ছিল ইতিহাসের সফল ও শ্রেষ্ঠতম শাসনব্যবস্থা। এরপর ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন ও তুরস্কের খেলাফত ভেঙে যাওয়া মুসলিম বিশ্বের জন্য বড় ঝাঁকুনি। ১৯১৭ সাল থেকে ২০১৭ এই এক শতাব্দী মুসলমানদের কঠিন পরীক্ষার সময়। কিন্তু এ সময়টি আবার সম্পদ প্রাপ্তিরও সময়। এখন থেকে ৭০/৮০ বছর ব্যবধানে আরববিশ্বের চেহারা এতো দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছে যা ইসলামের দেড় হাজার বছরেও হয়নি। এখানে মহানবী সা. এর একটি হাদীস খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “আমার উম্মতের দারিদ্র্যকে আমি ভয় পাই না, আমার ভয় তাদের বিত্ত কে।”আল হাদীস। মুসলমানেরা যখন পৃথিবী জয় করে তখন তাদের কী অবস্থা ছিল তা আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় এক নজর দেখে নেওয়া যাক, “মুখেতে কলিমা হাতে তলোয়ার, বুকে ইসলামী জোশ দুর্বার, হৃদয়ে লইয়া ইশ্ক আল্লার, চল আগে চল বাজে বিষাণ। ভয় নাই তোর গলায় তাবিজ, বাঁধা যে রে তোর পাক কোরআন। নহি মোরা জীব ভোগ-বিলাসের, শাহাদত ছিল কাম্য মোদের, ভিখারির বেশে খলিফা যাদের, শাসন করিল আধা জাহান। তারা আজ পড়ে ঘুমায়ে বেহুঁশ, বাহিরে বহিছে ঝড় তুফান।.... শুকনো রুটিরে সম্বল করে, যে ঈমান আর প্রাণের জোরে, ফিরেছে জগত মন্থন করে, সে শক্তি আজ ফিরিয়ে আন। ” বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে জনসংখ্যা, অর্থ-সম্পদ, মেধা ও শক্তির কোনো অভাব নেই। কিন্তু নেতৃত্ব ও সমাজের উঁচু পর্যায়ে জাগরণী চিন্তার মারাত্মক অভাব। মুসলিম বিশ্বের কথা যদি চিন্তা করা যায় তাহলে আরব বিশ্বকেই এর মাথা বলতে হয়। বিশেষ করে পবিত্র দুই মসজিদ ও অন্যান্য উৎস স্থান আরবে হওয়ায় মুসলমানরা আরবকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখেন। আমি লেখার শুরুতে আরবদের একাংশের অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য নিয়ে কথা বলেছি। শাসক ও বিত্তবানদের একটি অংশ এই সীমিত সময়ে এতই অবহেলা, উদাসীনতা ও বিলাসিতার প্রমাণ দিয়েছেন যা ভাবতেও কষ্ট হয়। অনেক বিষয় এমন আছে যা বলতেও দ্বিধা হয়। আরবদের অতীত দারিদ্র্য ও সাদাসিধে জীবন সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে জানতাম। তাদের হঠাৎ সম্পদশালী হওয়া ও দ্বীন-ধর্ম, ইতিহাস-ঐতিহ্য ইত্যাদি ভুলে গিয়ে বেসামাল হয়ে যাওয়া নিজের চোখে দেখেছি।
আরব শাসকদের অনেকেই জনকল্যাণ ও বদান্যতায় ছিলেন অসাধারণ। তাদের সামগ্রিক চেতনা ও রাজনৈতিক চিন্তা নিয়ে এখানে আলোচনা না করলেও তাদের ভূমিকা, অবদান ইত্যাদি নিয়ে দুয়েকটি কথা বলতে হচ্ছে। যেমন, বাদশাহ আব্দুল আজিজ। তিনি একবার এক ব্যক্তিকে ১ কোটি রিয়ালের চেক দেওয়ার সময় ভুলে ১০ কোটি লিখে ফেলেন। তার সহকারী বিষয়টির প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘আমি কি আমার কলমের চেয়েও কম উদার হবো? কলম যা লিখে ফেলেছে তাই দিয়ে দাও।’ তার পুত্রদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বিশাল দানবীর। যেমন, বাদশাহ ফয়সাল মুসলিম বিশ্বকে নিয়ে ভাবতেন, প্রচুর সাহায্যও করতেন। বাদশাহ ফাহাদ পবিত্র মক্কা ও মদীনার দুই প্রধান মসজিদকে অকল্পনীয় বাজেট দিয়ে বর্তমান চেহারায় এনেছেন। তার সম্পদের পরিমাণ ছিল অনেক। একবার পৃথিবীর ষষ্ঠ ধনী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। একদল তরুণ হিসাব করে আমাকে জানিয়েছিল, তার যে সম্পদ সব বিলিয়ে দিলে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে ১ লাখ করে টাকা দিতে পারবেন তিনি। যখন মারা যান, বলেছিলেন, পবিত্র দুই হারামের সম্প্রসারণে যে টাকা ব্যয়িত হয়েছে সেগুলোই কাজে লাগবে। বাকীসব অর্থহীন। ওসিয়ত করেছিলেন, মরুভূমিতে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে আমাকে দাফন করে কবরের চিহ্নটুকুও মুছে ফেলবে। বাদশাহ ফাহাদ দুনিায়ায় কেউ একজন ছিল, তাও যেন সবাই ভুলে যায়। বাদশাহ আব্দুল্লাহ মক্কা শরীফের মসজিদে বিপুল অর্থ ব্যয়ে সর্বশেষ সম্প্রসারণটি করেছেন। সিডরের সময় বাংলাদেশে নিজের পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ১ হাজার কোটি টাকা দান করেছিলেন। তারপর বাদশাহ হন সালমান ইবনে আব্দুল আজিজ। সংয্ক্তু আরব আমিরাতের মরহুম প্রেসিডেন্ট যায়েদ বিন সুলতান আলে নাহিয়ান সম্পর্কে আমার এক সৌদি বন্ধু বলেছিলেন, দুনিয়ার কোনো দেশ নেই যেখানে যায়েদ বিন সুলতান আলে নাহিয়ান কোনো কল্যানমূলক প্রতিষ্ঠান করেননি। বিশ্বের সবকটি রাজধানীতেই নাকি তার নির্মিত মসজিদ আছে। একবার তিনি তার ঢাকা সফরের সময় এতিমখানায় টাকা দান করার জন্য রাত ১২ টার পর তার নিয়ন্ত্রনাধীন আন্তর্জাতিক ব্যাংকের ঢাকায় অবস্থিত একমাত্র শাখাটি খুলিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক মানের এ ব্যাংকটি ইসলামের শত্রুদের কুনজরে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়।
আরবদের কোনো বিশ্বমানের ব্যাংক নেই। যদিও বিশ্বের সকল বড় ব্যাংক আরবদের টাকায়ই ভরা। আরব নেতারা মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্র চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদদের কোনো কথাই শোনেননি। উম্মাহর সেরা আলেমদের কারো কথাও কোনোদিন শোনেননি। বহুবছর ধরে বলা হয়েছে মক্কাভিত্তিক সময় চালু করা হোক। মুসলিম বিশ্বে হিজরী সনকে প্রকট করা হোক। বেসরকারী ইসলামী কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সংস্থা করা হোক। মুসলিম জাতিসংঘ, মুদ্রা ব্যবস্থাপনা এমনকি দিনার দেরহাম প্রথা চালু করা হোক। মুসলিম কমন মার্কেট ও সমন্বিত মুসলিম সশস্ত্র বাহিনী তৈরী করা হোক। মুসলিম বিশ্বের উন্নয়ন, শিল্পায়ন ইত্যাদিতে নেতৃত্ব যেন আরবরা দেন। ইসলামী ঐতিহ্য ও ইতিহাস নতুন করে যথাসম্ভব বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে খিলাফতের রূপরেখা জনপ্রিয় করা হোক। অন্তত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অসাধারণ মেধাবি ও প্রতিভাবান লোকদের নাগরিকত্ব দিয়ে আরব দেশগুলোকে উর্বর ও ফলপ্রদ করা হোক। বিশাল ভূখন্ড, বিপুল সম্পদ। আর জনসংখ্যা ১০/২০ লাখ থেকে দেড় দুই কোটি। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিতে সেরা হওয়ার জন্য আরবদের কম বলা হয়নি। শিক্ষা, চিকিৎসা, পর্যটন ইত্যাদিতেও আদর্শ হতে পারতো বিভিন্ন আরব দেশ। মানুষ চিকিৎসার জন্য সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, ভারত ও ইউরোপ-আমেরিকা যায়। তারা যেতে পারতো সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার ও আমিরাত। তারা ধর্মীয় আবেগ থেকে বিশ্বমুসলিমকে পেতেন কম পয়সায় শ্রম দিতে প্রস্তুত। বিভিন্ন পেশাজীবী সাধারণ সম্মানিতেই কাজ করতো আরবদের সাথে। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। অবশ্য তাদের সভ্যতা নির্মাণে বিভিন্ন দেশের মুসলমান কাজ করেছে। দরিদ্র্য হিসেবে জীবন ধারণের সুবিধা পেয়েছে। বারবার তারা শুনেছে ও বুঝেছে যে তারা মিসকিন। বেতন সর্বনিম্ন, কাজে অনিশ্চয়তা, সামাজিক লাঞ্ছনা ইত্যাদি নিয়েই কোটি কোটি মুসলমান তাদের সেবায় লেগে আছে। ইসলাম দ্বারা আলোকিত যে সমাজ শান্তির, সে সমাজেরই কোনো কোনো স্থান বিপুল অন্ধকারে ঢাকা। নারী শ্রমিক ও গৃহকর্মী বিষয়ক আলোচনাই মুসলমানদের মাথা হেঁট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। বহু দশকেও নাগরিকত্ব, গ্রীণকার্ড বা অভিবাসন সুবিধা নেই বললেই চলে। প্রবাস জীবনটিও ঘোর অনিশ্চয়তায় ভরা। একটি রোবটকে নাগরিকত্ব প্রদান হয়তো অনেক প্রগতির নিদর্শন তবে ঘটনাটি কোটি কোটি মুসলমানের প্রতি একটি নির্মম মশকরা। যে ঘটনা ঘিরে থাকবে কোটি মুসলমানের দীর্ঘ নিঃশ্বাসে। বাংলাদেশে নানা দুর্যোগে যত বিদেশী সাহায্য এসেছে এরমধ্যে সৌদি আরবের সাহায্য সবচেয়ে বেশী। অবশ্য পৃথিবীতে অন্যদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে আমেরিকা এগিয়ে। এবছর তুরস্ক সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। যদি আরবরা চাইতেন তাহলে বাংলাদেশকে কিছু টাকা পয়সা দিতে পারতেন। ধরুন ১৫ লক্ষ কোটি টাকা। এদিয়ে বাংলাদেশ দশ বছরে কোথায় গিয়ে পৌঁছবে তা কল্পনাও করা যায় না। কারণ, এর পাশাপাশি গড়ে আরো বিশ লক্ষ কোটি টাকা তার নিজের বাজেটও থাকবে। বাংলাদেশ মালয়েশিয়া হতে পারে যদি আরবরা একটু নজর দেন। এদেশে পশ্চিমাদের সাহায্য সংস্থা আছে, বড় বড় এনজিও আছে, চীন জাপান মৈত্রী সেতু ও স্থাপনা আছে। কিন্তু সাহায্য সংস্থা, এনজিও ও মৈত্রী কার্যক্রম নেই আরবদের। যা আছে তা খুবই সীমিত। হয়তো মসজিদ নির্মাণ, কোরবানী, নলক‚প, কোরআন বিলি আর কিছু স্বার্থবাদী আলেম নামধারী ব্যক্তিকে সামান্য মাসোহারা। যারা এদেশের ৯০ ভাগ মুসলমানের স্বীকৃত ফিকাহকে অস্বীকার করে নতুন ধরনের কট্টরবাদী ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচারে আদিষ্ট।
এদেশের উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ আনার চেষ্টায় গত ৩২ বছর আমি অক্লান্ত কাজ করেছি। অন্তত ৩ বার কল্পনাতীত বিশাল অংকের বিনিয়োগ আনতে প্রায় সফল হয়েও গিয়েছিলাম। কিন্তু দেশের ২ রাষ্ট্রনায়কের খুব কাছের মানুষেরা কেন জানি খুব সংকীর্ণ মনের পরিচয় দিয়ে আমার সব আয়োজন ভন্ডুল করে দিয়েছিলেন। আরবরাও পিছিয়ে গিয়েছিল। এরপরও আমার চেষ্টা থেমে নেই। আমার পেশা ভাবনা ও মিশনের সাথে খাপ না খেলেও আমি আরবদের মাঝে প্রায় ৩ যুগ ধরে কাজ করছি। কিছু আরবের দুর্মতি উম্মাহকে ভয়াবহ কষ্টের মধ্যে ফেলে রেখেছে। আমেরিকায় কিছু রাজ্য এমন আছে যেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও অসাধারণ নৈসর্গিক প্রশান্তি তুলানাহীন। সেসব জায়গায় বাড়ি করা বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনীদের স্বপ্ন। এধরনের শতশত বাড়ির মালিক আরবরা। স্পেন, ফ্রান্স, বৃটেন, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদিতে অভাবনীয় মূল্যবান ভিলা, প্রাসাদ ও বাগান বাড়ির মালিক আরবরা। যেখানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনবান ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা ছোট্ট একটি ফ্ল্যাট কিনতে পারলেও গর্ববোধ করে। আরব বাদশাহরা যখন কোথাও অবকাশ যাপনে যান তখন তারা যে অর্থ ব্যয় করেন সেটা দিয়ে বাংলাদেশের সব হাসপাতাল ৩ বছর চলতে পারে। বাদশাহ সফরে যান সঙ্গী থাকেন ২৫০০ আত্মীয়, আমির ও প্রিন্স। সমুদ্রের গোটা সৈকত ভাড়া করে ফেলেন। তারকা হোটেল ২/৪ টি একমাসের জন্য ভাড়া করে নেন। নিজেদের বিমানে করে বিদেশে যান। বাদশাহ তার স্যুটের আসবাবপত্র এমনকি তৈজসপত্রও সাথে নিয়ে যান। অথচ একই সময় পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী পশ্চিমারা জিন্স ও টি শার্ট পরে জীবন কাটায়। সাধারণ মানুষের সাথে মিলে মিশে চলে। সম্পত্তি পারলে সবটুকুই মানব কল্যানে ব্যয় করে দেয়। ইউরোপ-আমেরিকার রাষ্ট্র নেতারা কোথাও গেলে নিরাপত্তার জন্য হয়তো স্বতন্ত্র ব্যবস্থা নেন তবে হোটেলে স্পেশাল কক্ষ নিয়েই তারা সন্তুষ্ট থাকেন। আরবদের মতো এমন অহেতুক ব্যয় আর কোথাও দেখা যায় না। তাদের বিমানের সিঁড়িটি ২৪ ক্যারেট সোনায় মোড়া। মনকে মন স্বর্ণ ব্যবহার করে সোনার গাড়ি তৈরি করে আনান। তারা শিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী অর্থ দিয়ে শিল্পীর আঁকা ছবি কিনেন। কোনো কোনো প্রিন্স সোনার কমোডে পায়খানা করেন। বিমানের ইন্টেরিয়র সাজসজ্জায় যত পারেন স্বর্ণের ব্যবহার করেন। গাড়ির কথা কী বলবো? একজন বাদশাহর পরিবহন পোলে ১০০ টি রোলস রয়েস ছিল। যেসব বিশেষভাবে তৈরী। স্বর্ণ ও হীরার ব্যবহার যত্রতত্র করা হয়েছে। অনেক গাড়ি এমনও আছে যা আমেরিকা, জার্মানি, সুইডেন, ফ্রান্স ও জাপান তৈরীই করে শুধু আরবদের জন্য। বিলাসিতা ও অপচয় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সাধারণ মানুষও কৃচ্ছতা ভুলে গেছে। একজন বাদশাহ বা ধনকুবের যদি তার টাকার ১০ ভাগের ১ ভাগও দান করতেন তাহলে বাংলাদেশের সব রাস্তাঘাট হয়ে যেত। প্রতিটি গ্রামে বিদ্যুত যেত। কিন্তু এসব তাদের মাথায় আসেনা। তারা যদি এদেশের ব্যবসায় বিনিয়োগ করতেন, যদি এদেশের ব্যাংকে তাদের কিছু টাকাও জমা রাখতেন তাহলেও বাংলাদেশ বহু আগেই দাঁড়িয়ে যেত। শুধু বাংলাদেশ কেনো? রাবাত থেকে জাকার্তা পর্যন্ত প্রতিটি মুসলিম দেশ উঠে দাঁড়াতো। বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা ১৭০ কোটি মুসলমানই মানুষের মতো বাঁচতে পারতো।
লেখাটি শুরু করে মনে হলো আমি কষ্টের সমুদ্রে সাঁতার দিয়েছি। কোন্ বিষয়ে কী বলবো ক‚ল কিনারা করতে পারছিনা। বুকে ফিলিস্তিনের ব্যথা, জেরুজালেম চলে গেল প্রায়, লিবিয়া শেষ, সিরিয়া শেষ, ইরাক ছিন্নবিচ্ছিন্ন, ইয়েমেনে মানবতার শেষ নিঃশ্বাস বইছে। সৌদি আরব, মিশর, জর্দান, কুয়েত, কাতার, ইউএই ইত্যাদির আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছে ক্ষুধার্ত শকুন। এই লেখা শেষ হবে না। নানা রূপ, নানা প্রসঙ্গ মিলিয়ে আরো হাজারো কথা বলতে হবে। এই মুহূর্তে মহানবী সা. এর একটি হাদীস দিয়ে লেখাটি শেষ করে ফেলা যাক। শিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রই জানেন হাদীসে জিবরীলের কথা। যেখানে হযরত জিবরাইল আ. নবী সা. কে সাহাবীদের মজলিসে প্রকাশ্যে সাক্ষাত দিয়েছিলেন। বর্ণনাকারী সাহাবী বলেন, “একদিন আমরা রাসুলের সা. দরবারে বসা ছিলাম। হঠাৎ করেই ১ জন লোক সেখানে এসে উদিত হলেন। সুদর্শন যুবক, ঘন কালো চুল, পরনের কাপড় ধবধবে সাদা, তার চেহারায় ভ্রমণ বা ক্লান্তির কোনো ছাপ ছিল না ( যা মরু আরবে কল্পনাও করা যায় না)। লোকটি রাসুলের সা. এতো কাছে এসে বসলো যে, রাসুলের সা. হাঁটুর সাথে তার হাঁটু প্রায় মিলে গেল। লোকটি রাসুল সা. কে কয়েকটি প্রশ্ন করলো। জবাবে রাসুল সা. বললেন, “যাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে তিনি প্রশ্নকর্তার চেয়ে এই মুহূর্তে বেশী জানেন না।” কথাটি শুনে বিস্মিত হলেন। পরে অবশ্য রাসুল সা. তাদের বলে দিয়েছিলেন যে, ইনি জিবরাইল। তোমাদের মাঝে এসে ছিলেন, তোমাদের দ্বীন শিক্ষা দিতে। হাদীস অনেক দীর্ঘ। প্রশ্ন ছিল, ঈমান কী? ইসলাম কী? ইহসান কী? শেষ প্রশ্ন ছিল, আমাকে কিয়ামতের আলামত সম্পর্কে কিছু বলুন। জবাবে বলা হয়েছিল, “........... কিয়ামতের আগে আগে দেখতে পাবে, যারা বস্ত্রহীন, নগ্ন পা, হতদরিদ্র (আল হুফাত, আল ওরাত) তারা এতো সম্পদশালী হবে যে, কে কতো উঁচু ভবন (ইয়াতা তাওয়ালুনা ফিল বুনিয়ান), বুরুজ, টাওয়ার নির্মাণ করতে পারে তা নিয়ে পরস্পরে প্রতিযোগিতায় মেতে উঠবে.......”। উপসাগরের মৎসজীবী, ভুখা নাঙ্গা, উটের রাখাল ও খেজুর খেয়ে জীবনধারণকারী লোকেরাই সামান্য কয়েক বছরের ব্যবধানে এখন দুনিয়ার সবধরনের অপকর্ম, অশ্লীলতা ও অপসংস্কৃতি সংঘটনের জন্য কত উঁচু স্থাপনা তৈরী করতে পারে এর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। এছাড়াও আরবজুড়ে অসংখ্য ঘটনা এমন চলছে, যেসব সম্পর্কে মহানবী সা. বলে গিয়েছিলেন, যখন এসব ঘটনা দেখবে তখন কিয়ামত বা দুনিয়া ধ্বংসের অপেক্ষা করো।



 

Show all comments
  • Asad ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:৩২ এএম says : 0
    Super article.thanks mr nadvi.
    Total Reply(0) Reply
  • সফিউল আলম ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১:৫৬ এএম says : 0
    তিক্ত হলে একদম একটা খাঁটি সত্য কথা বলেছেন
    Total Reply(0) Reply
  • আবদুল মালেক ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১:৫৭ এএম says : 0
    অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে কিয়ামত খুব কাছে চলে এসেছে............
    Total Reply(0) Reply
  • আল আমিন ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১:৫৮ এএম says : 0
    হে আল্লাহ, সকল মুসলমানদেরকে ইসলামের সঠিক বুঝ দান করো।
    Total Reply(1) Reply
    • Dr. Anwar ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ৫:৪০ এএম says : 4
      May Allah give them good understanding of Islamic guidance
  • Jc ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ৭:৪৬ এএম says : 0
    Thanks for the Wonderful article.Keep it up.
    Total Reply(0) Reply
  • হাদি ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১০:২৫ এএম says : 0
    আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। বিশ্ব মুসলিমের ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের কথা লিখার জন্য।
    Total Reply(0) Reply
  • Atiqur Rahman ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:১৪ পিএম says : 0
    ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া দরকার। আমরা কারা। ওদের মত কাফের মুরতাদদের কেন ভয় পাচ্ছি। । আসলে এটা ভয় না। এটা হল ক্ষমতার লোভ। আদম সন্তান ধংস হবে এর জন্য। আল্লাহ কওমে নূহ,লুত,আসহাবুল আইকা এদের যে আবস্থা করেছেন। এদের পরিনতি এ ভাবে হবে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আরবের

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ