Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাসূলে পাক (সা.)-এর নবুয়তের সূচনাকাল

মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী | প্রকাশের সময় : ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আর সেই মানবজাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হলেন নবী ও রাসূলগণ। আবার সেই নবী ও রাসূলগণের মধ্যে একজন অপরজনের চেয়ে অধিক মর্যাদার অধিকারী রয়েছেন। আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হচ্ছেন সকল নবী-রাসূলগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, সকল নবীগণের নবী, তাই তিনি বিশ্বনবী। ইরশাদ হচ্ছে-‘বল, হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সকলের জন্যই আল্লাহর রাসূল” (সূরা আরাফ : আয়াত-১৫৮)।
আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) শুধু মানবজাতির নবী নন; বরং তিনি সমগ্র সৃষ্টিকুলের নবী। বৃক্ষলতা, পশু-পাখি সবকিছুই তাকে শ্রেষ্ঠ নবী বলে একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছে। তিনি সমস্ত সৃষ্টিকুলের জন্য রহমত। সমগ্র সৃষ্টিকুল সৃষ্টির সূচনা থেকে মহান আল্লাহর যেসব রহমত লাভ করেছে তা কেবল আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওছিলাতেই লাভ করেছে। এজন্যই তিনি ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ বা জগতসমূহের জন্য রহমত। ইরশাদ হচ্ছে-“হে নবী! আমি তোমাকে জগতসমূহের রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি” (সূরা আম্বিয়া : আয়াত-১০৭)।
যখন থেকে মহান আল্লাহপাক ‘রাব্বুল আলামীন’ তখন থেকেই রাসূলে পাক (সা.) হচ্ছেন ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’। যেখানেই আল্লাহপাক ‘রব’ সেখানেই রাসূলে পাক (সা.) হচ্ছেন রহমত। কেননা রাসূলে পাক (সা.)-এর ইশারা ছাড়া মহান আল্লাহ জগতসমূহের কাউকে রহমত দান করেন না। আর এ জন্যই রাসূল (সা.) এর পবিত্র উপাধি হচ্ছে ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’। যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই প্রদান করা হয়েছে। আমাদের সকলের রূহ যখন আলমে আরওয়াহে ছিল, আমরা যখন মাতৃগর্ভে সম্পূর্ণ অসহায় ছিলাম, এমনকি সকল নবী-রাসূলগণের রূহ যখন আলমে আরওয়াহে ছিল, সকল নবী-রাসূলগণ যখন মাতৃগর্ভে ছিলেন তখনও আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন ‘নবীয়ে রহমত’। রাসূল (সা.)-কে মহান আল্লাহ পাক যখন থেকেই ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ হিসাবে মনোনীত করেছেন তখন থেকেই তিনি সকলের নবী, সকলের জন্য রহমত। তাই একথা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত হয়-রাসূলে পাক (সা.)-এর নবুয়তের সূচনা সৃষ্টির সূচনা থেকেই। হাদীসে কুদসীতে মহান আল্লাহপাক বলেছেন-“হে নবী! যদি তোমাকে প্রেরণ না করতাম তাহলে দুনিয়ার কোন কিছুই সৃষ্টি করতাম না।” উক্ত হাদীসে কুদসী দ্বারা প্রমাণ হল-রাসূল (সা.)-এর নবুয়তের সূচনা সৃষ্টির সূচনা থেকেই। তিনি তাঁর জন্মের পূর্বেও নবী, জন্মের পরেও নবী-কিয়ামত পর্যন্ত তিনি সকলের নবী।
কেউ কেউ নবী (সা.)-এর সুমহান মর্যাদাকে খাটো করার জন্য বলে থাকেন-“নবী (সা.) ৪০ (চল্লিশ) বছর বয়সে নবুয়তি লাভ করেছেন, তাই তিনি ৪০ বছর বয়স থেকেই নবী, এর আগে তিনি নবী নন, ৪০ বছর পূর্বে তিনি সাধারণ মানুষের মতই ছিলেন। সুতরাং ৪০ বছর বয়সের পূর্বে তিনি যা বলেছেন, যা করেছেন তা আমাদের জন্য অনুসরণ যোগ্য নয়। কারণ ৪০ বছর পূর্বে তিনি নবী ছিলেন না।” এদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। এরা নবী বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য, মুসলমানদেরকে ঈমানহারা করার জন্য এরূপ বক্তব্য দিয়ে থাকেন। নবী (সা.) যে সৃষ্টির সূচনা থেকেই নবী, তাঁর জন্মের পূর্বেও নবী, তাঁর জন্মের পরেও নবী, ৪০ বছর বয়সের পরেও নবী, এমনকি কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকলের নবী-এ বিষয়টি কোরআন-হাদীস দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত। আমাদের নবী (সা.)-এর উপর অন্যান্য সকল নবী-রাসূলগণ ঈমান এনেছেন। এমনকি সকল নবীর উম্মতগণও আমাদের নবীর উপর ঈমান এনেছেন। শুধু তাই নয়; অন্যান্য নবীগণের নবুয়তির স্বীকৃতি পেয়েছিল এবং তাঁদের নবুয়তি বহাল রয়েছিল নবী (সা.) উপর ঈমান আনার কারণে। আমাদের নবীর উপর যে অন্যান্য নবী-রাসূলগণ ঈমান এনেছেন এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে-‘স্মরণ কর, যখন আল্লাহপাক নবীদের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা দিয়েছি তার শপথ, আর তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থকরূপে যখন একজন রাসূল আসবে তখন নিশ্চয়ই তোমরা তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। তিনি বললেন-‘তোমরা কি স্বীকার করলে? এবং এ সম্পর্কে আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে? তারা বলল-‘আমরা স্বীকার করলাম।’ তিনি বললেন-‘তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম’ (সূরা আল-ইমরান : আয়াত-৮১)।
উক্ত আয়াত দ্বারা দিবালোকের ন্যায় প্রমাণিত-অন্যান্য সকল নবীগণ আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর ঈমান এনেছিলেন। প্রশ্ন হল-নবী (সা.) যদি সেই সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বীকৃত নবী না হতেন বা সেই সময় যদি নবী (সা.)-এর নবুয়তি না থাকতো তাহলে অন্যান্য নবীগণ কি তাঁর প্রতি ঈমান আনতেন? না, কখনও ঈমান আনতেন না। আল্লাহপাক ও তাঁদেরকে ঈমান আনার কথা বলতেন না। তাছাড়া নবী (সা.) যে সৃষ্টির সূচনা থেকেই নবুয়ত প্রাপ্ত তা উক্ত আয়াত দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত। কারণ নবীগণের কাছ থেকে আল্লাহপাক উক্ত অঙ্গীকার ‘রূহ জগত’ থেকে নিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে-“স্মরণ কর, যখন ঈসা ইবনে মরিয়ম বলেছিল, হে বনি ইসরাঈল! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর রাসূল এবং আমার পূর্ব হতে তোমাদের নিকট যে তাওরাত রয়েছে আমি তার সমর্থক এবং আমার পরে আহমদ (হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অপর নাম আহমদ) নামে যে রাসূল আসবে আমি তাঁর সুসংবাদদাতা (সূরা সাফফ : আয়াত-৬)।
উক্ত আয়াত দ্বারা সুস্পষ্ট প্রমাণিত-অন্যান্য নবীগণ আমাদের নবীর প্রতি ঈমান আনার পর তাঁদের উম্মতদের নিকট তাঁর আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। আমাদের নবীর নবুয়তি সেই সময় স্বীকৃতি ছিল বলেই অন্যান্য নবী-রাসূলগণ তাদের উম্মতের নিকট আমাদের নবীর আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। আমাদের নবীর নবুয়তির বিষয়টি অন্যান্য নবী-রাসূলগণের উপর নাজিলকৃত কিতাবাদীতেও বর্ণিত হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে-“যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উম্মি নবীর, যার উল্লেখ তাওরাত ও ইনজীল, যা তাদের নিকট আছে তাতে লিপিবদ্ধ পায়, যে তাদের সৎকাজের নির্দেশ দেয় ও অসৎ কাজে বাধা দেয়, যে তাদের জন্য পবিত্র বস্তু বৈধ করে ও অপবিত্র বস্তু অবৈধ করে এবং যে মুক্ত করে তাদেরকে তাদের গুরুভার হতে ও শৃঙ্খল হতে যা তাদের উপর ছিল। সুতরাং যারা তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তাকে সম্মান করে, তাকে সাহায্য করে এবং যে নূর তাঁর সাথে অবতীর্ণ হয়েছে উহার অনুসরণ করে-তারাই সফলকাম” (সূরা আরাফ : আয়াত-১৫৭)।
এখন যদি বলা হয়, আমাদের নবীর নবুয়তি সূচনা হয়েছে তাঁর ৪০ বছর বয়স থেকে, তাহলে পূর্ববর্তী সকল নবীর ঈমান আনা, তাদের উম্মতের নিকট আমাদের নবীর নবুয়তির বর্ণনা দেয়া, অন্যান্য নবীগণের কিতাবাদীতে আমাদের নবীর নবুয়তির বর্ণনা-এসবই মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়ে যাবে। যা কখনও মিথ্যা হতে পারে না। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে, সাহাবায়ে কেরামগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কখন থেকে নবী? বা আপনাকে কখন নবুয়তি দেয়া হয়েছে? রাসূলে পাক (সা.) বললেন-আমি তখনও নবী ছিলাম যখন আদম (আ.) রূহে এবং শরীরে অবস্থান করছিলেন অর্থাৎ হযরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করার পূর্ব থেকেই আমি নবী (তিরমীজি শরীফ-দ্বিতীয় খÐ : পৃষ্ঠা-২০২, মিশকাত শরীফ : পৃষ্ঠা-৫১৩)।
উক্ত হাদীস দ্বারাও সুস্পষ্ট প্রমাণিত-নবী (সা.)-এর নবুয়তের সূচনা সৃষ্টির শুরু থেকেই। “জন্মের ৪০ বছর পর থেকেই তিনি নবী বা ৪০ বছর পর নবীকে নবুয়তি দেয়া হয়েছে”-এরূপ কথা বলা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর এবং সম্পূর্ণ অজ্ঞতামূলক। যারা এরূপ বলেন তাদের প্ররোচনা থেকে আমাদেরকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
নবীজির ৪০ বছর বয়সে কোরআন নাজিল হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইসলামী শরীয়তের সকল বিধি বিধান বর্ণিত হয়েছে। এই মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে মানবজীবনের সকল সমস্যার সমাধানের কথা বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। নবী (সা.) কে তাঁর নবুয়তি ৪০ বছর বয়সে দেয়া হয়নি : বরং সৃষ্টির সূচনাতেই তাঁকে নবুয়তি দেয়া হয়েছে। এটাই চির সত্য।
লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাসূল


আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ