Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাসূল (সা.)-এর জীবন মাধুরী

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন | প্রকাশের সময় : ১৫ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

পৃথিবী যখন অন্যায়-অপরাধ, অত্যাচার ও বর্বতার ঘোর অন্ধকারে ছেয়ে গেল। মনুষ্য সমাজ হয়ে গেল হিংস্র প্রাণীর সমাজ, হারিয়ে গেল মানবতা-সততা, ভেঙ্গে পড়ল সমাজ ব্যবস্থা, শুধু তাই নয়; সামান্য বিষয় নিয়ে বয়ে যেত রক্তের দরিয়া। যুগ থেকে যুগ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম প্রতিশোধের জন্য থাকত উন্মাদ, ঠিক সে সময় এ ধরার মাঝে প্রেরণ করেন
আল্লাহ তা’আলা সর্বকালের সেরা মহামানব মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে। প্রিয় নবিজী (সা.)-এর চরিত্র মাধুরী দিয়ে মাধুর্যপূর্ণ করেছেন এই পৃথিবী। তাঁর সুন্দর্যের রঙ্গে রাঙ্গিয়েছেন রঙ্গিন দুনিয়া। পৃথিবীর সকল মানুষের নীতি-আদর্শ, চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যে রয়েছে ফাঁক-ফোঁকর ও ছিদ্র। শুধুমাত্র নিñিদ্র চরিত্র ও জীবন মাধুরীর অধিকারী ছিলেন প্রিয় নবিজী (সা.)। সমস্ত সুন্দর্য ও উত্তম চরিত্রের সমাবেশ ছিল তাঁর মাঝে। সততা-নিষ্ঠা, ধৈর্য, ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা, মুসিবত ও বিপদ-আপদে সহ্য ও স্থিরতা, নম্রতা, সহনশীলতা, বীরত্ব-সাহসিকতাসহ হাজারো বৈশিষ্ট্যের ভূষণে ছিলেন তিনি বিভূষিত। তাঁর জীবন মাধুরীর ব্যাপারে স্বয়ং প্রভু মহান বলেন, ‘নিশ্চয় আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী’। (সুরা আল-কলম : ০৪)।
সাহাবী কবি হাসসান বিন সাবিত রাঃ রাসুল (সা.) সম্পর্কে বলেছেন, ‘আপনার চেয়ে সুন্দর আমার দু’চোখ কাউকে কখনো দেখেনি, আপনার চেয়ে সুন্দর সন্তান কোন নারী কখনো জন্ম দেয়নি। আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সকল দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত করে। হে আল্লাহ! আপনি যেমন চেয়েছেন ঠিক তেমন করেই তাঁকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর নিষ্ঠা ও সততা ছিল সবার মাঝে প্রসিদ্ধ। শুধু রেসালাতের পরে নয়, ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন সততায় সবার প্রিয়। মক্কার মুশরিকদের নিকট তিনি এতটাই বিশ্বস্ত ছিলেন, তাদের যেকোনো সমস্যা সমাধানে যুবক মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন সমাধানকারী। সবার আমানতের বিশ্বস্ত স্থান মুহাম্মাদ (সা.)। তাইতো তারা মুহাম্মাদের নাম দিয়ে ছিল ‘আল আমিন’। তারা নবিজীর নবুওয়তের পরও বিশ্বাস করত মুহাম্মাদ (সা.) সত্যবাদী। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা ঈমান গ্রহণ না করা ছিল শুধু তাদের অহংকার ও কপটতা। বুখারী শরীফের দীর্ঘ বর্ণনা, আবু সুফিয়ান (রা.) তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি, রুমের বাদশা হিরাকল যখন রাসুল (সা.)-এর ব্যাপারে জানতে পারে, তখন সঠিক তথ্যের জন্য মক্কার ব্যবসায়িক কাফেলাকে ডেকে নিল। ওই কাফেলায় আবু সুফিয়ান (রা.)ও ছিলেন। বাদশা হিরাকল আবু সুফিয়ানকে রাসুল (সা.) সম্পর্কে অনেকগুলো প্রশ্ন করেছিল। একটি প্রশ্ন ছিল- সে এখন যা বলে এবং যে ধর্মের দিকে তোমাদের আহ্বান করে, তোমরা কি তার আগে তাকে কখনো মিথ্যার অপবাদ দিয়ে ছিলে? আবু সুফিয়ান বলল, না। (সহিহ বুখারী : ১.৩)।
নমনীয়তা ও নম্রতায় ছিলেন তিনি অনন্য। জাগতিক রাজা-বাদশাদের মত জীবন-যাপন করেননি কখনো। তিনি ছিলেন সাদা-মাটা জীবনে অভ্যস্ত। অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখতেন না। রাসুল (সা.) যখন মজলিসে বসতেন তখন অন্যদের মত স্বাভাবিকভাবেই বসতেন। যার দরুন অনেক সময় আগন্তক এসে চিনতে পারতনা প্রিয় নবিজীকে। নিজের কাজ নিজেই করতেন- জুতা ঠিক করা, কাপড় সেলাই করা থেকে শুরু করে সব কাজ তিনিই করতেন। আসওয়াদ (রা.) বলেন, তিনি আয়েশা রা.-কে জিজ্ঞাসা করেন, রাসুল (সা.) যখন বাড়ির ভিতরে অবস্থান করতেন তখন কী কাজ করতেন? আয়েশা (রা.) বলেন, তিনি বাড়িরকাজে লিপ্ত থাকতেন। ঘর ঝাড়ু দিতেন, বাজার হতে নিজেই সদায় বহন করে নিয়ে আসতেন। (সহিহ বুখারী)।
কখনো কেউ তাঁর কাজ ও কথায় কষ্ট পায়নি। গ্রাম ও শহরের কোন পার্থক্য ছিলনা। সবার সাথেই কথা বলতেন হাসি মুখে। যতক্ষণ আগন্তুক না যেতেন তিনি সেখান থেকে প্রস্থান করতেন না। হাসি মুখেই শুনতেন সবার কথা। অনেক আগন্তক অপ্রীতিকর কথা বললেও তিনি বিরক্তি প্রকাশ করতেন না। যারা সদা-সর্বদা তাঁকে কষ্ট দেয়ার জন্য ওঁত পেতে থাকত তাদেরকেও কভু তিনি কষ্ট দেননি। শিশুদের প্রতিও ছিল তাঁর অসাধারণ স্নেহ, মায়া-মমতা। নবিজী শিশুদের মাথায় তাঁর মমতার আলত হাত বুলিয়ে দিতেন। তাদের কোলে তুলে আদর সোহাগ করতেন। নিজে ঘোড়া সেজে তাদের পিঠে নিয়ে খেলা করতেন। শিশুদেরও ছিল তাই তাঁর প্রতি ভালোবাসা। সবার প্রতিই ছিল নবিজীর নজিরবিহীন মমতা, ছিল হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। আর তাই সবাই মনে করতেন, রাসুল (সা.) তাকেই বেশি ভালোবাসেন। আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন- যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ করেনা এবং বড়দের সম্মান করেনা সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। (তিরমিযি : ২. ১৪)।
তাঁর ভাষা ছিল মাধুর্যপূর্ণ। কথা বলতেন কোমল ও নরম ভাষায়। কাউকে আঘাতমূলক কথা বলতেননা। মাঝে-মাঝে সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর সাথে হাসি মজাকও করতেন, কিন্তু মজার ছলেও নবিজী কখনো শ্রুতিকটু কথা বলতেননা।
তাঁকে কেউ কটুকথা বললেও তিনি প্রত্যুত্তরে কটুকথা বলেননি। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) অসাদাচারণের প্রত্যুত্তরে অসাদাচারণ করতেননা বরং অসাদাচারণের পরিবর্তে সুন্দর আচরণ করতেন। (শামায়েলে তিরমিযি)। তিনি দাস-দাসী সেবক-সেবিকাদের পর্যন্ত কখনো কটুকথা বলেননি, এমনকি তাদের কোন কাজের প্রতিও কখনো অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেননি। হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর দশ বছর খেদমত করেছি, কিন্তু কখনো রাসুল (সা.) আমার কোনো কাজের ওপর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেননি এবং আমাকে কখনো এ কথাও বলেননি, তুমি এই কাজ কেনো করেছ কিংবা তুমি এই কাজ কেনো করেনি? (তিরমিযি : ২ সহিহ বুখারী)।
ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমি আমার খাদেম তথা সেবককে কতোবার ক্ষমা করবো? রাসুল (সা.) কোনো উত্তর দিলেননা। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞাসা করল, আমি আমার খাদেমকে কতোবার ক্ষমা করব? এবার রাসুল (সা.) বললেন, প্রতিদিন সত্তরবার করে ক্ষমা করবে। (তিরমিযি: ২, ১৬)। প্রাণের নবিজী ছিলেন ক্ষমা পরায়ণ। প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা করে দিতেন। ক্ষমা ছিল তাঁর অনন্য ভূষণ। মক্কার জীবন থেকে শুরু করে পুরোটা জীবন ছিল তাঁর কষ্টের। কাফের-মুশরিকরা প্রতিটি মুহুর্তেই তাঁর ওপর জুলুম-নির্যাতন চালাত। কখনো রেখেছে অবরুদ্ধ করে আবার কখনো করেছে পাথরের আঘাতে রক্তাক্ত। কিন্তু মমতাময়ী নবিজী প্রতিশোধ তো দূরের কথা বিপরীতে ক্ষমা করে দিয়েছেন তাদের। মক্কা বিজয়ের পর সবাই ভেবেছিল, আজ নিশ্চয় মক্কার অলি-গলিতে বয়ে যাবে রক্তের শ্রোত। কিন্তু পৃথিবী দেখেছে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ক্ষমার দৃষ্টান্ত।
প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন।
আগলে নিলেন ভালবাসার চাদরে। ঢেকে দিলেন সকল রক্তাক্ত অতীত। কতোইনা দয়ার্দ্র ছিলেন রাসুল (সা.)। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ব্যতীত রাগের বশিভূত হয়ে কখনো কোনো স্ত্রী বা খাদেমকে মারেননি এবং কেউ তাঁকে কষ্ট দিলেও তার প্রতিশোধ নেননি তথা নিজের বিষয়ে কখনো রাগ করেননি এবং কখনো কারো থেকে প্রতিশোধ নেননি। কিন্তু যদি কেউ আল্লাহর নির্দেশের অমান্য করত তখন রাগান্বিত হতেন এবং প্রতিশোধও নিতেন। (সহিহ মুসলিম)।
দান ও উদারতায় ছিলেন শ্রেষ্ঠ উদার ও দানবীর। তাঁর কাছ থেকে কেউ কবু ফিরেনি শূন্য হাতে। যখনই তাঁর কাছে কোনো কিছু আসত, সাথে সাথে সঙ্গে থাকা সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর মাঝে বিলিয়ে দিতেন। নিজে না খেয়েও অন্যদের মুখে তুলে দিতেন অন্ন। মানুষের কষ্ট ও দুঃখে সদা ছিলেন ব্যথিত। দুস্থ-অসহায়, জাগতিক সুখ-সমৃদ্ধি বঞ্চিতদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতেন দিন-রাত। তাদের মুখে খাবার তুলে দিয়েই তিনি আনন্দ পেতেন। একজনের খাবার হওয়া সত্ত্বেও তিনি একা না খেয়ে সবাইকে নিয়ে খেতেন।
সবার আনন্দে তিনি আনন্দিত হতেন। হজরত মুসা বিন আনাস (রা.) তাঁর পিতা সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.)-এর কখনো এমন হয়নি যে, কেউ তার কাছে কিছু চেয়েছে আর তিনি তা দেননি। তিনি বলেন, একবার এক ব্যক্তি নবিজী (সা.)-এর কাছে একটি ছাগল চাইলে তিনি তাকে এত বেশি পরিমাণ দান করলেন, যা দুই পাহাড়ের মধ্যস্থান পূর্ণ করে দেবে। অতঃপর লোকটি নিজ সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা ইসলাম গ্রহণ করো। কেননা, মুহাম্মাদ (সা.) এতবেশি দান করেন যে, তিনি নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার ভয় করেন না। (সহিহ মুসলিম)। হজরত আনাস (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে শুধুমাত্র দুনিয়াবী স্বার্থের জন্যই এসেছিল। কিন্তু সন্ধ্যাবেলা এমন অবস্থা সৃষ্টি হল যে, রাসুল (সা.)-এর আনীত দীন উক্ত ব্যক্তির কাছে পৃথিবী ও তার মধ্যকার সকল কিছু থেকে শ্রেয়। (মুসনাদে আহমাদ)।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাসূল (সা.)-এর জীবন মাধুরী

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ