Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিখোঁজ ও গুম-খুনের আতঙ্ক

| প্রকাশের সময় : ১০ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ক্রমবর্ধমান গুম-খুনের ঘটনায় আবারো জনমনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। গত মঙ্গলবার একদিনেই শুধুমাত্র রাজধানী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, প্রকৌশলী, ফার্মাসিস্টসহ অন্তত ৪ জন নিখোঁজ হয়ে গেছে। এরা প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত্ব ও উদ্যমী যুবক। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড.মুবাশ্বার হাসান সিজার, নকিয়া-সিমেন্সের প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান ও তার ছোটভাই ফয়সাল এবং সানোফি- এভেন্তিস ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীর ফার্মাসিস্ট আবু মোহাম্মদ জামাল রহমান নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। একদিনে প্রায় একই এলাকা থেকে নিখোঁজ হওয়ার পর ইতিমধ্যে আসাদুজ্জামান ও তার ভাইকে র‌্যার তুলে নেয়ার পর রাতে আসাদুজ্জামান মুক্তি পেলেও তার ভাইকে জঙ্গিবাদ সন্দেহে আটক রাখা হয়েছে বলে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়। তিনদিন পেরিয়ে গেলেও অন্যদের কোন হদিস বা সন্ধান দিতে পারেনি পুলিশ। গতমাসে মতিঝিল থেকে নিখোঁজ হওয়া সাংবাদিক উৎপল দাস এবং গুলশান ও বনানী থেকে নিখোঁজ দুই ব্যবসায়ীরও কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছেনা। ব্যস্ত শহরের রাস্তা থেকে দিনেদুপুরে এভাবে মানুষ গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা চরম নিরাপত্তাহীনতার জ্বলন্ত প্রমান। প্রথমদিকে একের পর এক বিরোধিদলের নেতাকর্মী গুম ও ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার ঘটনা দেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে নিরাপত্তাহীন করে তোলে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টেগুম-খুনের আতঙ্কজনক চিত্র প্রকাশিত হওয়ার পর তা সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর বেশ শক্ত চাপ সৃষ্টি করে। মাঝখানে কিছুদিন গুম-খুনের সংখ্যা কিছুটা কমে এলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা আবারো উদ্বেগজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং জননিরাপত্তার সংকট দেশের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়। নিরাপত্তাহীনতার কারণে গত কয়েক বছরে বেশকিছু আন্তর্জাতিক সূচকে বাংলাদেশের অবনমন ঘটেছে এবং বিনিয়োগ ও গার্মেন্ট রফতানীখাতসহ রেমিটেন্সের গুরুত্বপূর্ণ খাতসমুহ বড় ধরনের ধস সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, মানুষের কর্মসংস্থানের সংকট, খাদ্যসহ পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তার সংকট দেশে বড় ধরনের সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরী করতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গুম-খুনের অভিযোগ নিয়ে সরকার ও বিরোধিদলের মধ্যে বেøইম গেম চললেও এসব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেন কোন দায় নেই। চলতি বছরের মাঝামাঝিতে বিএনপি’র পক্ষ থেকে দলীয় নেতাকর্মী নিখোঁজ হওয়া ও সরকারের সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতার অভিযোগ তোলা হলে আওমীলীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিখোঁজদের তালিকা চাওয়ার প্রেক্ষিতে বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ সাংবাদিক সম্মেলন করে শুধুমাত্র ঢাকা থেকে নিখোঁজ হওয়া বিএনপি’র ২৫জন নেতাকর্মীর ঠিকানাসহ নামের তালিকা প্রকাশ করেন। এরপর চারমাস অতিবাহিত হলেও নিখোঁজ এসব নেতাকর্মীর ভাগ্যে কি ঘটেছে তার কোন তথ্যই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিতে পারেনি। উপরন্তু নতুন করে সারাদেশে গুম-খুনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেনীর সদস্যের হাতে নারায়নগঞ্জের সাতখুনসহ আরো বহু অপরাধের অভিযোগ, অপহরণ করে ডিবি সদস্যদের মুক্তিপণ আদায়ের মত ঘটনা এখন প্রমানীত সত্য। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের কোথাও কোথাও সাধারণ মানুষের হাতে এবং সেনাসদস্যদের হাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন অপরাধি সদস্যদের দু’চারজন ধরা পড়লেও বেপরোয়া অপরাধিরা নিবৃত্ত হচ্ছেনা।
বিশেষত: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়ার পর অনেকেরই হদিস পাওয়া যাচ্ছেনা। ভিকটিমদের পরিবারের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ তোলা হলে কোন কোন ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হচ্ছে। গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে নদীতে, পুকুরে, ডোবা-নালায় বেশকিছু মানুষের গুলিবিদ্ধ, ছুরিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার হওয়া অজ্ঞাত পরিচয় লাশের সংখ্যাও কম নয়। এসব বিভৎস ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনের বদলে বেøইম গেইমসহ দায়সারা ও উদ্ভট বক্তব্য হাজির করছেন সংশ্লিষ্টরা। সাংবাদিক দম্পতি সাগর রুনী নিহত হওয়ার পর ৪৮ ঘন্টার মধ্যে খুনীদের খুঁজে বের করার ঘোষনা দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। নিজের গাড়ীর ড্রাইভারসহ ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর তাকে খুঁজে বের করতে একদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হাজার বার অভিযান পরিচালনা করার দাবী করে অন্যদিকে তৎকালীন একজন মন্ত্রী দাবী করেন ইলিয়াস আলীর স্ত্রী জানেন কে তার স্বামীকে হত্যা করেছে। গত কয়েকদিনে রাজধানীসহ সারাদেশে গুম-খুনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, কিছু লোক আত্মগোপণ করে আমাদের বিব্রত করছে। কেউ যদি এমন কিছু করে তাদেরকেও খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব। মুবাশ্বার হাসান সিজার বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সক্রিয় ভ‚মিকা রাখতেন বলে জানা যায়। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে এটি তার সাংবিধানিক অধিকারও বটে। তবে মোবাশা¦র, প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান বা ফার্মাসিস্ট জামাল রহমানের পারিবারিক অবস্থা ও উচ্চ আয়ের পেশাগত অবস্থানই তাদের নিখোঁজ হওয়ার কারণ বলে অনেকে সন্দেহ করছেন। যদিও গত ৭ বছরে নিখোঁজ হওয়া এমন শত শত মানুষ আর ফিরে আসেনি। তথাপি নেপথ্য কারণ যা’ই হোক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও আশাবাদ প্রকাশ করতে চাই, নিখোঁজ ব্যক্তিরা খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন। এবং গুম-অপহরণের সাথে জড়িতদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিখোঁজ

৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
১৩ অক্টোবর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন