Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় যেভাবে প্রভাব ক্রয় করছে চীন

| প্রকাশের সময় : ২১ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দি আটলান্টিক : উত্তরপূর্ব কম্বোডিয়ায় মেকং নদীর একটি বড় শাখা নদীতে রয়েছে নতুন উদ্বোধন করা লোয়ার সেসান ২ বাঁধ জলবিদ্যুত কেন্দ্র। ৪শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনক্ষম এ বাঁধটি দেশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় বিদ্যুত উৎপাদন করবে। এ বাঁধ নির্মাণের ফলে সম্ভাব্য বড় ধরনের প্রতিবেশগত ক্ষতি হবে। এ জন্য ইতোমধ্যেই এ এলাকা থেকে ৫ হাজার পরিবারকে উৎখাত করা হয়েছে। তবে এ সব বিষয় কম্বোডিয়ার শক্তমানব হুন সেনের জন্য ক্ষতিকর হবে না বলে ধারণা। ৩২ বছর ধরে নানা অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য তিনি বিদেশী সরকারগুলো দানের উপর নির্ভরশীল। সর্বশেষ প্রকল্পের জন্য ৮০ কোটি ডলার প্রদানের জন্য তিনি চীনের কাছে কৃতজ্ঞ।
অতীতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এ ধরনের প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা অংশীদারদের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল। বিনিময়ে কোনো কোনো দেশ গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ চেষ্টা বজায় রাখার অঙ্গীকার চাইত। কিন্তু ট্রাম্পের আমলে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ক্ষীণ হয়ে আসার প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলে চীনের পদচিহ্ন আঁকার পথ উন্মুক্ত হচ্ছে। এ জন্য উদার বা চিরকাল ক্ষমতায় থাকতে ইচ্ছুক দমনকারী স্বৈরাচার হলেও চীনের কোনো আপত্তি নেই। গত মাসে জলবিদ্যুত বাঁধ উদ্বোধনকালে ৬৫ বছর বয়স্ক হুন সেন বলেন, আমার বিশ^াস আমি আরো ৩০ বছর বাঁচব। সুতরাং আমি আরো ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারি।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির লক্ষ্যে কমে¦াডিয়ার মত দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতেও শত শত কোটি ডলারের অবকাঠামো ও বিনিয়োগ চুক্তির আবরণে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এগিয়ে চলেছে চীন। এ থেকে বোঝা যায়, অদূর ভবিষ্যতে চীন কিভাবে বিশে^র সাথে সম্পৃক্ত হবে। বুধবার চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির ১৯তম জাতীয় কংগ্রেসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, যিনি গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাবান শাসক, তার শাসনকে আরো সংহত এবং সম্প্রসারিত বিদেশী অর্থনৈতিক প্ল্যাটফরম শক্তিশালি করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন যা আগামীতে এ অঞ্চলকে পাল্টে দেবে।
এ ধরনের ভবিষ্যত বিনিয়োগের সাথে গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারের কোনো সম্পর্ক নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কম্বোডিয়ায় হুনসেন গণতন্ত্র ও মৌলিক স্বাধীনতার উপর দমন চালালেও চীন তার বিনিয়োগ মন্থর করেনি। আগামী বছরের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে বিরোধী গ্রæপগুলোর সোচ্চার চ্যালেঞ্জের মুখে তিনি গণতন্ত্রপন্থী প্রতিষ্ঠানগুলো সক্রিয়ভাবে নীরব করতে শুরু করেছেন, মার্কিন তহবিলকৃত ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউটকে বহিষ্কার করেছেনন, রেডিও ফ্রি এশিয়াকে তার নমপেন অফিস বন্ধ করতে বাধ্য করেছেন, দি কম্বোডিয়ান ডেইলি বন্ধ করেছেন, বিরোধী নেতা কেম সোখাকে ফোনে কথিত দেশদ্রোহের অভিযোগ ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতার জন্য জেলে পাঠিয়েছেন এবং পিস কোর স্বেচ্ছাসেবকদের প্রত্যাহারের আহবান জানিয়েছেন। সোমবার জাতীয় সংসদ প্রধান বিরোধী দলগুলোর সব সংসদীয় আসন পুনর্বন্টন করতে অগ্রসর হয়।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের দক্ষিণপূর্ব এশিয়া প্রোগ্রামের সিনিয়র অ্যাডভাইজার ও উপ পরিচালক মারে হিবার্ট বলেন, একটা সময় ছিল যখন হুনসেনকে যুক্তরাষ্ট্র ও ই ইউ কি বলে সে হিসেব করে চলতে হত। কারণ তিনি তাদের নিকট থেকে জরুরি সাহায্য পেতেন। এখন তাকে আর তা করতে হয় না, যেহেতু চীন তাকে সকল সাহায্য দেয়। চীন আমেরিকার স্থান নিতে চাইছে, এবং যা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে তা হচ্ছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সাম্প্রতিককালে হুনসেনের পদক্ষেপ হচ্ছে মৌলিক অধিকারের প্রতি আক্রমণ বৃদ্ধি এবং কম্বোডিয়ার দুর্বল গণতন্ত্রের উপর আঘাত। তা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে বৃহত্তর রূপান্তরের একটি টুকরো। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক বিরোধীদের প্রতি দমন অব্যাহত রেখেছেন। অন্যদিকে ২০১৪-র পর থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনী সরকারের উপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে, বিরোধী নেতা ও কর্মীদের উপর দমন চালানো হচ্ছে। মিয়ানমারের সামরিক সরকার যখন রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত নিপীড়ন চালাচ্ছে তখন অং সান সু কির নেতৃত্বে দেশের বহু প্রশংসিত গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রডরিগো দুতের্তে তার নিষ্ঠুর মাদক লড়াই অব্যাহত রেখেছেন যাতে ৭ থেকে ১৩ হাজার লোক নিহত হয়েছে।
গত নভেম্বরের আগে স্বৈরাচারের দিকে এই ঝুঁকে পড়া শুরু হয়েছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনের পর সে গতি জোরদার হয়। বিদেশী সংকটের ব্যাপারে ট্রাম্প সীমিত আগ্রহ প্রদর্শন করেন। ওবামা প্রশাসন এশিয়ায় পুনঃভারসাম্য প্রতিষ্ঠার যে নীতি নিয়েছিল তার সাথে ট্রাম্পের নীতির পার্থক্য ব্যাপক। মানবাধিকারের ব্যাপারে ওবামার নীতি ছিল বলিষ্ঠ, মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক রূপান্তরকে তিনি উৎসাহিত করেন এবং ট্রান্স-প্যাসিফিক অংশীদারিত্বে অগ্রণী ভ‚মিকা নেন যা থেকে ট্রাম্প জানুয়ারিতে বেরিয়ে আসেন। দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক বিষয়ে আগস্টে প্রকাশিত রিপোর্টে সিডনি-ভিত্তিক লোয়ি ইনস্টিটিউটের বলা হয়, বহুপাক্ষিকতার বিষয়ে ট্রাম্পের অনাগ্রহের প্রেক্ষিতে এ প্রত্যাহার এ অঞ্চলে চীনের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার উজ্জ্বল সাফল্যের বিপরীতে অদূর ভবিষ্যতের জন্য মার্কিন অর্থনৈতিক স্বার্থকে সমস্যার মধ্যে ফেলেছে।
চীনের আগ্রাসী অর্থনৈতিক পদক্ষেপ চীনের ‘গো আউট’ পলিসির এক উল্লেখযোগ্য দিক। ২০১২ সালের নভেম্বরে চীনের নেতা হওয়ার পর থেকে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলিষ্ঠভাবে যে নীতি অনুসরণ করছেন। মাও জে দং-এর সময় থেকেই চীন যাকে পশ্চিমা নেতৃত্বে অবৈধ আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা হিসবে গণ্য করে তা ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। কিন্তু ১৯৮৯ সালে তার অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন শুরু না হওয়া পর্যন্ত তা করার মত রাজনৈতিক সক্ষমতা ও সম্পদ চীনের ছিল না। সে বছর চীনের অর্থনীতিতে ট্রিলিয়ন ডলার যোগ হয় এবং জিডিপি প্রবৃিদ্ধ প্রায় ডবল ডিজিটে দাঁড়ায়। শি-র নেতৃত্বে দেশটি এক জাতীয় জাগরণের অভিযাত্রী হয়েছে ও ক্রমাগত অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে তার প্রভাব বৃদ্ধি করছে। ২০১৩ সালে চীন ইউরেশিয়ার মধ্য দিয়ে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বিশাল অর্থনৈতিক করিডোর পরিকল্পনা ঘোষণা করে।
সুইস ব্যাংক ক্রেডিট সুইসির তথ্যমতে, ঘরের কাছে আসিয়ানভুক্ত ৬ বৃহৎ অর্থনীতির দেশের জন্য চীনের বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগের পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। থাইল্যান্ডের সকল এফডিআই-র ৩০ শতাংশই চীনের, মালয়েশিয়ার এফডিআই-র ২০ শতাংশ এবং এ বছর ফিলিপাইনে সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে চলেছে। চীন শুধু গত বছরেই এশিয়া-প্যাসিফিকে অতিরিক্ত ১.৭৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে মার্কিন সমর্থিত বিশ^ব্যাংক ও আইএফসি-র প্রতিদ্ব›দ্বী নতুন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংককে ব্যবহার করেছে।
এ ধরনের চুক্তি এ অঞ্চল জুড়ে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন করেছে। সে সাথে দেশগুলোর নেতাদের রাজনৈতিক অবস্থান দৃঢ় করতে সহায়ক হয়েছে। অন্যদিকে তা বেইজিং-এর প্রভাব বৃদ্ধি করেছে। পাশপাশি এ সব চুক্তি বড় ধরনের বিরোধ নিরসনেও সাহায্য করেছে। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে দীর্ঘকালের আঞ্চলিক বিরোধের প্রেক্ষাপটে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীন সফরের পর ফিলিপাইনের দুতের্তে ২৪ বিলিয়ন ডলার সাহায্য ও বিনিয়োগের প্রতিশ্রæতি নিয়ে দেশে ফেরেন। এক সরকারী তথ্যমতে, ১৯৯৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে কম্বোডিয়া ১৯.২ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ এফডিআই পায় যার ৪৪ শতাংশই চীনের। গত বছর দক্ষিণ চীন সাগরে আঞ্চলিক ভ‚খন্ডের দাবির ব্যাপারে চীনের একতরফা নিন্দা জানানোর বিষয়টি কম্বোডিয়ার জন্য সম্ভব হয়নি।
এখন মিয়ানমার পুনরায় চীনা বেসরকারী বিনিয়োগের এক ঘাঁটি হয়েেেছ যার মধ্যে রয়েছে সহিংসতা কবলিত রাখাইন রাজ্যে ৭.৩ বিলিয়ন ডলারের একটি গভীর সমুদ্র বন্দর ও ২.৩ বিলিয়ন ডলারের একটি তেল ও গ্যাস পাইপ লাইন। একটি দেশের জন্য্র এটি হচ্ছে এক উল্টো আচরণ যে দেশটি ২০১০ সালে গণতান্ত্রিক সংস্কার শুরু করেছিল ও চীনের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করেছিল।
চীন জাতীয় কংগ্রেসে শি’র পররাষ্ট্র নীতির প্রতি যখন পুনরায় সমর্থন জানাবে তখন এটা দেখার বিষয় যে তার চুক্তিগুলো কিভাবে ফলপ্রসূ হয়। কম্বোডিয়ার লোয়ার সেসান ২ ড্যাম-এর মত অধিকাংশ চুক্তিই সেগুলোতে মানবাধিকারের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা, অস্বচ্ছতা এবং অপ্রীতিকর অংশীদারিত্বের জন্য সমালোচনার শিকার হয়েছে। কম্বোডিয়ার ক্ষেত্রে বাঁধ প্রকল্পের ৪৫ শতাংশই কম্বোডিয়ার রয়াল গ্রæপের মালিকানাধীন যার প্রধান হচ্ছেন কুখ্যাত ধনকুবের কিথ মেং। বড় রকমের ভ‚মি বিষয়ক ছাড়, বহু দশক ব্যাপী নির্মাণ-পরিচালনা-হস্তান্তর চুক্তি ও চীনা ঠিকাদারদের নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন রকম সুবিধার জন্য এসব চুক্তির অনেকগুলো নিয়েই সমালোচনা হচ্ছে।
স্ট্যান্ডফোর্ড বিশ^বিদালয়ের শোরেনস্টাইন এশিয়া-প্যাসিফিক বিশ^বিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া ফোরামের পরিচালক ডোনাল্ড এমারসন বলেন, কো-অপ্টিং, চাপ প্রয়োগ এবং দক্ষিণ এশীয় শাসকদের উপর হম্বিতম্বি চীনের জন্য সম্ভবত দু’ধারি তলোয়ার সৃষ্টি করেেছ। দুর্নীতিগ্রস্ত, কোণঠাসা স্থানীয় শাসকদের চীনের সাথে জোটে আনা যেতে পারে যেমনটি হয়েছে কম্বোডিয়ার ক্ষেত্রে। এ সব শাসকদের এ ধরনের অনৈতিক প্রশ্রয় প্রদান সে দেশের নাগরিক সমাজের কাছ থেকে বিরোধিতার সম্মুখীন হতে পারে যেমনটি ঘটেছে মিয়ানমারে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চীন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ