Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আবুল মনসুর আহমদের ভাষাচিন্তা

প্রকাশের সময় : ১৮ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ মিফতাহুল ইসলাম
আবুল মনসুর আহমদ। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক বিরল মনীষা। সাহিত্য, সাংবাদিকতা, ওকালতি, রাজনীতি সব অঙ্গনেই তিনি স্বনামে খ্যাত। বাংলা ভাষা সম্পর্কে তাঁর চিন্তাধারা অন্যদের চেয়ে আলাদা। তাই ভাষা সম্পর্কে তাঁর চিন্তাধারা বিস্তারিত আলোচনা ও গবেষণার দাবি রাখে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এখনো এ বিষয়ে কোনো গবেষণা হয়নি বললেই চলে।
আবুল মনসুর সাহিত্যে জনগণের ভাষা ব্যবহারের পক্ষে ছিলেন। প্রচলিত চলিত ভাষার বিরুদ্ধে তার সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, এটি পশ্চিম বাংলার নিজস্ব ভাষা, পূর্ব বাংলার স্বকীয়তা এতে নেই। তাই তিনি পূর্ব বাংলার জন্য আলাদা ভাষা প্রচলনের পক্ষে ছিলেন। তিনি অনেক যুক্তিতর্কের মাধ্যমে এ কথা প্রমাণ করেছিলেন, পশ্চিম বাংলার কথ্য ভাষাকে যতই প্রমিত বাংলা বলা হোক না কেন, আসলে পূর্ব বাংলার কথ্য ভাষা পশ্চিম বাংলার কথ্য ভাষার তুলনায় শ্রেষ্ঠ। উদাহরণস্বরূপ সাধু ক্রিয়া ‘খাইতেছি’ এর সাথে পশ্চিম বাংলার ‘খাচ্ছি’ ও পূর্ব বাংলার ‘খাইতাছি’ তুলনা করলে দেখা যায়, পূর্ব বাংলার শব্দই সাধু ভাষার অধিক নিকটবর্তী। অনুরূপভাবে বিশেষ্যের ক্ষেত্রে সাধু শব্দ ‘তুলা’, পূর্ব বাংলার কথ্যরূপেও ‘তুলা’, অথচ পশ্চিম বাংলায় তার বিকৃতরূপ ‘তুলো’ প্রচলিত। কাজেই এসব ক্ষেত্রে তিনি পশ্চিম বাংলাকে অনুকরণের ঘোরবিরোধী ছিলেন। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার ভাষা সম্পর্কে তিনি লিখেন- ‘পশ্চিম বাংলার স্বকীয়তা তার বিকৃতি তার শ্রুতিকটুতা তার অপভ্রুংশ সবই হইয়াছে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য অলংকার ও শালীনতা। আর  পূর্ব বাংলার অধিকতর সাধু মধুর স্বকীয়তা হইয়াছে অভদ্র অশালীন ভালগারটি।’ (সাহিত্যের প্রাণ, রূপ ও আংগিক, বাংলাদেশের কালচার, পৃঃ (৫৩-৫৪) তিনি এই তথাকথিত ‘অভদ্র অশালীন ভালগারটি’কে ‘সৌন্দর্য অলংকার ও শালীনতায় পরিণত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তার সাহিত্যে। তাই তার লেখায় পঞ্চমী বিভক্তি ‘হতে’ এর বদলে প্রায়ই ‘থনে’ দেখা যায়।
পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার ভাষার পার্থক্যকে কেন্দ্র করে তিনি স্বপ্ন দেখতেন ইংরেজি ভাষার দুই সংস্করণ ব্রিটিশ ইংরেজি ও আমেরিকান ইংরেজির মতো বাংলারও দুই সংস্করণ হবে পশ্চিম বঙ্গীয় বাংলা ও পূর্ব বঙ্গীয় বাংলা। তার ভাষায়, ‘মার্কিন জাতির মতো পূর্ব বাংগালীদের দাবীও সীমাবদ্ধ মডেস্ট দাবী। আমরা বাংলা শব্দাবলীর মানে বদলাতে চাই না। আমরা শুধু এসব হরফ ও শব্দ দিয়া পূর্ব বাংলার বুলি বদলাইতে চাই। বাংলা ভাষায় আমরা পূর্ব-বাংগালীর রুহ প্রবেশ করাইতে চাই।’ পূর্ব বাংলার বুলি বদলানো বলতে তিনি পূর্ব বাঙালিদের মুখে চলিত ভাষা হিসেবে পশ্চিম বাংলার শব্দ বদলিয়ে পূর্ব বাংলার নিজস্ব শব্দ প্রচলিত করতে চেয়েছিলেন। তার মতে, মার্কিন জাতির ভাষাগত স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধা ছিল ‘ধর্মীয় কৃষ্টিক ঐতিহ্যিক অবিভাজ্যতা’। আমাদের ক্ষেত্রে সুবিধা হলো পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার সংখ্যাগুরু মানুষের মধ্যে এই অবিভাজ্যতা নেই। সে জন্য আমাদের পক্ষে স্বকীয় ভাষা প্রতিষ্ঠা মার্কিনিদের তুলনায় সহজসাধ্য হওয়ারই কথা। (দ্রষ্টব্য: সাহিত্যের প্রাণ, রূপ ও আংগিক, বাংলাদেশের কালচার, পৃ: ৫১)
এসব ছাড়াও ভাষার ক্ষেত্রে তিনি মুসলমানী স্বাতন্ত্রবোধকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। তার ভাষায়, ‘গোশ্্ত আন্ডা ও পানির মধ্যে ইসলামত্ব নাই বটে, তবে মুসলমানত্ব আছে। ... ... আমরা যদি পানি ছাড়িয়া জল ধরি, তবে ধর্মচ্যুত হইব না সত্য, তবে ঐতিহ্যচ্যুত হইব নিশ্চয়।’  তার মতে, এসব শব্দ শত শত বছর ধরে মুসলমানরা ব্যবহার করছে, পক্ষান্তরে হিন্দুরা এর পরিবর্তে মাংস, ডিম ও জল ব্যবহার করছে। তাই এসব শব্দ এক একটা ‘কালচারেল আইডেন্টিটি’ বা ‘কৃষ্টিক শোনাখ্্তি’ পেয়ে গেছে। (দ্রষ্টব্য: আমাদের ভাষা, বাংলাদেশের কালচার, ১৩০ নং পৃষ্ঠা) তবে এর আগের পৃষ্ঠাতেই অবশ্য তিনি উভয় ধরনের শব্দকেই বাংলা সমার্থক শব্দ বলে উল্লেখ করেছেন। তার ভাষায়, ‘আমি বলি না যে, গোশতের বদলে মাংস, আন্ডার বদলে ডিম এমনকি পানির বদলে জল বলা চলিবে না, সাহিত্যে উভয় শব্দই ব্যবহার করা হইবে প্রয়োজনমতো। কিন্তু এরা একটা ছাড়িয়া আরেকটা ধরিতে যাওয়াতেই আমার জতো আপত্তি।’ অর্থাৎ তার মতে, বাংলার হিন্দু মোসলমান উভয়ে বাংলাতে কথা বললেও, বাংলাতে লিখলেও, তাদের ভাষার মধ্যে একটা ঐতিহ্যগত পার্থক্য থাকবে। এদের কোনো একটিকে প্রমিত বাংলা, আর অপরটিকে অপ্রমিত বাংলা বলা যাবে না। তিনি তার লেখায় অত্যন্ত সচেতনভাবে এই পার্থক্য বজায় রাখতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তার লেখা ‘মোসলমানী কথা’ বইটি জনৈক হিন্দু প্রকাশক অনেক বেশি রয়্যালিটি দিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ‘মোসলমানী বাংলা’ বিষয়ে তার সাথে মতভেদ দেখা দিলে তিনি সেই বইটি ওই হিন্দু প্রকাশককে না দিয়ে তুলনামূলক কম রয়্যালিটির বিনিময়ে মওলানা আকরম খাঁর প্রকাশনীকে দিয়েছিলেন। (আত্মকথা দ্রষ্টব্য)
পশ্চিমবঙ্গের অন্ধ অনুকরণের তিনি ঘোরবিরোধী হলেও বিদেশি শব্দ বাংলায় আত্মীকরণের ব্যাপারে ছিলেন যথেষ্ট উদার। তার মতে, বাংলায় প্রচলিত সব শব্দই বাংলা, তা শব্দটি মূলত আরবি, ফার্সি, ইংরেজি, যে ভাষারই হোক না কেন। এ জন্য তিনি পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় যেসব আরবি ফার্সি শব্দ প্রচলিত ছিল, সেগুলো বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতেন। এক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহারকারী অন্যদের তুলনায় তিনি ব্যতিক্রমী ছিলেন। তিনি নজরুল-ফররুখের মতো বাংলায় অপ্রচলিত আরবি-ফার্সি শব্দ সাহিত্যে ব্যবহারের পক্ষে ছিলেন না। আরবি ফার্সি ছাড়াও ইংরেজি শব্দ আত্মীকরণের ব্যাপারেও তিনি অনেক উদার ছিলেন। তার মতে, ‘চলতি শব্দই বাংলা শব্দ।’ অর্থাৎ বাংলা ভাষায় যেসব বিদেশি শব্দ প্রচলিত আছে, সেসবই বাংলা শব্দ বলে বিবেচ্য হবে। এ বিষয়টি তিনি নিচের উদাহরণের সাহায্যে তুলে ধরেন :
‘আগামী মার্চ মাসে আমাদের ইউনিয়ন বোর্ডের জেনারেল ইলেকশন হইবে। আমার বাবা প্রেসিডেন্টির ক্যান্ডিডেট হইয়াছেন। কাজেই ভোটারদের ক্যানভাস করিতে আমাকে কয়েকটা মিটিং করিতে হইবে। সেজন্য আমি স্কুলে কয়েকদিনের ছুটি চাহিয়া হেড মাস্টারের নিকট এপ্লাই করিয়াছি।’
এটা কি বাংলা ভাষা না? পূর্ব পাকিস্তানে এমন কোনো শিক্ষিত-অশিক্ষিত লোক আছে কি, যে এটা বলে না, বুঝে না?” (আমাদের ভাষা, বাংলাদেশের কালচার, ১৩৮ পৃষ্ঠা)
যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) সব মানুষ এ কথাগুলো, ইংরেজি শব্দে ভরপুর হওয়া সত্ত্বেও বুঝতে পারে, বলতে পারে, তাই আবুল মনসুরের মতে, এই বাক্যে ব্যবহৃত শব্দগুলো এখন বাংলা শব্দ, যদিও উৎস ইংরেজি।
তাই তিনি অনর্থক ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ তৈরির বিরোধী ছিলেন। তার মতে, এক সময় হিন্দু প-িতরা যেমন আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহার করবেন না বলে কাগজ, কলম, দোয়াতের পরিবর্তে ভূর্য পত্র, লেখনী, মস্যাধার ইত্যাদি পরিভাষা সৃষ্টির চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন, এখনো ইংরেজি শব্দের অনর্থক পরিভাষা সৃষ্টি করলে সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি হবে।
এর মানে এই নয় যে তিনি সবক্ষেত্রেই হুবহু বিদেশি শব্দকে বাংলা বলে চালিয়ে দিতে চান, কোনো ধরনের পরিভাষা তৈরিকে মোটেও সমর্থন করেন না। এ বিষয়ে তার নিজের ভাষায়ই শুনুন: ‘তবে হ্যা, এক দিক দিয়া আমাদের পরিভাষা সৃষ্টি করিতে হইবে। সেটা বড় ও দুরউচ্চার বিদেশি শব্দকে ছোট সুউচ্চার করা। ... ... আমাদের জনগণও প-িতদের সাহায্য ছাড়াই অর্ডালি কে আর্দালি, বেঞ্চকে বেঞ্চি, টেবলকে টেবিল, বটলকে বোতল, ডক্টরকে ডাক্তার, ... ... ইত্যাদি হাজারো বিদেশি শব্দকে সহজ ও মিষ্টি দেশি শব্দে পরিণত করিয়াছে।’ অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যেসব বিদেশি শব্দকে রূপান্তরিত করেছে, সেগুলোকে তিনি মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু ভাষার ওপর প-িতি মেনে নেননি।
বাংলাদেশ আজ স্বাধীন দেশ। বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু এরপরও আমরা আজো শিক্ষার মাধ্যমরূপে সর্বত্র বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। আজো উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো হচ্ছে। কিন্তু আবুল মনসুর আহমদ সেই পাকিস্তান আমলেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে গ্রহণের জোর দাবি জানিয়েছিলেন। প্রা ১৯৬৬ সালের ‘একইশা ফেব্রুয়ারি’তে তিনি ‘শিক্ষার মিডিয়াম’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার যারা বিরোধী, তাদের সব যুক্তির জবাব দিয়েছিলেন। এই প্রবন্ধে তিনি অত্যন্ত সরস ভাষায় বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব ধরনের যুক্তির জবাব দিয়ে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছিলেন। তার এ প্রবন্ধটি আজকের বাংলাদেশেও একই রকম প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। এ প্রবন্ধে তিনি বিরুদ্ধবাদীদের সাতটি যুক্তি উল্লেখ করে এগুলোর জবাব দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশেও উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে বাংলা চালুর অসুবিধার কথা বলতে গিয়ে এই সাতটি যুক্তির মধ্যে চারটি যুক্তি উপস্থাপন করা হয়।
আবুল মনসুর আহমদ সাধারণ মানুষের বাংলা ভাষার সমর্থক ছিলেন। বাংলার কোটি কোটি সাধারণ মানুষ যে ভাষাকে নিজেদের ভাষা মনে করে, সে ভাষাকে তিনি সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। বিশেষত পূর্ববঙ্গের মানুষের মুখের ভাষাকে অস্বীকার করে কেবল পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মুখের ভাষাকে স্ট্যান্ডার্ড বাংলা বলে স্বীকৃতি দেয়ার বিরুদ্ধে ছিল তার অবস্থান। পাশাপাশি সংখ্যাগুরু মোসলমানের ব্যবহৃত আরবি ফার্সি মিশ্রিত বাংলাকে অবজ্ঞা করে সংস্কৃত মিশ্রিত প-িতি বাংলাকে সাহিত্যের ভাষা বলে স্বীকৃতি দেয়ার বিরুদ্ধেও ছিল তার শক্ত অবস্থান। শিক্ষাঙ্গন, অফিস, আদালত সব ক্ষেত্রেই তিনি জনগণের বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আবুল মনসুর আহমদের ভাষাচিন্তা
আরও পড়ুন