Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

থানায় জিডি হয় তদন্ত হয় না

| প্রকাশের সময় : ৬ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বছরের পর বছর ফাইলবন্দি হয়ে দেশের বিভিন্ন থানায় পড়ে আছে লাখ লাখ জিডি : জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করার পর অনেকেই হত্যার শিকার হয়েছেন, তারপরেও জিডির তদন্তই হয়নি
উমর ফারুক আলহাদী : মোবাইল ফোনে প্রাণ নাশের হুমকির অভিযোগে রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় গত বছর জিডি করেছিলেন ওই এলাকার বাসিন্দা রমজান আলী। এর আগের বছর জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে জিডি করেছিলেন ঝুট ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম। তাদের জিডির কোন তদন্ত হয়নি। বরং জিডি করায় সন্ত্রীরা ক্ষেপে গিয়ে তাদের গুলি করে হত্যা করেছে। ছয় বছর আগে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী সুলতানের স্ত্রী বিউটি আক্তার জিডি করেছিলেন তার স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর। কিন্ত আজ পর্যন্ত এ জিডির কোন তদন্তও হয়নি। থানায় জিডি করার পরেও মিরপুরের ঝুট ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামকে নিরাপত্ত দিতে পারেনি পুলিশ। তাকে গুলি করে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। গত বছর রাজধানীর মতিঝল থানা এলাকায় কমলাপুরে মোবাইল ফোন সেট এবং মূল্যবান কাগজপত্রসহ নগত টাকা পয়সা অস্ত্রের মুখে ছিনিয়ে নেয় একজন সংবাদ কর্মীর। তিনি থানায় ছিনতাই মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা না নিয়ে জিডি করতে বলেন। তবে জিডি করার পর আজ পর্যন্ত এ নিয়ে পুলিশের কোন তৎপরতা নেই। মতিঝিল থানার তৎকালীন ওসি ফরমান আলী এ জিডির তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিলন আবদুল আউয়াল নামের একজন এসআইকে। দুই বছর অতিবাহিত হলেও মালামাল উদ্ধার দুরের কথা তদন্ত কর্মকর্তা কোন দিন এ ব্যাপারে খোঁজ খবরও নেননি বলে ওই সংবাদ কর্মী অভিযোগ করেছেন। এভাবে প্রতি বছর সারা দেশে লাখ লাখ জিডি হচ্ছে, কিন্ত এসব জিডির অধিকাংশই তদন্ত হয়নি। শুধু জিডি নয়, অনেক চুরি ,ছিনতাইয়ের ঘটনাও বছরে পর বছর তদন্ত হয়না। এ অভিযোগ ভূক্তভোগীদের। তবে পুলিশ বলছে জিডি দায়ের করার পর আমল যোগ্য অপরাধ হলেই তা তদন্ত করা হয়।
জানা যায়, বিভিন্ন সময় জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করার পর খোদ রাজধানীতেই বেশ কয়েকজন ব্যক্তি হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। বছর তিনেক আগে অপহরণের পর হত্যা করা হয় পল্লবীর আবদুল কুদ্দুস নামের একজনকে। এর আগে তার পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় জিডি করা হয়েছিল, কিন্তু পুলিশের সহযোগিতা মেলেনি। চাঁদা না দেওয়ায় দুই বছর আগে শেওড়াপাড়ায় ঝুট ব্যবসায়ী নূরুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। পরিবারের অভিযোগ, মৃত্যুর আগে নূরুল ইসলাম নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেছিলেন, কিন্তু পুলিশ কোনো সহায়তা করেনি।
রাজধানীর নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী সুলতান হাওলাদারের কোন সন্ধান পায়নি আর পরিবার গত ৬ বছরেও। তার স্ত্রী বিউটি আক্তার জানান, নিখোঁজের জিডির তদন্ত দূরের কথা খোঁজও নেয়নি পুলিশ। অন্যদিকে আট বছর পরেও রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের পূর্ব রসূলপুরের ৭ নম্বর গলির ভাড়াটিয়া সাজেদা আক্তার সাজুর একমাত্র মেয়ে শাহিদা আক্তার লিমার সন্ধান মিলেনি। নিখোঁজের পর থানায় জিডি করেছিলেন তার মা সাজেদা। কিন্ত আজ পর্যন্ত পুলিশ এ জিডির কোন তদন্তও করেনি, খোঁজখবরও নেয়নি বলে জানিয়েছেন সাজেদা আক্তার। তিনি জানান, তখন স্থানীয় মোহাম্মদিয়া কিন্ডারগার্টেনের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী ছিল লিমা (৭)।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অধীন ৪৯টি থানায় প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০টি করে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয় প্রতিটি থানায়। প্রতিদিন গড়ে এক হাজারের বেশি সাধারণ ডায়েরি হলেও এর অধিকাংশই থেকে যায় ফাইলবন্দী। গুরুত্ব অনুসারে জিডির কোন ক্যাটালগও নেই ডিএমপি কিংবা পুলিশ সদর দফতরে। শুধু তাই নয়, কোন কোন জিডির দ্রæত গতিতে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করে নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন সে সম্পর্কেও নেই সুস্পষ্ট কোন নির্দেশনা। ডিএমপির বিভিন্ন থানা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ইনকিলাবকে বলেন, জিডি একটি আইন গত প্রক্রিয়া। থানায় জিডি দায়ের করার পর তা যথারীতি তদন্ত হয় এবং তদন্তে অপরাধের প্রমাণ পেলেই নিয়মিত মামলা হয়। তিনি বলেন, মহানগরীর বিভিন্ন থানায় প্রতিদিনই জিডি হচ্ছে, তবে জিডি করতে থানায় গিয়ে কেউ হয়রানির শিকার হয়েছেন এমন অভিযোগ আমার কাছে নেই। কমিশনার বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
পুুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে বছরে বিভিন্ন থানায় প্রায় ১২ লাখ জিডি হয়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ৯ লাখ ৭০ হাজার জিডি রেকর্ড হয়েছে। তবে এসব জিডির কতগুলোর তদন্ত হয়েছে বা কতগুলো তদন্ত হয়নি এর কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই পুলিশের কাছে। বেশির ভাগই ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে। জিডির তদন্ত না হওয়ায় মানুষের জীবন হয়ে উঠছে সংকটাপন্ন।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, হাজার হাজার মামলা তদন্ত করতেই সময় চলে যায়। পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায় না বলেই সব জিডির তদন্ত করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার কিছু জিডির তদন্ত করে ঘটনার সূত্রই পাওয়া যায়নি।
জানা যায়,মানুষের মূল্যবান কোনো জিনিস পত্র. বা টাকা পয়সা ,স্বর্ণালংকার, মোবাইল ফোন সেট, সনদপত্র, দলিল, লাইসেন্স, পাসপোর্ট, রসিদ, চেকবই, ক্রেডিট কার্ড, ইত্যাদি হারালে থানায় জিডি করেন তাঁরা। আবার কেউ অপহরণ বা নিখোঁজ থাকলেও থানা জিডি করা হয়। কিন্ত থানায় জিডি করার পর বছরের পর বছর চলে গেলেও এসব ঘটনার তদন্ত হয় না। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জিডি করলে বা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নিদের্শ থাকলে মাঝে মধ্যে দুই একটি ঘটনার তদন্ত হয়। জিডি করার পর প্রথম দিকে কয়েকদিন সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা খোঁজ খবর নেন। তারপর আর কোন খবর থাকে না। তবে বেশিরভাগ জিডির কোন তদন্তই হয় না। শুধু রাজধানীর ৪৯ থানায় প্রতি বছর গড়ে ২ লাখ ৩৫ হাজার সাধারন ডায়েরী হয়। কিন্ত বছরে কয়টি জিডির তদন্ত হয় বা ভূক্তভোগী ব্যক্তিরা এর কি সুফল পাচ্ছেন তার কোন পরিসংখান নেই পুলিশের হাতে।
জানা যায়,প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার লোকজনকে অপরাধীরা কখনো সশরীরে, কখোন চিরকুট দিয়ে, টেলিফোনে কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে চাঁদা দাবি করে। আবার অন্য কোনো কারণে হুমকি দিচ্ছে অপরাধীরা। শিক্ষক, ব্যবসায়ী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সাংস্কৃতিক কর্মী, চাকরিজীবী, শ্রমজীবী, রাজনীতিকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ বিভিন্ন সময় হুমকির শিকার হচ্ছেন। নিজেদের জানমালের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের সাহায্য পেতে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে থাকে ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা। তবে ফলাফল শূন্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভিআইপি বা প্রভাবশালী কেউ জিডি করলে সেই ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যায়। পুলিশ জিডির বিষয়ে খোঁজ নেয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিরাপত্তারও ব্যবস্থা করে। কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে জিডির একটি নম্বর দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে পুলিশ। যথাযথ তদবির করা হলে কিছু তৎপরতা দেখা যায়। অন্যথায় থানায় জিডি পড়ে থাকে বছরের পর বছর। অনেক সময় জিডি করে সাধারণ মানুষকে বিপাকেও পড়তে হয় এমন নজিরও কম নয়। তদন্ত কর্মকর্তা জিডি দায়েরকারী ব্যক্তিকে অবান্ত প্রশ্ন করে নানাভাবে হয়রানিও করেন। এমন অভিযোগ অহরহর পাওয়া যায়।
অনেক ভুক্তভোগীর অভিযোগ, জিডিতে বিপদ বরং বাড়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ কোনো খোঁজই নেয় না। উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়। আর পুলিশ তদন্ত শুরু করলেও অগ্রগতি থাকে না তেমন। এ ক্ষেত্রে পুলিশের সহযোগিতা তো মেলেই না, বরং যাদের বিরুদ্ধে জিডি করা হয় তারা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া সেলের প্রধান এবং উপ-পুলিশ কমিশনার মাসুদুর রহমান গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, সকল জিডির তদন্ত হয় না। জিডি করার পর আমল যোগ্য ঘটনার তদন্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে যথারীতি মামলা করা হয়। অনেক জিডি আছে যে গুলো আমলযোগ অপরাধের আওতায় পরে না এবং সত্যতাও পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, জিডি হলে তদন্ত হয়না এটা সঠিক নয়। তবে কিছু কিছু বিষয় আছে, যেমন কারো সনদ হারিয়ে গেল, বা কাগজপত্র হারিয়ে গেল এ ধরনের জিডি করা হয় মুলত ওই ব্যক্তির পরবর্তী প্রয়োজনের জন্য। এ ধরনের জিডি কি তদন্ত হবে ?
আইন বিশেষজ্ঞরা জানান, থানার জেনারেল ডায়েরি (জিডি) নামেই আইনগত পদক্ষেপ। বাস্তবে অর্থহীন আনুষ্ঠানিকতা। কখনও কখনও উল্টো হয়রানি এবং সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পরিণত হওয়া। জিডি করার কারণে খুনের ঘটনাও ঘটছে। নিরাপত্তার পরিবর্তে দেখা দিচ্ছে প্রাণনাশের আশঙ্কা। রাজধানীর ৪৯টি থানায় প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার জিডি নথিভুক্ত হয়। এসব জিডির প্রেক্ষিতে যথাযথ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া দূরের কথা পুলিশ একে অর্থ আদায়ের হাতিয়ার হিসাবেই ব্যবহার করছে। অনেক ক্ষেত্রে দুই পক্ষের কাছ থেকেই হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, জবাবদিহিতা না থাকায় বাস্তবে এটি শুধু কাগুজে আইনে পরিণত হয়েছে।
ডিএমপি ও পুলিশ সদর দফতর বলছে, শুধু রাজধানীর থানাগুলোতে বছরে ৫থেকে সাড়ে ৫ লাখ জিডি হয়। হাজার হাজার মামলা তদন্তে জন্যই যেখানে পর্যাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা নেই সেখানে সব জিডির তদন্ত করা অসম্ভব। রাজধানীতে পুলিশের ৪৯টি থানায় গড়ে ৪০টি করে জিডি দায়ের করেন ভুক্তভোগীরা।

 



 

Show all comments
  • মানস হেমব্রম ১ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১০:৫৯ এএম says : 0
    স্যার আমার মতে এটাই বলে যে , যাদের কে মার ধর করে থানায় জিডি করেছে বা খুন করার হুমকি দিয়েছে তাদের কেশ গুলিতে একটু আগে তদন্ত করা উচিৎ ৷ যাদের ফোন,বাইক,সাইকেল এসব হারানোর জিডি গুলো পরে তদন্ত করলেও চলবে কেননা একটা মানুষের ফোন,সাইকেল হারিয়ে গেলে সে ওটা কিনতে পারবে ,স্যার কিন্তু একটা মানুষের জীবন চলে গেলে সেটা আর কখনো পাওয়া যাবেনা ৷ কী ঠিক বললাম তো ৷
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: থানা

৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ