হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আপীল বিভাগ কর্তৃক চূড়ান্তভাবে বাতিল হওয়ার পর আলোচনা সমালোচনার স্তর এখন সীমালংঘন থেকে ‘কে হারে কে জিতে’, পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল মনে করছে, রায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে অবহেলা বা খাটো করা হয়েছে। এ বিষয়টিকে মাথায় রেখেই সরকার ও সরকার ঘরনার প্রতিটি স্তর থেকে যেসব বক্তব্য রাখা হচ্ছে তা বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে কেন্দ্র করেই। বিচারপতি সিনহা, তার প্রধান বিচারপতি হওয়ার পিছনে প্রধানমন্ত্রীর অবদান মনে রেখেও তিনি (প্রধানমন্ত্রী) ও তার দল বর্ণিত বিষয়ে অত্যন্ত নাখোশ। কিন্তু প্রধান বিচারপতি হিসেবে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যেমন- রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার। অ্যাপিলেট ডিভিশন রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের অন্যতম অঙ্গ বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ স্তর যার প্রতি অসন্তোষ্টির প্রকাশ কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে তা নির্ধারিত হওয়া আবশ্যক; বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগের নিজ নিজ অধিক্ষেত্র নির্ধারণের প্রয়োজনে, যা এখন জেদের বশবর্তী হলে ভবিষ্যত প্রজন্মের নিকট খারাপ নজির সৃষ্টি হতে পারে। এ ব্যাপারে আমাদের সর্তক থাকা বাঞ্চনীয়।
ষোড়শ সংশোধনী বা সংবিধানের ৯৬(২) অনুচ্ছেদ প্রমাণ করে যে, প্রধান বিচারপতি বা বিচারপতিগণ অসদাচরণ বা অযোগ্যতার প্রশ্নে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নন। রায় নিয়েও সমালোচনা করা যাবে এটাও বর্তমান LAW OF JURISPUDENCEস্বীকার করে। স্বনামধন্য বিচারপতিগণ এমর্মে Verdict দিয়েছেন যে, Judgment is a public property| তাই এর সমালোচনা করা যাবে। কিন্তু রায় প্রণয়নের DISHONESTY নিয়ে বিচারপতিকে অভিযুক্ত করা যাবে কি না এ মর্মে বিচার ব্যবস্থায় আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত কোথাও সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই; যেমনটি বলা হয়েছে অসাদাচারণ ও আযোগ্যতার প্রশ্নে। রায় নিয়ে বিক্ষুব্ধ হলে উচ্চ আদালতে আপিল/রিভিশন করার বিধান রয়েছে। সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ প্রদত্ত রায় বা আদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৫ মোতাবেক নিজ রায় ও আদেশ পুন:বিবেচনা করতে পারে। উক্ত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘সংসদের যে কোন আইনের বিধানবলী সাপেক্ষে এবং আপিল বিভাগ কর্তৃক প্রণীত যে কোন বিধি সাপেক্ষে আপিল বিভাগের কোন ঘোষিত রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুন:বিবেচনার ক্ষমতা উক্ত বিভাগের থাকিবে’। এতদসত্তে¡ও সরকারি মহলের বিভিন্ন বক্তব্য ও উচ্চ পর্যায়ে বৈঠকের পর বৈঠক করে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে তা অভিপ্রেত নয়। বিচার বিভাগ, সরকার, রাষ্ট্র কোনটাই কারো পৈত্রিক সম্পত্তি নয়, বরং সময়ে সময়ে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়ে চেয়ারের মর্যাদা কেউ সম্মুন্নত রেখেছেন বা কেউ ব্যাত্যয় ঘটিয়েছেন। তবে উভয় বিভাগই জনগণের অর্থে জনগণের কল্যাণের জন্য লালিত। ফলে ন্যায়নীতির প্রশ্নে কোন পক্ষ বিক্ষুব্ধ হলেই এমন কোন সীমালংঘন করতে পারে না, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি কালো নজির হয়ে দাঁড়ায়। ৮০৯টি অনুচ্ছেদের এই রায়ে আপিল বিভাগের ৭ জন বিচারপতিই ঐক্যমত পোষণ করে রায়টি প্রণয়ন ও ঘোষণা করেছেন। ফলে এককভাবে কোন বিচারপতি এ রায়ে প্রভাব বিস্তার করেছেন তা বলা যাবে না। তারপরও প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যে সকল বক্তব্য আসছে, তাতে কি তিনি অভিযুক্ত না সমালোচিত এটাই পর্যালোচনার বিষয়। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে পর্যালোচনা অবশ্যই করা দরকার এ কারণে যে, এখানেই জাতি সত্ত্বা শেষ হয়ে যাবে না, জাতি টিকে থাকবে রোজ কেয়ামত পর্যন্ত। তাই বার বার বলছি, সীমালংঘনের পূর্বেই সীমা নির্ধারিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
সরকারি ঘরনার দায়িত্বশীলদের বক্তব্য পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেছেন, ‘বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আদালত যতবার বাতিল করবে সংসদে ততবারই নতুন করে এই সংশোধনী পাস করা হবে। বিচারপতিদের চাকরি সংসদই দেয়, সুতরাং তাদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই থাকা উচিত।’ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, ‘রাজনীতি করতে চাইলে বিচারপতির আসন ছেড়ে দিয়ে মাঠে আসুন। সাংবিধানিক পদে থেকে রাজনৈতিক কথাবার্তা বলে বিচার বিভাগকে কলুষিত করবেন না।’ শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, ‘পার্লামেন্ট যদি অবৈধ হয়, তোমার নিয়োগও অবৈধ। কারণ এই পার্লামেন্ট রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেছে। সেই রাষ্ট্রপতি তোমাকে নিয়োগ দিয়েছে। তোমার নিয়োগ অবৈধ, তুমি অবৈধ চিফ জাস্টিস।’ গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেছেন ‘আপনি যা ভাবছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে যা বলছেন তা ঠিক নয়। বাংলার মানুষ জানে- আপনি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন।’ এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কটাক্ষ করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন।’ খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘তার যদি নৈতিকতাবোধ থাকে তাহলে তিনি স্বেচ্ছায় চলে যাবেন। না হলে আইনজীবীরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবেন।’
রায়ে সরকারের যে হতাশা তা সরকারই স্পষ্ট করেছে। কারণ মন্ত্রীদের কথা যখন জনগণ প্রত্যাখ্যান করছে তখন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক পাল্টা বিবৃতি দিয়ে বলছেন যে, এটা দলের বা সরকারের বক্তব্য নয়, বরং এটা ওমুক মন্ত্রীর ব্যক্তিগত মন্তব্য। শপথ বাক্য পাঠ করে, রাষ্ট্রীয় ফ্লাগ উড়িয়ে দায়িত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করে কেউ কি ব্যক্তিগত বক্তব্য দিতে পারেন? যদি তাই হয় তবে দল বা সরকার থেকে কোন সংশোধনী পদক্ষেপ নেয়া হয় না কেন? যেমনটি নেয়া হয়েছিল আ. লতিফ সিদ্দিকীর বেলায়, ধর্ম নিয়ে কূটক্তি করার কারণে। মূলত, দেখা যাচ্ছে যে, বক্তব্য দেয়ার পর যখন জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয় তখনই দল বা সরকার থেকে বলা হয় যে, ব্যক্তিগত বক্তব্য। ব্যক্তিগত বক্তব্য যদি বেফাস হয় বা আদালত অবমাননার শামিল হয় তবে সে মুখে তালা লাগানোর বিধান যখন রয়েছে তাও কার্যকর করার দায়িত্ব বিচার বিভাগের রয়েছে, তার ভাবমর্যাদা সমুন্নত রাখার স্বার্থে।
অন্যদিকে সরকারি দল থেকে বলা হয়েছে যে, ‘এ রায় একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক লিখে দিয়েছে।’ বাক্যটি সংক্ষিপ্ত হলেও এর অর্থ অনেক ব্যাপক। এ বক্তব্যটি সম্পূর্ণভাবে একটি অভিযোগ, যেখানে শুধু প্রধান বিচারপতিকে নয়; বরং সম্পূর্ণ আপিল বিভাগকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর প্রমাণ করার দায়িত্ব কার? প্রধান বিচারপতি বলেছেন যে, তিনি রাজনৈতিক ফাঁদে পা দিবেন না। যদি তাই হয় তবে বিচার বিভাগকে বা তাকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হলেও কি তিনি তা খন্ডাবেন না? তিনি আরো বলেছেন যে, ‘জীবন দিবেন কিন্তু পিছু হটবেন না।’ এ বক্তব্যটিও নিশ্চয় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার স্বার্থে। তবে কেন এ নিরবতা, নাকি পিছুটান?
রায়টি নিয়ে সরকারের যে টেনশন তা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণ নিশ্চিত যে, সরকার এখন বেকায়দায়। প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গহর রিজভী প্রধান বিচারপতির সাথে সাক্ষাৎ করেন। এটা সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎ নয় অথবা প্রধানমন্ত্রীর অগচোরেও এ সাক্ষাৎ নয়। প্রধানমন্ত্রীর এক বিশ্বস্থ দূত হিসেবেই পররাষ্ট্র উপদেষ্টা প্রধান বিচারপতির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন, নিশ্চয় তা শুধুই সৌজন্যমূলক ছিল না। প্রধান বিচারপতির সাথে সরকারের এ টানপোড়েন কোথায় শেষ হবে তা বলা যাচ্ছে না। কারণ পত্রিকান্তরে প্রকাশ, দুর্নীতি দমন বিভাগে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১২৬টি অভিযোগ জমা জড়েছে। দুদক বলেছে যে, অভিযোগ তারা সর্ট আউট করছে, বা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ ভৌগোলিক দিক থেকে একটি ছোট রাষ্ট্র হলে অভিজ্ঞতা ও চমক রয়েছে অনেক। এখানে দু’জন রাষ্ট্রপতি নিহত হয়েছেন সেনা বাহিনীর লোকদের হাতে। খন্দকার মোশতাক ও জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রপতির পদ ভোগ করার পরও দীর্ঘ দিন জেল খেটেছেন। রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল অধ্যাপক বি, চৌধুরী’কে। সাবেক ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও জেল খেটেছেন। সাবেক সকল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশের হাতে লাঞ্চিত হয়েছেন। অতএব, বিচিত্র এই দেশে জেল কখন কার জন্য আর্শীবাদ (!) হয়ে যায় কেউ তা বলতে পারে না। আবার অন্যদিকে উচ্চ আদালতের কোন রায়ে ভবিষ্যতে যদি ৫ই জানুয়ারি/২০১৪ এর নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়, তবে এখন যারা জেলে পাঠানোর হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন তাদের পরিণতি উল্টো হয়ে যেতে পারে। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনিশ্চয়তা কোন দিকে মোড় নেয় তা এখনো আঁচ করা যাচ্ছে না। উপমহাদেশের রাজনীতি যদিও উত্তরাধিকার ভিত্তিক, তবুও এর স্থায়িত্ব দীর্ঘস্থায়ী নয়।
বিচার বিভাগকে অনেক ধকল সইতে হচ্ছে। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, যার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রেও আছে। অন্যদিকে ‘পত্রিকার সম্পাদক’ থেকে রায় লিখানোর যে অভিযোগ, তা হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক তদন্ত হতে হবে, নতুবা আদালত অবমাননার কৈফিয়ৎ তলব করে এর নিষ্পত্তি করতে হবে, নতুবা বক্তব্যটি বিলীন হওয়ার পরিবর্তে ইথারে ভাসতেই থাকবে যা বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদার জন্য একটি কালোছায়া হয়ে রয়ে যাবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ভাবমর্যাদা রক্ষার স্বার্থে এখানে আপোসের কোন সুযোগ নেই। অভিযোগটির অবশ্যই আইনগত নিষ্পত্তি হতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।