Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দোকলাম ঘটনায় সংযম ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে ভুটান

ভারত ও ভারতীয় মিডিয়া বিরোধী জনমত বিকশিত হচ্ছে

| প্রকাশের সময় : ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দি কনভার্সেজেসন : এবারের গ্রীষ্মে হিমালয়ের দোকলাম পাস নামে পরিচিত মালভূমিতে ভারত ও চীনের দু’মাস ধরে পরস্পরের মুখোমুখি থাকার খবরটি খুব বেশী প্রচার লাভ করেনি।
ভারতের সিকিম রাজ্যকে প্রতিবেশী ভুটান থেকে আলাদা করে রাখা এ ছোট এলাকাটি চীন ও ভুটানের মধ্যে বিরোধপূর্ণ এলাকাগুেেলার অন্যতম। নিজের স্বার্থে এবং সীমান্ত সমস্যা বিষয়ে ভুটানের সাবেক প্রতিনিধি হিসেবে ভারত এ এলাকা নিয়ে চীনের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে।
ভুটানের সাথে চীনের সামান্ত বিরোধের ইতিহাস পুরনো। গত শতকের ’৫০-এর দশকে চীন তিব্বত দখল করার পর এ বিরোধের শুরু। আর বর্তমান বিরোধ শুরু হয় জুন মাসে চীন দোকলামে একটি সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু করার পর। এর জবাবে ভারত সেখানে সৈন্য প্রেরণের পর উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
দোকলাম ঘটনা যেমন চীন ও ভুটানের মধ্যে অমীমাংসিত সীমান্ত সমস্যার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে তেমনি চীন ও ভারতের মধ্যকার সীমান্ত বিরোধের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে। ১৯৪৯ সালে ভারত ও ভুটানের মধ্যে স্বাক্ষরিত বন্ধুত্ব চুক্তির অনুচ্ছেদ ২ এর মূল শর্ত অনুযায়ী ভুটান তার পররাষ্ট্র বিষয়ে ভারতের নির্দেশনা মত চলতে সম্মত হয়।
এর ফলে ১৯৫০-এর দশকে ভারত চীনের সাথে ভুটানের সীমান্ত বিরোধ আলোচনায় তার এ অধিকার প্রয়োগ করে। কিন্তু চীনা কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৬২ সালে বিপর্যয়কর ইন্দো-চীন যুদ্ধ দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটায়।
ভুটানের উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ সামান্য কিছুটা শিথিল হলে ভুটান ১৯৮৪ সালে চীনের সাথে দফায় দফায় আলোচনায় বসে। এ আলোচনা ১৯৯৭-এর দিকে একটি সমাধানের দিকে এগোনোর সময় দুর্ভাগ্যবশত ভুটান তার দাবিগুলোর বাপারে সংশোধনী আনে। পর্যবেক্ষকগণ ও বহু ভুটানি মনে করেন যে ভারতের প্রচন্ড চাপের কারণেই ভুটানের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে।
২০০৭ সালে ভুটান ১৯৪৯ সালে ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত তা চুক্তিতে পরিবর্তন সাধনে নয়াদিল্লীর সম্মতি আদায় করা বহু পর্যবেক্ষককে বিস্মিত করে। ঐ বছর স্বাক্ষরিত নতুন চুক্তিতে ভুটানের পররাষ্ট্র নীতি ভারতের নির্দেশনায় চলার ধারাটি অপসারণ করা হয়। সংশোধিত অনুচ্ছেদ ২-এ বলা হয়, দু’দেশ পরস্পরকে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা করবে ... কেউই অন্যের জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর কাজে নিজ ভূখন্ড ব্যবহার করতে দেবে না। এ পরিবর্তন ভুটানকে তা পররাষ্ট্র নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভাবে সক্ষম করে।
দোকলাম বিরোধ চীন ও ভারতের প্রধান রাজনীতিকদের জাতীয়তাবাদী আবেগপূর্ণ কথাবার্তার উৎস হয়ে দাঁড়ালেও ভুটান এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য সংযম পালন করে। এ সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখার আছে।
জুলাই মাসে বিরোধ বৃদ্ধি পাওয়ার পর তিব্বতি ঐতিহাসিক সেরিং শাক্য বলেন যে ভুটান তার ব্যাপার নিজেই সামলাতে পারে বলে তার বিশ^াস। চীন-ভারত আট সপ্তাহের একটানা উত্তেজনার প্রেক্ষিতে ভুটানের ভূমিকা থেকে তা ভালোভাবে দেখা গেছে। বিরোধপূর্ণ এলাকা থেকে শেষ পর্যন্ত চীনা প্রত্যাহার নিশ্চিত হয়েছে। নিতান্ত ক্ষুদ্র দেশ হওয়া সত্তে¡ও তার অস্তিত্ব প্রদর্শন করেছে ভুটান । তবে দোকলাম থেকে বড় ধরনের শিক্ষা নেয়ার রয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমের রাজনৈতিক সম্ভাবনা
ভুটানে অনলাইন বিতর্ক আধুনিক সামাজিক মাধ্যমের গুরুত্ব তুলে ধরেছে। এ ঘটনা বিষয়ে সাধারণ ভুটানিরা তাদের উদ্বেগ ও মতামত ব্যক্ত করার জন্য অনলাইন সংবাদপত্র ও আলোচনার ফোরাম ব্যবহার করেছে। যে দেশে মাত্র ১৯৯৯ সালে টেলিভিশন চালু হয়েছে সে দেশে এটা এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন বটে। বস্তুত শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ‘দি ভুটানিজ’ ছাড়া ভুটানের মূলধারার সংবাদ মাধ্যম খুব কমই দোকলাম ঘটনার কথা উল্লেখ করেছে যার মধ্য দিয়ে দোকলাম ঘটনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে সরকারের সংযম প্রকাশিত হয়েেেছ।
ভুটান আগামী বছর তার সংসদীয় গণতন্ত্রের দশ বছর পূর্তির দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রেক্ষাপটে দোকলাম ঘটনা এ কথাই বলে যে ভুটানে রাজনৈতিক আলোচনা ও সম্পর্কের এক নতুন পর্যায়ের বিকাশ হচ্ছে। বহু মতামত ব্যক্ত হয়েছে যা ভারতীয় মিডিয়ার তীব্র সমালোচনা মূলক। ভুটান সরকারের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক হচ্ছে ব্যাপক ভিত্তিক জনমত যে ভারত ভুটানকে নিয়ন্ত্রণ করা অব্যাহত রাখতে চায়। কারণ, প্রধানমন্ত্রী মোদির সাথে ভুটান সরকারের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
ভুটানি বøগার সোনাম তাসি একটি অনলাইন পোস্টে প্রকাশ্যে বলেছেন যে ভুটানি রাজনীতি ও মিডিয়ায় একটি অলিখিত ‘ নো গো জোন’ আছে। তাশির পোস্টের লক্ষ্য ভারত এবং ভুটানের উপর তার অর্থনৈতিক প্রভাব। যাহোক, তার পোস্ট থেকে যা দেখা যায় তা হচ্ছে ভুটানের রাজনৈতিক আলোচনার এক নতুন বিকাশমান দিক যা বিদ্যমান রাজনৈতিক ট্যাবুর প্রতি এক চ্যালেঞ্জ।
ভুটান ও প্রধানমন্ত্রী শেরিং টোবগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার সংযম ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার মাধ্যমে সাম্প্রতিক সীমান্ত সমস্যা পাড়ি দিয়েছে। ভুটানিরা এখন চীনের সাথে তাদের চলমান সীমান্ত সমস্যার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করতে চাইতে পারে। চীন-ভারত দু’দেশের বাক-বিতন্ডা নিছক বাক-বিতন্ডা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। তা সত্তে¡ও দোকলাম পাসের ঘটনা প্রতিবেশীদের সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভুটানের জন্য এক উৎসাহ ব্যঞ্জক ঘটনা বলে গণ্য হবে।
ভুটান সরকার দোকলাম ঘটনা সম্মানজনক ভাবে মোকাবেলার মধ্য দিয়ে যে পরিপক্বতা প্রদর্শন করেছে তার জন্য মর্যাদা পাবার দাবিদার। এ ঘটনার পর প্রথম দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং একমত হয়েছেন যে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটা উচিত হবে না।
দোকলাম ঘটনা ভুটানে আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে শেরিং টোবগের ক্ষমতাসীন দলের প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধি করতে পারে। যেট নিশ্চিত সেটা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের গণতান্ত্রিকায়নের প্রভাব ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ২০০৮ ও ২০১৩ সালের নির্বাচন থেকে সুস্পষ্টভাবে আলাদা করবে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ