Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আমি খুব মিথ্যাবাদী ছিলাম গুন্টার গ্রাস

ই ন্টা র ভি উ

লোকমান তাজ | প্রকাশের সময় : ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

গুন্টার গ্রাস জন্মেছিলেন ডানজিগে ১৯২৭ সালের ১৬ অক্টোবর। গ্রাসের জন্মস্থান ডানজিগ বর্তমানে পোল্যান্ডের গিডেনস্ক শহর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাধ্যতামূলকভাবে অংশ নিতে হয়েছিল তাঁকে। যুদ্ধবন্দি হিসেবে সাজাও খেটেছেন। ছাড়া পেয়ে শ্রমিক হিসেবে কয়লাখনিতেও কাজ করেছেন। পরে শুরু করেন লেখালেখি। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য টিন ড্রাম’। এর পর একের পর এক প্রকাশিত হয় ‘ক্যাট অ্যান্ড মাউজ’ (১৯৬১), ‘ডগ ইয়ার্স’ (১৯৬৫)। গ্রাসের এই তিনটি উপন্যাস পরিচিত ডানজিগ ট্রিলজি নামে। ২০০৬ সালে তাঁর প্রথম আত্মজীবনী ‘পিলিং দ্য অনিয়ন’ প্রকাশিত হওয়ার পর জার্মানিতে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি হয়। কারণ, সেখানে গ্রাস লিখেছিলেন তিনি হিটলারের ওয়াফেন-এসএস বাহিনীর সদস্য ছিলেন। ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল জার্মানির লুবেকে ৮৭ বছর বয়সে মারা যান তিনি। তবে এর আগে বিশ্বব্যাপী রাজনীতিসচেতন লেখক এবং শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৯৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান গ্রাস। তবে শুধু লেখালেখিতেই নিজেকে বেঁধে রাখেননি গ্রাস। কবিতা ও উপন্যাসের পাশাপাশি লিখেছেন মঞ্চনাটক। গ্রাফিক ডিজাইন করেছেন, ভাস্কর্য তৈরি করেছেন, ছবি এঁকেছেন। প্যারিস রিভিউ-এ গুন্টার গ্রাস দীর্ঘ একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকার দুই কিস্তিতে নিয়েছিলেন এলিজাবেথ গ্যাফনি। সাক্ষাৎকারে তিনি প্রাণ খুলে নিজের লেখালেখি, শৈশব, নিজ পরিবার, রাজনৈতিক মতাদর্শ ছাড়াও নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটির চুম্বকাংশ পাঠকদের জন্য-
এলিজাবেথ: কোন প্রক্রিয়ায় আপনি একজন লেখক হয়ে উঠেছিলেন?
গ্রাস: আমার মনে হয় যে সামাজিক পরিবেশ এর মধ্যে আমার বেড়ে ওঠা, সে পরিবেশে এটা করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলো না। আমি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ। আমাদের ছোট্ট দুকামরার একটা বাড়ি ছিলো। আমার আর আমার বোন জানতাম না নিজস্ব রুম বলে কারও কিছু থাকতে পারে। আমরা থাকতাম একই ঘরে। সেই ঘরের দুই জানালার ফাঁকে ছোট এক কোনায় আমার বই গুলো রাখতাম। শুধু কী বই, জলরঙ করার জিনিস পত্র, এমন অনেক কিছু। মাঝে মাঝে আমি অভাব অনুভব করতাম। ছোট বেলাতেই আমি আমার আত্মার চিৎকার শুনতে পেয়েছিলাম। আর সে জন্যই ছোট বেলা থেকে লিখতে আর আঁকতে শুরু করি। আজ আমার যে সহায়-সম্পত্তি তার সমস্তই হয়তো সেই সূচনার ফলাফল। চারটি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় পড়া-শোনা করেছি। আমার শৈশবের সেই রূঢ় বাস্তবতা আর একটা ঘরের ছোট্ট কোনায় আমি আর আমার বোনের বেঁচে থাকার সেই স্মৃতিকে আমি আজও ভয় পাই।
এলিজাবেথ: এমন পরিপার্শ্বের ভেতর খেলাধুলা অথবা অন্য কোন সহজ কাজ না করে পড়া আর লেখালেখির মত কঠিন একটা বিষয় কেনো বেছে নিলেন?
গুন্টার গ্রাস: শিশু কালে আমি খুব মিথ্যাবাদী ছিলাম। সৌভাগ্যক্রমে আমার মা আবার আমার এই মিথ্যাগুলোকে খুব পছন্দ করতো। আমি তাকে মহান কিছু বলার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলাম। আমার বয়স যখন দশ বছর তখন মা আমাকে পিয়ার গিয়স্ট নামে ডাকতো। সেই সময় আমাদের নেপলস ভ্রমণের কথা ছিলো। মা আমাকে সেই ভ্রমণ সম্বন্ধে একটা গল্প লিখতে বলেছিলো। আর তখন থেকেই আমি মিথ্যা লেখা শুরু করি। আর সেই মিথ্যাচার আমি চালিয়েই গেলাম। বারো বছর বয়সে আমি উপন্যাস লেখা শুরু করি। এটা ছিলো কাশোবিয়াম (শধংযঁনরঁস) সম্পর্কিত, যা বহু বছর পর ‘দ্য টিন ড্রাম’-এ অস্কার (ঙংশধৎ) এর দাদি অহহধ চরিত্রে রূপান্তরিত হলো। প্রথম এই উপন্যাসে আমি একটা ভুল করেছিলাম। উপন্যাসটির প্রথম অধ্যায়ের শেষের দিকে সমস্ত চরিত্রের মৃত্যু ঘটে গেলো। আমার আর শেষ করা হলো না। তবে এটাই হলো আমার উপন্যাস লেখার প্রথম শিক্ষা চরিত্র সম্বন্ধে সচেতনভাবে খুব সাবধান থাকতে হয়।
এলিজাবেথ: কোন মিথ্যা আপনাকে সব থেকে বেশি আনন্দ দিয়েছে?
গুন্টার গ্রাস: যে মিথ্যা কাউকে আঘাত করে না, কাউকে বাঁচায়। আমার অভিনব মিথ্যাচার গতানুগতিক মিথ্যাচার থেকে বেশ আলাদা। এটা আমার পেশা নয়। সত্য বড় ক্লান্তিকর, তুমি মিথ্যার সাথে সত্যকে ব্যবহার করতে পারো। এতে দোষের কিছু নেই। আমি এটা বুঝেছি যে আমার ভয়ংকর মিথ্যার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। যদি কয়েক বছরের জার্মানির রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে কিছু লিখতাম তবে লোকে বলতো, কী নিদারুণ মিথ্যাবাদী।
এলিজাবেথ: প্রথম উপন্যাসে ব্যর্থতার পর আপনি কি করলেন?
গুন্টার গ্রাস: কবিতা আর ড্রয়িং নিয়ে আমার প্রথম কবিতার বই। প্রকৃতপক্ষে আমার কবিতায় ছিলো ড্রয়িং আর গদ্যের সমাবেশ, কখনও কখনও তা চিত্রকল্পের বাইরে, এমনকি কখনও তা শব্দ-বাক্যহীন। এরপর চব্বিশ বছর বয়সে আমি টাইপ-রায়টার কেনার সামর্থ্য অর্জন করি। দুই আঙ্গুলে লেখার পদ্ধতি আমার ভালো লাগলো। ‘দ্য টিন ড্রাম’ এর প্রথম অংশ টাইপ-রায়টারে লেখা। আমার বয়স বাড়তে লাগলো। আমি শুনছি আমার বন্ধুরা কম্পিউটারে লেখে। প্রথম খসড়া আমি হাতে লিখি। প্রিন্টার থেকে ঞযব জধঃ এর প্রথম সংস্করণ লাইনহীন বড় কাগজে বই আকারে পাই। যে কোন বই প্রকাশের আগে সাদা কাগজসহ একটা বøাইন্ড কপি আমি প্রকাশকের কাছ থেকে চেয়ে নেই। প্রথম বার হাতে লেখার পর বাকি দুই তিনবার টাইপ-রাইটারে লিখে লেখাটা শেষ করি। তিন বার না লিখলে আমি কোন বই শেষ করতে পারি না। সাধারণত চারবার সংস্করণের পরই তা মুক্তি পায়।
এলিজাবেথ: প্রতিটা খসড়া লেখার সময় কি ঘটে? প্রথম থেকে শুরু করে আবার শেষ পর্যন্ত পুনরায় লেখেন?
গুন্টার গ্রাস: না। প্রথম বার আমি খুব দ্রুত লিখি। সেক্ষেত্রে আমার পছন্দ নয় এমন অনেক বিষয় থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় বারে লেখার সময় লেখাটি হয় দীর্ঘ, বিস্তারিত ও চ‚ড়ান্ত। হয়তো লেখাটি যথার্থ হলো তারপরও আমার মনে হতে থাকে যে ঠিক রসোত্তীর্ণ হলো না। আবার লিখতে শুরু করি প্রথম বারের স্বতঃস্ফ‚র্ততা নিয়ে; দ্বিতীয় বার যা কিছু প্রয়োজনীয় ছিলো তৃতীয় বার তাই পূরণ করি। কাজটা খুব সোজা নয়, বেশ কঠিন।
এলিজাবেথ: আপনি যখন লেখার ভেতর থাকেন তখন আপনার দৈনন্দিন কাজ কি ?
গুন্টার গ্রাস: যদি কিছু লিখি আর যদি তা হয় প্রথম খসড়া তবে সেক্ষেত্রে আমি প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ পৃষ্ঠা লিখি। আর এটা যদি হয় তৃতীয় খসড়া সেক্ষেত্রে ৩ পৃষ্ঠার বেশী আর আগায় না প্রতিদিন। খুব ধীরে ধীরে অগ্রসর হই।
এলিজাবেথ: সাধারণত সকালে দুপুরে না রাতে লিখেন?
গুন্টার গ্রাস: কখনওই রাতে নয়। আমি রাতে লেখা বিশ্বাস করি না কারণ তখন লেখা খুব সহজে এসে যায়। আর সকালে যখন লেখাটা পড়তে বসি তখন মনে হয় কিছু হয়নি। শুরু করার জন্য আমার দিনের আলো জরুরী। ৯ টা থেকে ১০ টার মধ্যে আমি নাস্তা করি। নাস্তার পর লিখতে বসি। দুপুরে কফি পানের বিরতি তারপর আবার লেখা চলতে থাকে সন্ধ্যা ৭ টা অব্ধি।
এলিজাবেথ: কিভাবে বোঝেন একটা বই এর পর আর লেখার দরকার নেই অর্থাৎ বুঝেন এখানেই লেখা শেষ করা ভালো?
গুন্টার গ্রাস: একটা দীর্ঘ বই লেখা আমার কাছে একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। একটা বই লিখতে ৪/৫ বছর লেগে যায়। যখন আমার মনে হয় আমি নিঃশেষ হয়ে গেছি তখন আমার মনে হয় এখানে ইতি টানা আবশ্যক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন