Inqilab Logo

রোববার ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ কার্তিক ১৪৩১, ৩০ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

নজরুল : এক অপার বিস্ময়

সায়ীদ আবুবকর | প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বিস্ময়কর প্রতিভা বলে এক সময় মধুসূদনকেই মনে করা হতো, কারণ সাত-আট বছরের সাহিত্য-সাধনার দ্বারা, ১৮৫৯-১৮৬৬ সময়কালের মধ্যে, তিনি বাংলা ভাষাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। মহাকাব্য, সনেট, নাটক, প্রহসন, প্রবন্ধ, পত্রকাব্য, অমিত্রাক্ষর ছন্দÑ কী বা আমদানি করেননি মধুসূদন বাংলা ভাষায়! মধুসূদন বিস্ময়কর, সন্দেহ নেই। কিন্তু মধুসূদনের চেয়েও বিস্ময়কর প্রতিভারূপে পরবর্তীকালে আবির্ভূত হন নজরুল। বাংলা ভাষায় নজরুলের আবির্ভাব ছিল জুলিয়াস সিজারের মতো : এলাম, দেখলাম এবং জয় করে নিলাম। অবশ্য নজরুল, সিজারের সাথে নয়, নিজেকে তুলনা করেছেন ধূমকেতুর সঙ্গে।
মধুসূদনের আবির্ভাব ঘটেছিল এমন এক সময়ে যখন বাংলা ভাষায় সাহিত্যের খরা চলছিল। মধুসূদনই প্রথম বাঙালি কবি, যিনি মধ্যযুগীয় রোমান্টিক ঘেরাটোপ থেকে বের হয়ে এসে বাংলা সাহিত্যে আধুনিক কাব্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর যুগে বাংলা সাহিত্যাকাশে এমন কোনো নক্ষত্র ছিল না, যার তীক্ষè আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারে কারো। সেটা ছিল এমন একটা আকাশ, যেখানে বহু দূরের তারার আলোও উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয়। কিন্তু নজরুলের যখন আবির্ভাব ঘটল, তখন বাঙলা ভাষায় চলছিল রবীন্দ্রযুগ; রবির মধ্যাহ্ন-আলোয় সমস্ত চাঁদ-তারা, মোমবাতি, হেজাক, ধূপকাঠি লজ্জায় অবগুণ্ঠিত হয়ে গুটিসুটি মেরে পড়েছিল এখানে-সেখানে। যেদিকেই চোখ যায়, কেবলই রবীন্দ্র-রশ্মি। কবিতায় রবীন্দ্রনাথ; সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথ; নাটকে রবীন্দ্রনাথ; উপন্যাস কি ছোটগল্প, সেখানেও রবীন্দ্রনাথ; প্রবন্ধ কি শিশুসাহিত্যÑরবীন্দ্রনাথ সেখানেও। এক কথায়, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য তখন এমন একটা স্তরে এসে পৌঁছেছিল যে, কারো পক্ষে কল্পনাও করা কঠিন ছিলো রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করে একদিন কেউ বীরের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে বাংলা ভাষায়।
এরকমই একটা পরিবেশে ধূমকেতুর মতো এসে বাংলার সাহিত্যজগতে উপস্থিত হন নজরুল। এক ‘বিদ্রোহী’ কবিতা দিয়েই তিনি সূর্যগ্রহণ লাগিয়ে দিলেন বাংলার আকাশে। মধ্যাহ্নের রবিকে পর্যন্ত ঢেকে দিলেন তাঁর নিজস্ব ছায়ায়। বাঙালীর কান শিহরিত হলো, দুচোখ ধাঁধিয়ে গেল এবং হৃদয় ফেটে পড়ল তীব্র আবেগে। বীরের গল্প তারা শুনেছে এতকাল, দুচোখে দেখেনি কখনও। নজরুল যখন হুঙ্কার ছাড়লেন :
বল বীরÑ
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি, নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির!
বল বীরÑ
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্ত্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলোক ভেদিয়া,
খোদার আসন আরশ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর।
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটিকা দীপ্ত জয়শ্রীর।
বল বীরÑ
আমি চির-উন্নত শির!
তখন বিস্ময়ে ও আনন্দে সবাই থ বনে গেল একেবারে। কবি নয়, এ যেন সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে রাক্ষস-খোক্ষসের দেশ অতিক্রম করে রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে আকস্মিক আবির্ভূত হওয়া এক বিস্ময়-যুবক। কি তাঁর ছন্দ, কি অন্ত্যমিল, কি নিপুণ শব্দের ঝঙ্কার, আরবি-ফারসি-বাংলা-সংস্কৃতের মিশ্রণে কি অপূর্ব এক ভিন্ন কাব্যভাষা! রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় কবি বটে, কিন্তু তাঁর কোনো কাব্যভাষা নেই। নজরুল তাঁর প্রথম ভুবন মাতানো কবিতায় জানান দিয়ে গেলেন যে, সম্পূর্ণ আলাদা, নতুন এক কাব্যভাষা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন তিনি। অবশ্য নজরুলের মতো নিজস্ব কাব্যভাষা মধুসূদনেরও ছিল।
মধুসূদন ইংরেজি-সাহিত্য রচনা করা থেকে হাত গুটিয়ে নেন ১৮৫৬-৫৭ সালের দিকে। তাঁর রচিত সর্বশেষ যে ইংরেজি কবিতাটি পাওয়া যায় সেটি ছিল শিরোনামহীন, মাদ্রাজের জনৈক মিথুনিয়াকে নিয়ে রচিত, লেখা হয় ২০ জুলাই ১৮৫৭ তারিখে। এরপর শুরু হয় তাঁর বাংলা সাহিত্যের যুগ। শর্মিষ্ঠা নাটক (১৮৫৯) দিয়েই তাঁর উত্থান এবং চতুর্দশপদী কবিতাবলি (১৮৬৬) দিয়েই তাঁর স্বর্ণযুগের অবসান। এরপরও তাঁর কিছু সাহিত্যকর্ম থাকলেও সেগুলো উল্লেখযোগ্য নয়। মোটামুটি বলা যায়, ১৮৫৯ থেকে ১৮৬৬Ñএ সাত-আট বছরের সাহিত্যসাধনাই মধুসূদনকে অমরত্ব দান করেছে বাংলা ভাষায়। নজরুলের সাহিত্যযুগও মধুসূদনের মতো। যদিও বলা হয় বিশ বছরের মতো সাহিত্যসাধনা করে গেছেন নজরুল, বিষয়টা কিন্তু সেরকম নয় একটুও। নজরুলের তেজোদীপ্ত সাহিত্যের সময়কাল ১৯২২ থেকে ১৯৩০-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এরপরও কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও সংখ্যার দিক দিয়ে তত উল্লেখযোগ্য নয়। নজরুলের রচনাবলির প্রকাশকালের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। (অসমাপ্ত...)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন