Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বৃক্ষ জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে ‘গাছের পাঠশালা’

সাতক্ষীরা থেকে আবদুল ওয়াজেদ কচি | প্রকাশের সময় : ২৫ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

গাছের পাঠশালা। শুনতে অবাক লাগলেও বৃক্ষ কেন্দ্রিক ঠিক এমনই একটি পাঠশালা গড়ে উঠেছে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার তুজলপুরে। যা সর্বস্তরের মানুষের মাঝে বিভিন্ন জাতের বৃক্ষের জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে অকৃপণভাবে।
ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা এই পাঠশালাতে মনিরাজ, জটডুমুর, রক্তচন্দন, লালআতা, ডেগোফল, কাজুবাদাম, কনকচাঁপা, কালাপাহাড়, লালসাগর, মৌসন্দেশ কলা, কালিবগ কলা, বট, বাবলা, শিব জটা, লাল সেজে, করবি, লালজবা, টগর, কাঞ্চন, কামিনী, চাঁপা ফুল, লবঙ্গ, এলাচ, ডালচিনি, চুইঝাল, জাফরং, পেপুল, কাটানটে, আমরুল, তেলাকচু, ডুমুর, আতাড়ি পাতাড়ি, লতামুক্তঝুরি, শম্ভুলতা, কৃষ্ণতুলসি, দুধলতা, শিয়াল কাটা, অনন্ত মূল, পাপড়া, শিমুল, জয়তুন, উলটকম্বল, তরুপ চন্দাল, গদপান, সাদা ধুতরা, জষ্ঠিমধু, ডায়াবেটিস গাছসহ ২০৬ প্রজাতির ওষুধি, ৮৩ প্রজাতির ফলজ, ৪৪ প্রজাতির আম, ১৭ প্রজাতির কলা, ৩৩ প্রজাতির তরকারি ও অচাষকৃত সবজি, ২৩ প্রজাতির মসলা জাতীয় উদ্ভিদ, ২৪ প্রজাতির ফুল, ২৩ প্রজাতির বনজ ও সুন্দরবনের ৯ প্রজাতির বৃক্ষের সমাহার রয়েছে।
আর এই পাঠশালাই এখন বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসন, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক সুতোয় দাড় করাতে সক্ষম হয়েছে।
স্থানীয় তুজলপুর কৃষক ক্লাবের সভাপতি ইয়ার হোসেন তার লীজ নেওয়া ১৮ কাঠা জমিতে গড়ে তুলেছেন গাছের পাঠশালা নামক এই ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষা কেন্দ্রটি। যা সমগ্র জেলায় ইয়ারবের গাছের পাঠশালা নামে পরিচিতি পেয়েছে।
ইয়ারব হোসেনের গাছের পাঠশালায় ছোট ছোট বোর্ডে লেখা রয়েছে প্রত্যেক গাছের নামসহ গুণাগুণ। বিনামূল্যে বিতরণের জন্য পাঠশালার এক পাশে উৎপাদন করা হয় বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ বৃক্ষ। সুন্দরবনের বৃক্ষ পরিচিতির জন্য রয়েছে সুন্দরবন কর্নার। এছাড়া গোটা পাঠশালাকে বিলুপ্ত প্রায় ফলজ, বনজ ও ওষুধি গাছের সংরক্ষণাগার বললেও ভুল হবে না।
স্থানীয়রাসহ প্রতিদিন গাছের পাঠশালায় ঘুরতে আসেন দূর-দূরান্তের মানুষ। যেন এক খন্ড বিনোদন কেন্দ্র। একই সাথে গাছের পাঠশালার পরিচালক ইয়ারব হোসেনের কাছ থেকে নিয়ে যান প্রয়োজনীয় গাছ। যারা শুধুই বেড়াতে আসেন তাদের উপহার হিসেবে দেওয়া হয় ফলজ বৃক্ষের চারা।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাঁচ শতাধিক ওষুধি, ফলজ ও বনজ বৃক্ষের সমাহারে দীপ্তি ছড়াচ্ছে গাছের পাঠশালা। একই সাথে এই পাঠশালায় কেচো কম্পোস্ট ও বিভিন্ন প্রকার জৈব সার তৈরি, ফেরোমোন ফাঁদের বাস্তব ব্যবহারের প্রদর্শনীও রয়েছে। এক দল মানুষ সেখানে রয়েছেন। যাদের বিভিন্ন গাছ ও তার গুণাগুণ সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছেন ইয়ারব হোসেন।
পাশবর্তী কলারোয়া উপজেলা থেকে গাছের পাঠশালায় বেড়াতে আসা আজিজুর রহমান জানান, অনেক দিন ধরে গাছের পাঠশালায় আসার আগ্রহ ছিল। সেই আগ্রহ থেকেই গাছের পাঠশালায় দেখে মন ভরে গেছে তার। এছাড়া একটি কদবেল গাছের চারাও উপহার পেয়েছেন তিনি।
ব্যতিক্রম ধর্মী এই শিক্ষা কেন্দ্রটি গড়ে তোলা প্রসঙ্গে ইয়ারব হোসেন বলেন, মাঝে মাঝে মনে হতো প্রকৃতি থেকে অনেক গাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো সংরক্ষণ করা দরকার। এছাড়া বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরাও অধিকাংশ গাছ চেনে না। জানে না এসবের উপকারিতা সম্পর্কেও। তাই বছর খানেক আগে উদ্যোগটি নিয়েছিলাম। এই চিন্তা-চেতনাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমার পাশে এসে দাড়িয়েছিল গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক)। বারসিক প্রথম থেকেই আমাকে কারিগরি সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে।
নামকরণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমে নামকরণ নিয়ে ভাবিনি। বিলুপ্ত প্রজাতির বৃক্ষ সংগ্রহ করাই ছিল মূল কাজ। পরে চিন্তা করলাম এসব গাছের নাম ও উপকার সম্পর্কে সবার জানা দরকার। তাই নাম দিলাম গাছের পাঠশালা। আর এখন সত্যি সত্যি পাঠশালায় পরিণত হয়েছে এটি। প্রতিদিন এখানে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে বিভিন্ন এলাকা মানুষ আসছে।
শিক্ষার্থীদের বাস্তব ও ব্যবহারিক জ্ঞান প্রদানই গাছের পাঠশালা গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে বিভিন্ন শ্রেণিতে এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি শিক্ষা, উদ্ভিদবিদ্যাসহ এ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে পড়ানো হয়। কিন্তু ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাস্তব ও ব্যবহারিক জ্ঞান চর্চার কোন ক্ষেত্র থাকে না। তাই গাছের পাঠশালা, যেখানে শিক্ষার্থীদের বাস্তব ও ব্যবহারিক জ্ঞান চর্চার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণাধীন ১২ জন বিসিএস কর্মকর্তা ও বিয়াসের একটি প্রশিক্ষণার্থী দল গাছের পাঠশালা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক ও তুজলপুর কৃষক ক্লাবের সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ইয়ারব হোসেন বলেন, তাদের সার্বিক সহযোগিতাই আমাকে উৎসাহ যোগায়। সম্প্রতি গাছের পাঠশালার উদ্যোগে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুই শতাধিক শিক্ষার্থীকে কদবেল গাছের চারা উপহার দেওয়া হয়। একই অনুষ্ঠানে গাছের সাথে বন্ধুত্ব করার শপথ করানো হয় শিশু শিক্ষার্থীদের।
আগামীতে কি পরিকল্পনা রয়েছে? জানতে চাইলে ইয়ারব হোসেন বলেন, আগামীতে গাছের পাঠশালার উদ্যোগে সার্টিফিকেট কোর্স চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে। এজন্য কাজ শুরু হয়েছে।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন বলেন, ইয়ারব হোসেন মূলত একজন প্রকৃতি বন্ধু। তার ক্ষুদ্র উদ্যোগ এখন বৃহৎ স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। যা হতে পারে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তার এই কর্মকান্ডকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। এতে অনেকেই উৎসাহিত হবেন প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায়। এগিয়ে আসবেন সমাজের মানুষের কল্যানে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বৃক্ষ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ