Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বন-বৃক্ষ ধ্বংসের আত্মঘাতী কাজ থেকে নিবৃত্ত থাকতে হবে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৬ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০২ এএম

মধ্য আফ্রিকার সুদান, ইথিউপিয়া প্রভৃতি দেশের বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে সাহেল গঠিত। গেল ক’দশক ধরে আফ্রিকার এ সাহেল অঞ্চলে এক করুণ প্রক্রিয়া ঘটে চলেছে, যা নানাভাবে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ সাহেল শিকার হয়েছে ক্রমবর্ধমান পরিবেশ অবক্ষয়ের এক নির্মম প্রক্রিয়ার। সবুজ আচ্ছাদন যেটুকু এখানে ছিল তার বেশিরভাগই লোপ পেয়েছে। এর প্রারম্ভিক কারণ মানবসৃষ্ট। পশুচারণে অভ্যস্ত সাহেলবাসী এক একটি এলাকায় এমন যথেচ্ছভাবে পশুচারণ করিয়েছে যে, ঘাস-ঝোপ সমূলে লুপ্ত হয়ে ভূমি একেবারে উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। উন্মুক্ত ভূমিতে প্রতিফলিত হয়ে সূর্যকিরণের অধিকতর অংশ বায়ুমন্ডলে চলে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তিত হয়ে এসেছে এক অন্তহীন খরা। নির্মম মরুকরণ গ্রাস করে নিয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পরিবেশকে। সাম্প্রতিকালে অবস্থার খানিকটা উন্নতি হলেও ঐ পরিবর্তন এনে দিয়েছে মানুষের জন্য দুর্দশা ও দুর্ভিক্ষ। সাহেল অঞ্চলের ছবি যখন আমাদের চোখে ভাসে তখন বাংলাদেশকে ভূস্বর্গ মনে করতে ইচ্ছে করে। আমাদের এ ছোট্ট ভূখন্ড এখনো যে এতগুলো মানুষের স্নিগ্ধ আশ্রয় হতে পারছে তার কারণ এর শ্যামলিমা। এদিক থেকে নিঃসন্দেহে আমরা সৌভাগ্যবান। আমরা এ শ্যামলিমাকে যদি আরো উন্নত করতে পারি তাহলে এটি শুধু আমাদের আশ্রয়ই দেবে না, ভবিষ্যতের দিকে একটি উত্তরণের পথও করে দিতে পারে। কিন্তুযা পেয়েছি তা নষ্ট করার দিকেই আমাদের প্রবণতা বেশি। মানুষের জীবনযাত্রা পরিবেশ রক্ষার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলতে পারেনি বলে সাহেল বিপর্যয় ঘটেছে। আমাদেরও বিপদের আশংক্সক্ষা যদি আমরা সঙ্গতি রাখতে ব্যর্থ হই।

জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক দিক থেকে আমাদের বৃক্ষ আচ্ছাদনের উপর হামলাটি আমরা করছি প্রধানত দু’ভাবে। এক. জ্বালানির জন্য কাঠ সংগ্রহ করে। দুই. বাণিজ্যিকভাবে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। এর অধিকাংশ ব্যবহৃত হয় শিল্প, কৃষি, যোগাযোগ ইত্যাদি উৎপাদন তৎপরতায়, রান্নার কাজে নয়। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো যাদের সঙ্গে আমাদের অভিন্ন ইতিহাস রয়েছে, সেখানেও আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বাণিজ্যিক জ্বালানি ব্যয়িত হয়।

গরীব মানুষের জ্বালানির জন্য বৃক্ষসম্পদ ব্যবহার ও বিনষ্টের ব্যাপারটি এত প্রত্যক্ষ এবং ব্যাপক যে আমাদের বনসম্পদকে ধ্বংসের ক্ষেত্রে এর কথাই আসে বেশি। ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনে বিশ্বপ্রেক্ষিতেও সাধারণভাবে পরিবেশ অবক্ষয় ও বিশেষভাবে বনভূমি ধ্বংসের দায়িত্ব জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও দারিদ্র্যের উপর ন্যস্ত করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু বনভূমির বাণিজ্যিক ব্যবহার-অপব্যবহারের তুলনায় অধিকাংশ দেশে এটি তেমন কিছু নয় এবং ধরিত্রী সম্মেলনে সেটি স্পষ্ট দেখিয়েও দেয়া হয়েছে। আমাদের দেশেও গরীব ও জনসাধারণ মানুষ জ্বালানির জন্য মূল গাছে হাত কমই দেয়। ওরা নির্ভর করে প্রধানত ডাল-পালা ও পাতার উপর। এ সংগ্রহ যদি সীমিত পরিমাণে হয় তাহলে মূল গাছের ক্ষতি হয় না, কিন্তু বিপত্তি ঘটে যখন গাছের তুলনায় ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা অনেক কাঠের অনবায়নযোগ্য ব্যবহার করে। প্রথমটি মোটের উপর সংখ্যাগরিষ্ঠ পল্লীবাসী সবার কারণেই কমবেশী ঘটছে। দ্বিতীয়টির ফায়দা পাচ্ছে মুষ্টিমেয় বিত্তশালী মানুষ। এর কোনটিই অবহেলা করার মত নয়। বনভূমি ধ্বংস স¤পর্র্কে আলোচনায় দরিদ্র মানুষের উপায়হীনতার কথা প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। দারিদ্র্যসীমার নিচে অসংখ্য মানুষ শুধু চুলা জ্বালাবার জন্যই নির্বচারে গাছপালা নষ্ট করতে বাধ্য হয়। আসলে আমাদের পশ্চাৎপদতার একটি সরাসরি প্রকাশ হলো যে, এই দেশে মোট জ্বালানি ব্যয়ের শতকরা ৭০ ভাগের বেশি ব্যয় হয় স্রেফ দু’বেলা চুলা জ্বালাবার কাজে। আর এ যে জ্বালানি ব্যয়ের প্রায় সবটুকুই হচ্ছে অবাণিজ্যিকভাবে-।অর্থাৎ অর্থনৈতিক লেনদেন বা তৎপরতার কোন ব্যাপার এর মধ্যে নেই। প্রকৃতিতে যা রয়েছে তার থেকে সংগ্রহ করে আনাটাই শুধু এখানে কাজ। স্পষ্টত ক্রমবর্ধমান একটি জনসংখ্যার জন্য এভাবে শুধু সংগ্রহ করে এনে একটি টেকসই অবস্থা বজায় রাখা সম্ভব নয়। অপরপক্ষে উন্নত দেশে, এমনকি উন্নয়নের পথে যারা সত্যিকার অর্থে এগোচ্ছে, সেসব দেশে জ্বালানিব্যয়ের সবটুকু না হলেও সিংহভাগই বাণিজ্যিক খাতে বেশি হয়। যেখানে সে রকম হচ্ছে সেখানেই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে বৃক্ষ আচ্ছাদন লোপ পাচ্ছে।

বৃক্ষের বাণিজ্যিক ব্যবহার-অপব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আমাদের দেশে খুব কার্যকর নয়। জ্বালানি কাঠ থেকে শুরু করে উচ্চমূল্য আসবাবপত্র তৈরি কাঠ পর্যন্ত বৃক্ষের বাণিজ্যিক মূল্য যথেষ্ট। এ মূল্য আহরণের জন্য যত আগ্রহ আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে রয়েছে সেটি পুনঃ ঐ বৃক্ষ গজাবার কাজে ব্যয় করার আগ্রহ তেমন নেই। কাজেই ব্যবহারটি প্রায়শ অপব্যবহারের পর্যায়েই থেকে যাচ্ছে।

জ্বালানি কাঠ, সে গাছ থেকে সংগ্রহ করেই আনা হোক কিংবা বাণিজ্যিকভাবে ক্রয় করে নেয়াই হোক তার চাহিদা প্রচন্ড এবং ক্রববর্ধমান, অথচ তার সরবরাহ সীমাবদ্ধ। কাজেই এখানে দক্ষ ব্যবহারের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জ্বালানির দক্ষ ব্যবহারের জন্যই এসেছে উন্নত চুলা। গ্রামের বাড়ীতে মাটির সাধারণ চুলার চেয়ে এ উন্নত চুলা তৈরী যে খুব বেশী কষ্টকর তা নয়, অথচ একই রান্নার জন্য এতো জ্বালানি খরচ অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। যখন চিন্তা করা যায় কোটি কোটি পল্লীবাসীর প্রতিটি পরিবার প্রতিদিন চুলা জ্বালাছে তাতে উন্নত চুলা ব্যবহারের মাধ্যমে কতখানি কাঠ বা ডাল-পাতা বাঁচিয়ে ফেলা যেত এখন আর একে সামান্য মনে হয় না। দেশে সবুজ আয়োজনের সীমাবদ্ধতার চাইতে সচেতনতার সীমাবদ্ধতাটাই বেশি কাজ করছে। বেসরকারি কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে ঘনিষ্ঠভাবে গ্রামবাসীদের মধ্যে এটি চালু করার চেষ্টা করে কার্যক্ষেত্রে বেশি এগোতে পারেনি। গ্রামবাসীর অধিকাংশই এখনো জ্বালানি বাঁচাবার কাজটিকে যথেষ্ট জরুরি মনে করছে না।

বৃক্ষ আচ্ছাদনের প্রতি এ যে হুমকি-এটি আরো এক দিক থেকে সাম্প্রতিক কালে বেড়েছে, তা হলো উচ্চ ফলনশীল শস্যের চাষ। উচ্চ ফলনশীল ধান বেশি পাওয়া যায়, এটি ঠিক কিন্তু খাটো জাতের এ ধান গাছে খড়ের পরিমাণ হয় কম। কাজেই জ্বালানি হিসাবে খড় ব্যবহার করে কাঠের যে সাশ্রয় হতো সেটি কমে গেছে। আধুনিক কৃষি আরো নানাভাবে সবুজ আচ্ছাদনের পরিমাণের উপর প্রভাব রাখছে। খাদ্যশস্য ফলাবার তাগিদে গাছ কেটে কৃষি জমি বাড়াবার প্রবণতা বাড়ছে। আগে কৃষির মধ্যে যত রকম বৈচিত্র্য ছিল এখন তা-ও কমে গেছে শুধু উফশী ধানের দিকে অধিক নজর দেয়ার কারণে। সেচের জন্য গভীর নলকূপ অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের মাধ্যমে সাধারণভাবে ওয়াটার লেবেল বা ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামিয়ে দিচ্ছে। দেশের সবুজায়নের জন্য এটি সহায়ক নয়। বৈচিত্র্য আমরা শুধু যে কৃষি ক্ষেত্রে কমিয়ে ফেলেছি তা নয়, বৃক্ষ রোপণের ক্ষেত্রেও আমরা সনাতন বৈচিত্র থেকে সরে আসছি। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এক জাতের গাছ লাগাবার প্রবণতা দেখা দিলে আমরা ক্রমে শুধু তার পিছনে যাচ্ছি, পারিবেশিক প্রতিক্রিয়া বিবেচনা না করে। যেমন, দ্রুত বর্ধনশীলতা, প্রতিকূলতা সহ্যক্ষমতা, দেখার সৌন্দর্য ইত্যাদি গুণের জন্য ইউক্যালিপটাস গাছ লাগাবার প্রচলন হয়েছে প্রচুর। এর জন্য আরো যথাযথ স্থানীয় বৃক্ষ বৈচিত্রকেও অনেক ক্ষেত্রে অবহেলা করা হয়েছে। অথচ দেখা গেছে, ইউক্যালিপটাস মাটির উপরিভাগের পানি প্রচুর পরিমাণে টেনে নিয়ে তার আশপাশে অন্য সবুজায়নে বাধা ঘটিয়েছে। এ রকম আরো উদাহরণ রয়েছে যেখানে বহু পরীক্ষিত সনাতন বৃক্ষকে অবহেলা করা হয়েছে। এর জায়গায় শুধু একই রকম বৃক্ষ রোপণ, সে যতই ভাল বৃক্ষ হোক না কেন, কৌশল হিসাবে মোটেই সুবিধার নয়। দীর্ঘদিনের একত্র বসবাসের ফলে ওখানকার কীটপতঙ্গ, জীবাণু ভাইরাস জাতীয় বৃক্ষ শত্রুরা শেষ পর্যন্ত ঐ বৃক্ষকে ঘায়েল করতে সমর্থ হলে এখন তার বিরুদ্ধে আর কোন প্রতিরোধ থাকে না। পুরো অঞ্চলের সকল বৃক্ষ এক সঙ্গে উজাড় হয়ে তাকে বৃক্ষহীন করে ফেলতে পারে। আমাদের উপকূলীয় বনায়নে একই রকম ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ লাগানো হয়েছে এমন কিছু জায়গায় এ রকম আলামত পাওয়া যাচ্ছে।

দেশের জন্য বনসম্পদ দরকার, এ কথা সর্বজনস্বীকৃত। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করতে হলে মোট ভূমির শতকরা নিদেন পক্ষে পঁিচশ ভাগ ভূমির উপর বনাচ্ছাদনের কথা বলা হলেও এখন সেটি যে কমে কোথায় ঠেকেছে তা সঠিক বলা সম্ভব নয়। এ আচ্ছাদন কমে গেলে বিপদ এক দিক থেকে আসে না। জ্বালানির ডাল-পালা ও পাতা থেকে শুরু করে আমাদের গ্রামীণ মৌলিক জীবনযাত্রায় গাছের উপর নির্ভরশীলতা অত্যন্ত বেশী। উন্নয়নের যেটুকু ক্ষীণ ধারা এখন বজায় রয়েছে সেখানেও এ কাঁচামাল প্রচুর অবদান রাখছে। আরো বড় কথা হলো, বৃক্ষের সঙ্গে আমাদের কাছের বায়ুমন্ডলের স¤পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। সালোক সংশ্লেষণ বাতাসকে অক্সিজেন দেয়, বাতাসের কার্বনডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে পুষ্টির কাজে লাগায়। প্রসে^দন বাতাসে জলীয় বাস্পের পরিমাণ ঠিক রাখে। ব্যাপক বৃক্ষহীনতা খরার পথ প্রশস্ত করে বৃক্ষহীনতার পথ করে দেয়। মরুকরণ প্রক্রিয়াটি তাই একটি দুষ্টচক্রের মতো পেয়ে বসে। বৃক্ষের সঙ্গে মাটির স¤পর্কও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আমাদের বড় আর্শীবাদ আমাদের আছে পলিসমৃদ্ধ শীর্ষ ভূমির মাটি। যেখানে এটি হারাবো সেখানেই আমাদের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে। উপকূলে, নদীর ধারে ভাঙ্গনের প্রক্রিয়া চলছে, পানির তোড়ে ভূমিক্ষয় হচ্ছে। এ ভাঙ্গন, এ ক্ষয় আমাদের বড় দুঃখ। এ দুঃখ অনেকটা লাঘব করে সবুজাচ্ছাদন। মূল দিয়ে মাটি কামড়ে ধরে এটি কাজ করে। সবুজাচ্ছাদন হারালে আমরা প্রকৃতির হাতে একেবারেই ক্রীড়নকে পরিণত হবো।

যে যাই বলুক, প্রতি বর্ষায় কিছু বন্যা মেনে নিয়ে পানিতেই আমাদের বাস করতে হয়। আর সবটুকু উৎপাত নয়, অনেকখানি আশীর্বাদও বটে। ঐ বন্যার পানিই আমাদের শীর্ষভূমির জন্য রেখে যায় ন–তন এক স্তর পলি। সে পানি যখন বৃক্ষাচ্ছাদনের ভেতর দিকে গড়ায় তখন তার গতি হয় স্তিমিত। এতে ভাঙ্গনের তোড় থাকে না, কিন্তু থাকে পলি অধঃক্ষেপণের স্থৈর্য। আবার বন্যাকে নিয়ন্ত্রণও করে থাকে এ বৃক্ষাচ্ছাদন। উজান থেকে ভেসে আসা নদীর পানির সঙ্গে স্থানীয় অতিবৃষ্টির পানি গড়িয়ে মেশাটাকে এটি বিলম্বিত করে পানির গতিতে বাধা দিয়ে। ফলে নদীর খাত তার পানিকে সামাল দিতে পারে কিছুটা বেশি, কূল না ছাপিয়েই তা নিয়ে যেতে পারে সামনের দিকে। শুধু বন্যার দুর্যোগ নয়, ঝড়ের দুর্যোগও অপেক্ষাকৃত প্রশমিত করে ঘন বৃক্ষাচ্ছাদন। উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীর জন্য আমাদের এতে আগ্রহের এটিও একটি কারণ।

আজ যদি বলি আমাদের শ্যামলিমা, আমাদের সবুজ আচ্ছাদন আমাদের জন্য আশীর্বাদ, আমাদের বড় স¤পদ, সেটি হয়তো আমরা সাধারণ অর্থেই নেব। পরিবেশ, ভারসাম্য ও সাধারণ বনস¤পদের দিক থেকে এটি তো সত্য বটেই। কিন্তু ভবিষ্যত একে আরো বড় স¤পদে পরিণত করতে পারে হয়তো বা পরিণত করতে পারে আরো বড় রকমের রক্ষা-কবচ। এর ইঙ্গিত আমরা পেয়েছি ধরিত্রী সম্মেলনে। ক’বছরের আলোচনা ও বিতর্কের পর বিশ্বের ধনী-নির্ধন সব দেশ সর্বোচ্চ পর্যায়ের রিও ডি জেনেরিওতে একত্র হয়ে যে দু’টি প্রধান চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে তার মধ্যে একটি হলো বায়োডিভার্সিটি অর্থাৎ জীববৈচিত্র্য চুক্তি। যদিও যুক্তরাষ্ট্র কয়েকটি প্রশ্নে একমত হতে না পারায় শেষ পর্যন্ত এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি, তবুও অন্য সব শক্তিমান দেশ করেছে, এতেই আমরা অনুমান করে নিতে পারি, বিশ্ব এখন জীববৈচিত্র্যকে কতখানি গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। এ গুরুত্বের কারণ হলো আগামী দিনগুলোতে বায়োটেকনোলজী বা জৈব কারিগরি মানুষের অগ্রযাত্রায় আরো অনেক বড় ভূমিকা পালন করবে। মানুষ ইতোমধ্যে জীবকোষ ও তার জিনে পরিবর্তন এনে ওষুধ, খাদ্য, কৃষি, শিল্প প্রভৃতি নানা দিকে যুগান্তর আনতে শুরু করেছে। এটি ভবিষ্যতে নিঃসন্দেহে আরো অনেক বাড়বে।

জৈব কারিগরি গবেষণা ও চর্চার জন্য একটি বড় উপাদান হলো প্রকৃতির জীববৈচিত্র্য। লক্ষ বছর ধরে প্রাকৃতিক নির্বাচন বিশ্বের বনভূমিতে গড়ে উঠেছে বহুতরো প্রজাতির ও জাতের উদ্ভিদ। এর সঙ্গে পরে যোগ হয়েছে মানুষের স্বার্থে মানবিক নির্বাচন। জৈব কারিগরিকে শুরু করতে হয় সেখান থেকে, প্রকৃতিগত বৈচিত্রকে অনুসরণ করে সে এগোয় আরো বৈচিত্র্যে, সৃষ্টি করে তার প্রয়োজনীয় জৈব গুণগুলোকে। লক্ষ্যণীয় হলো উন্নত বিশ্ব আজ বহু সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও, জীববৈচিত্র্যের প্রাকৃতিক সম্পদ তার সীমাবদ্ধ। এর অধিকাংশই রয়ে গেছে দক্ষিণের অপেক্ষাকৃত কম উন্নত দেশগুলোতে। বড় বড় নিরক্ষীয় বনগুলোর অধিকারী ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, মায়ানমার ইত্যাদির নামই এ প্রসঙ্গে প্রথমে মনে আসলেও আমাদের দেশের উদ্ভিদ বৈচিত্র্য এখনো ঈর্ষনীয়, আমরা যদি তাকে জানতে পারি, রক্ষা করতে পারি এবং ব্যবহার করতে পারি। বায়োডিভার্সিটি চুক্তিতে এ বিধান দিয়েছে যেন আগামী দিনে জৈব কারিগরির উন্নয়নে আমরা আমাদের প্রাকৃতিক স¤পদ নিয়ে অংশ গ্রহণ করতে পারি এবং এ জন্যে তার নায্যমূল্য পাই। উন্নত বিশ্ব আজ আমাদের উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের জন্য চড়া দাম দিতে রাজি, যদি আমরা তা গ্রহণ করতে জানি।

এটি গ্রহণ করার অর্থ হলো হাজার বছরে যে বিচিত্র শ্যামলিমার অধিকারী আমরা হয়েছি, কোন অজুহাতে তা বির্সজন না দেয়া-আমাদের বনাঞ্চলকেও ঐ প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করা, পোষণ করা যেভাবে এটি ছিল চিরকাল। তাছাড়া আমাদের যে গার্হস্থ্য বন সারাদেশে আছে সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে এক হয়ে তাকেও রক্ষা এবং পোষণ করা। সেখানে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যই আসল কথা। যাকে আজ বনবাদাড়-ঝোপঝাড় বলে তাচ্ছিল্য করছি কিংবা অর্থাভাবে যাকে কেটে কৃষি জমি বা বসত জমিতে পরিণত করতে পারছি না বলে আফসোস করছি, সেটাই যে আমাদের আগামী দিনের স¤পদ তা উপলব্ধি করার সময় আজ এসেছে। এর বিরুদ্ধস্রোত অবশ্য প্রচুর এবং প্রবল। কৃষি, বসত, বনায়ন প্রভৃতি বিভিন্ন দিকে আমাদের সাম্প্রতিক প্রবণতাগুলো এর বিরুদ্ধেস্রোতে রয়েছে। আমাদের লক্ষ্য হলো যত বেশী সম্ভব খাদ্যশস্য ফলানো এবং তা প্রায় সর্বাংশ উচ্চ ফলনশীল ধানের উপরেই নিবদ্ধ। হয়তো বা জাতির বৃহত্তর এবং সুদূরপ্রসারী স্বার্থে এটি উচিত ছিল না। হয়তো বা খাদ্যাভাসে বৈচিত্র্য এনে, অন্য খাদ্যকে জনপ্রিয় করে আমরা কৃষি বৈচিত্র্যকেও রক্ষা করতে পারতাম। উফশী ধানের উপর সকল সৃষ্টি নিবন্ধ করতে গিয়ে আমরা ক্রমবর্দ্ধমান হারে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, গভীর নলকূপ ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি, যার প্রত্যেকটি পরিবেশ পরাগায়নে সহায়তাকারী বন্ধু পতঙ্গ ধ্বংস করছে, পরিবেশ বিষময় করে অন্য নানা উদ্ভিদকে ধ্বংস ও বাধাগ্রস্ত করছে, অন্যদিকে কীট ও রোগ-জীবাণুর মধ্যে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে নিত্য নতুন আরো শক্তিশালী কীটনাশকের আগমনের সুযোগ করে দিচ্ছে।

উদ্ভিদ বৈচিত্র্যকে যদি আজকের এবং ভবিষ্যতের বড় স¤পদ হিসাবে আমরা সস্বীকৃতি দিয়ে থাকি তা হলে আমাদের যাবতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে এর রক্ষণাবেক্ষণ মেনে নিয়েই ব্যবস্থা নিতে হবে। সব জমিকে কৃষিজমিতে পরিণত করে বা অন্য কোন কারণে প্রাকৃতিক বনবাদাড় নষ্ট করে এটি করা যাবে না। আমাদের উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো এমন হবে, যেন শস্যকৃষিতে আয় কম হলেও বন ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য নানাবিধ কৃষি জাতীয় কাজ, ব্যাপক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প-বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত উন্নত প্রযুক্তির শ্রমঘন শিল্প প্রসার করে তা আমরা পুষিয়ে তো নেবই বরং এশিয়ার নব্য উন্নত দেশগুলোর মতো আমরাও এগিয়ে যাব আমাদের জনসম্পদের পূর্ণ ব্যবহার করে। এটি করতে গেলে অবশ্য ব্যাপক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে যেমন প্রয়োজন রয়েছে উদ্যোগের। যে জীববৈচিত্র্যকে সংরক্ষণ করে আমরা স¤পদে পরিণত করতে প্রয়াশ চালাচ্ছি, তার সদ্ব্যবহারের জন্যও প্রয়োজন ব্যাপক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। এ জন্য জৈব কারিগরিতে আমাদের নিজস্ব অংশ গ্রহণ যেমন প্রয়োজন তেমনি দেশের নানা অঞ্চলের আনাচে কানাচে মুখ্য-গৌণ সকল উদ্ভিদ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বিস্তৃত করতে হবে। এসব দিক থেকে আমরা যথেষ্ট পিছিয়ে আছি। সেভাবে পিছিয়ে থাকলে স¤পদ থেকেও না থাকার শামিল হবে।

স্পষ্টত আমাদের সবুজ আচ্ছাদন রক্ষা করার, একে উন্নত করার প্রচুর কারণ আমাদের রয়েছে। এটি আমাদের অস্তিত্বের সমস্যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমাদের সকল জাতীয় নীতিতে ও কর্মে এ তাগিদ আসতে হবে। বিশুদ্ধ বনাঞ্চল বলতে যা বোঝায় তার পরিমাণ আমাদের কম। সে অঞ্চলটুকুকে বন হিসাবেই রক্ষা করতে হবে এবং আরো ঘন-সবুজে পরিণত করতে হবে সক্রিয় প্রচেষ্টায়। এর ব্যবহার এবং এর নবায়নের মধ্যে এমন সুন্দর সঙ্গতি থাকবে যাতে এ বন সব সময় ঘন সবুজ থাকে। তবে আমাদের আসল বন হলো গার্হস্থ্য বন, বাড়ীর কাছের বন। এ বনের সৃষ্টিকারী সকল পল্লীবাসী। তাদের জীবনের সুখ দুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ বন। এখানেও আমাদের অনেক কিছু করার রয়েছে। নতুন গাছ লাগানোর কাজ আছে, যত্নের কাজ আছে, আর আছে শ্যামলিমার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে রক্ষা করার কাজ। দেশের এক একটি অঞ্চলে যখন বৃক্ষহীনতার প্রক্রিয়াটি স্পষ্ট হচ্ছে সেটি আমাদেরকে দারুণভাবে আতঙ্কিত করা উচিত। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি কাঠ হিসাবে ও অন্যান্যভাবে যে গাছ ব্যবঋত হচ্ছে তার তুলনায় বনায়ন হচ্ছে কম। এর ফলে ইতোমধ্যেই স্থান বিশেষে বৃক্ষহীনতা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কেউ কেউ একে মরুকরণ প্রক্রিয়ার শুরু হিসাবেও উপমা দিতে চান। আজ যদি আমরা সাবধান অগ্রসর না হই হয়তোবা সত্যি সত্যি সেখানে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে-যাকে ঠেকানো অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। বৃক্ষহীনতা, বৃষ্টিহীনতায় পরিণত হতে সময় বেশী লাগে না। ইতিমধ্যেই অনেকে আঞ্চলিক খরা বৃদ্ধির সঙ্গে এর যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছেন। উত্তরাঞ্চলের পানির অভাব- এ সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। শুস্ক মৌসুমে নদীবাহিত পানির অভাব এখন চরমে গিয়ে পৌঁছেছে-নদীর পানিভিত্তিক প্রকল্পগুলো অচলাবস্থায় গিয়ে পড়ছে। এখানে গভীর নলকূপের ব্যাপক বিস্তৃতি সবুজায়নের দিক থেকে আরো প্রতিকূল অবস্থা সৃষ্টি করছে।

সবুজ আচ্ছাদনের পুরো বিষয়টির দিকে একটি নতুন, সামগ্রিক এবং সুদুরপ্রসারী দৃষ্টিতে তাকানো এখন খুবই প্রয়োজন। দেশের শ্যামলিমা ও জীববৈচিত্র্য রক্ষাকে আমাদের জাতীয় নীতির একটি কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে মেনে নিয়েই শুধু এটি সম্ভব। আর এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক গণসচেতনতা। ব্যক্তিকে, পরিবারকে এবং সংগঠিত গ্রামবাসীদের বিভিন্ন গ্রুপকে বনাঞ্চলের এক একটি ছোট অংশ দেখাশুনা, পরিচর্যা এবং ভোগ করতে দিয়ে কোন কোন সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে যা হয়ে উঠে না মানুষের ঘনিষ্ঠ সচেতনতা ও আগ্রহ সেটিই সম্ভব করে তোলে। এ মানুষই হবে আমাদের শ্যামলিমা রক্ষার বড় হাতিয়ার। মানুষের মধ্যে সে শিক্ষা, সে প্রশিক্ষণ, সবুজের প্রতি সে ভালবাসা যদি বদ্ধমূল করে দেয়া যায় তা হলে আমাদের যে দেশ সবুজ ছিল, সবুজ আছে, তা সবুজই থাকবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার (১ম স্বর্ণপদক) প্রাপ্ত।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন-বৃক্ষ ধ্বংস
আরও পড়ুন