Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জালাল উদ্দীন রূমী [রহ.] সংক্ষিপ্ত জীবনকথা

ধারাবাহিক

| প্রকাশের সময় : ১১ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রূহুল আমীন খান : শামসের অন্তর্ধানের পর মাওলানা রূমীর হাল : এভাবে পীরের অন্তর্ধানে আরও অধিক বেকারার ও বেচাইন হয়ে পড়লেন রূমী। উদ্ভান্তের মত ছুটে বেড়াতে লাগলেন এখান থেকে সেখানে। কখনো কৌনিয়া থেকে দামেশ্কে আবার কখনো দামেশ্ক থেকে কৌনিয়ায়। অবশেষে নিজ শহর কৌনিয়ায়ই তিনি স্থিত হলেন। ‘শামসুদ্দীন ফরিদুন যারকুব’ নামে এক ব্যক্তি ছিলেন মাওলানার বন্ধু। মাওলানা তাকেই শায়খ তাবরীযীর প্রতিভু ঠাওরালেন এবং তাঁকে নিজ সাহচর্যে স্থান দিলেন। শেখ শামসুদ্দীন পেশায় ছিলেন স্বর্ণকার এবং মাওলানার পীর ভাই। মাওলানার একান্ত সান্নিধ্যে এসে তিনি স্বীয় পেশার কাজ ছেড়ে দিলেন এবং রূমীর সাথে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন হলেন। মাওলানা তাঁর হাতে খানকার দায়িত্ব সোপর্দ করলেন। উভয়ের তত্ত¡াবধানে ১০ বছর চলল খানকার ইলমী, আমলী, তালীমী ও তরবিয়াতী কাজ। ৬৬২ হিজরীতে ইন্তেকাল করলেন শায়খ সালাহুদ্দীন। এবার মাওলানা তাঁর অপর এক প্রিয় পাত্র শায়খ হুসামুদ্দীন চালাবীকে তার স্থলাভিষিক্ত করলেন। ইতিপূর্বে হুসামুদ্দীন শেখ বুরহানুদ্দীন (রহ.)-এর মুরীদ ছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তিনি মাওলানা রূমীর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। সালাহ উদ্দীনের ইন্তেকালের পর মাওলানা তাকেই নিযুক্ত করেন খানকার অভিভাবক হিসাবে। হুসামুদ্দনিও নিজ ব্যবসা বাণিজ্য পরিত্যাগ করে মাওলানার সাথে নিমগ্ন হলেন আধ্যাত্মিকতার চর্চায়। মূলতঃ এখান থেকেই তৈরি হল মাওলানা রূমীর সুবিখ্যাত আধ্যাত্মিক দর্শন কাব্য মসনবী শরীফ রচনার পটভূমিকা। চালাবীকে সান্নিধ্যে পেয়ে ক্রমান্বয়ে মাওলানার স্থিরতা ফিরে আসতে লাগল।

মসনবী শরীফ প্রণয়ন
মাওলার মধ্যে পূর্ণ স্বাভাবিক ও শান্ত অবস্থা ফিরে এলে শেখ হুসামুদ্দীন চালাবী তাঁকে এমন এক কাব্যগাঁথা রচনার প্রস্তাব দিলেন যা হবে আধ্যাত্মিক রাহের পথিকদের জন্য অমীয় সঞ্জিবনী সুধা। জবাবে মাওলানা জানালেন তার মনেও অনুরূপ ভাব জাগ্রত হয়েছে এবং তিনি এ কাজের সূচনাও করে রেখেছেন। এই বলে তিনি আঠারটি বয়েত লেখা একটি কাগজ তাঁর পাগড়ির মধ্য থেকে বের করে চালাবীকে দেখালেন। চমৎকৃত হলেন চালাবী। উভয়ের পরিকল্পনা মোতাবেক এগিয়ে চলল মসনবী রচনার কাজ। মাওলানা ভাবে তন্ময় হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মুখে মুখে অনর্গল আবৃত্তি করে যেতে থাকলেন একেকটি বয়েত আর হুসামুদ্দীন চালাবী তা’ লিপিবদ্ধ করে নিতে লাগলেন সঙ্গে সঙ্গে। এভাবে দু’বছর ধরে চলল বয়েত বলা ও লিখার কাজ। মসনবীর প্রথম পর্ব রচনা প্রায় সমাপ্ত এ সময়ে হঠাৎ হুসামুদ্দীনের স্ত্রী ইনতেকাল করলে চালবীকে সাংসারিক ঝামেলায় ব্যস্ত থাকতে হল। মাওলানার বয়েত বলাও স্তব্ধ হয়ে গেল। দু’বছর পর সব ঝামেলা চুকিয়ে ফিরে এরেন হুসামুদ্দীন। আবার পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে চলল মসনবী রচনা। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে অর্থাৎ মাওলানার ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল মসনবী রচনার কাজ। ৬ খন্ডে বিভক্ত মসনবী শরীফের বয়েত সংখ্যা ২৫,৭০০ (পঁচিশ হাজার সাত শত) কেউ কেউ লিখেছেন এর বয়েত সংখ্যা ৩৬৬০।
ইন্তেকাল : দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার কালজয়ী কাব্য মসনবী শরীফ প্রণেতা আধ্যাত্মিক কবি সম্রাট হযরত মাওলানা মুহম্মদ জালাল উদ্দীন রূমী ৬৭২ হিজরীতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ঐ সনের ৫ই রবিউসসানী রোববার (৬০৪-৬৭২) ৬৮ বছর বয়সে ইহজগৎ হতে চির বিদায় নিয়ে পর জগতে পাড়ি জমান। ইন্নালিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রাজিউন। এই বিশ্ববরেণ্য মহামনীষীর ইন্তেকালে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। সর্বস্তরের অগণিত মানুষ তাঁর জানাযায় অংশগ্রহণ করেন। অবশেষে কৌনিয়ার গোরেস্তানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ৪০ দিন পর্যন্ত চারদিক থেকে ভক্তেরা এসে মাযার যিয়ারত করে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে থাকেন। আজও দেশ ও বিদেশের অসংখ্য মানুষ কৌনিয়াতে এসে তাঁর মাজার শরীফ যিয়ারত করেন।
রচনাবলী : সুবিখ্যাত মসনবী শরীফ ছাড়াও মাওলানা রূমী বেশ কিছু অমুল্য গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। এদের মধ্যে দিওয়ানে শামসে তাবরীযী বা কুল্লিয়াতে শামসে তাবরীযী, রুবাইয়াতÑ (১৬০০ রুবাই), ফীহে মা ফীহে (আরবী ভাষায় রচিত), মজলিসে সাবআ (মাওলানা প্রদত্ত ৭টি ভাষণের সংকলন তাঁর ইন্তেকালের পরে এটি সংকলিত হয়েছে।)
মসনবী শরীফের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : মসনবীÑ দ্বিপদী কবিতা। অন্তমিল বিশিষ্ট দু’দু লাইনের কবিতাকে মসনবী বলা হয়। ফার্সী ভাষার অনেক প্রখ্যাত কবিই মসনবী (দ্বিপদি কবিতা) রচনা করেছেন। তবে মসনবী শরীফ বলতে মাওলানা জালাল উদ্দীন রূমী রচিত, সর্বকালে সমাদৃত মসনবীকেই বুঝায়। এর পূর্ণ নাম মসনবীয়ে মানবী। অর্থাৎ, আধ্যাত্মিক দ্বিপদী কাব্য। রচনাকাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৮ শত বছর ধরে এর সমান আবেদন রয়েছে সর্বদেশে। অব্যাহত রয়েছে এর চর্চা ও গবেষণা। ৬ খন্ডে গ্রন্থিত প্রায় ২৬ হাজার বয়েত সম্বলিত এ মহাগ্রন্থ শরাবন তহুরার এক অফুরান সওগাত। কামিল মুর্শিদ শামসুত্তারীযের সান্নিধ্যে এসে মাওলানার অন্তরে ঘটে যায় এক মহাবিপ্লব, উছলে ওঠে হাকীকত ও মারিফতের ফল্গুধারা। যে মাওলানা রূমী এত দিন কাব্য রচনার ধার ধারেন নি, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তাঁর কণ্ঠ থেকে নিসৃত হতে থাকে কবিতার অনর্গল সুধা-প্রবাহ। যা গ্রন্থিত হয়েছে বিভিন্ন শিরোনামে। শায়খ তাবরীযের অন্তর্ধানের শোক সামলে উঠতে কেটে যায় তাঁর কয়েক বছর। এরপর সমচিন্তা ও সম আদর্শের একান্ত সহযাত্রী শায়খ হুসামুদ্দীনকে নিবিড় সান্নিধ্যে পেয়ে বান ডাকে তাঁর কাব্য সিন্ধুতে। শুরু হয় মসনবীয়ে মানবী রচনার বিরামহীন অভিযাত্রা। তাই মসনবীয়ে মানবীর সাথে হোসামুদ্দীনের নামও জড়িত ও অবিস্মরণীয়।
মসনবী শরীফের পরিচিতি মাওলানার দর্শন মসনবী শরীফেই বিধৃত। ভক্তজনেরা একে অখ্যায়িত করেছেন নানা অভিধায়। কেউ বলেছেন, শরীয়ত ও তরীকতের বিশ্বকোষ; কেউ বলেছেন, তৌহীদের বার্তা; কেউবা বলেন অন্তর কালিমা বিদূরিত করার রেত বা সায়কল। কেউবা আবেগে উদ্বেলিত হয়ে বলেছেন এ হচ্ছে ফার্সি ভাষার কুরআনÑ অর্থাৎ কুরআন পাকের সার নির্যাস এই অমূল্য গ্রন্থে বিধৃত। প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক কবি আবদুর রহমান জামী (রহ.) বলেন : রূমী নবী নন তবে তাঁর একটি কিতাব রয়েছে।
সা¤প্রতিককালেও রূমীর চর্চা ও গবেষণা প্রাচ্য ও পাশ্চত্যে চলছে অবিরাম। উপমহাদেশের দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল তাঁর দর্শন কাব্য রুমুযে বেখুদীতে লিখেছেন : আমি রূমীর সমুদ্রের একটি তরঙ্গ মাত্র। রূমী গবেষক হিসেবে ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডক্টর এ আর নিকলসনের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। ১৯২৫ সালে তিনি মসনবী শরীফের ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ করেন এবং ১৯৩৬ ইং সালে এর ব্যাখ্যাও প্রকাশ করেন। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ২০০৭ কে ঘোষণা করেছিল ‘রূমীবর্ষ’ হিসাবে। সে মোতাবেক সমগ্র বিশ্বে রূমীর ৮০০তম জন্ম বার্ষিকী উদ্যাপিত হয় বিপুল উদ্দীপনার সংগে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকাকেও আলোড়িত করেছে রূমীর মসনবী। সে দেশের বিখ্যাত গায়িকা ম্যাডোনা মসনবীকে কবিতা ও গানে রূপ দিয়ে ‘এ গিফট অব লাভ’ শিরোনামে এ্যালবাম বের করেছেন । ১৯৯৫ সালে হারপাল কলিন্স প্রকাশ করেছেন ‘দি এসেনসিয়াল রূমী’। তাঁর প্রকাশিত ‘দিসোল অব রূমী’ নামের ৪০০ পৃষ্ঠার গ্রন্থও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সমগ্র পাশ্চাত্য জগতে।
ইংরেজী, ফরাসী, জার্মানী, ল্যাটিন, তুর্কি, উর্দূসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে বিশ্বকবি রূমীর বিশ্বখ্যাত মরমী কাব্যগ্রন্থ ‘মসনবীয়ে মানবী’। এর ব্যাখ্যাগ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়। উর্দূ ভাষায়, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) কৃত অনুবাদ ও ব্যাখ্যা ‘কালীদে মসনবী’ সর্বমহলে সমাদৃত। বাংলা ভাষায়ও এই মহাগ্রন্থের একাধিক আংশিক গদ্যানুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এ সব অনুবাদক ও ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে রয়েছেন শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.), মাওলানা আবদুল মজিদ। রয়েছেন ফার্সী ভাষা ও সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক মাওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী প্রমুখ বিজ্ঞ প্রাজ্ঞ সুধীবর্গ।
মসনবী ও রূমীর দর্শন
প্রেম ও বিরহই রূমীর মসনবীর মূল সুর। প্রেমের আবেগ-উন্মাদনা এবং বিরহ বিচ্ছেদের সুতীব্র যন্ত্রণা এর বয়েতে বয়েতে দ্যেদিপ্যমান। বিরহ কাতর প্রেমিক প্রেমাস্পদের হৃদয় মিলন অমৃত সুরা পানের জন্য সর্বদা ব্যাকুল-বেকারার। তবে মাওলানার পরম প্রেমাস্পদ নন নশ্বর জগতের কোন সত্তা। রূমীর ভাষায়Ñ
নশ্বর ভঙ্গুর সত্তাÑ নহে যা অনিত্য চিরন্তন
অব্যয় প্রেমের ডোরে বাধা তাকে যায় না কখন।
যেই সত্তা অবিনাসি চিরঞ্জীব অব্যয় অক্ষয়
তারি প্রেমে হও লীন, অকাতরে বিলাও হৃদয়।
অন্তহীন তাঁর প্রেম, বিকশিত কুসুমের মত
অন্তর বাহির তার সুরভীতে হয় পুলকিত।
সে প্রেম অমৃত সুধা, সেই সুধা যে করেছে পান
সে লভেছে অমরতা, নন্দন পুলক অফুরান।
মানবীয় এই সত্তার মূল রূহ্; রূহের সাথে সেই মহাসত্তার সম্পর্ক আকস্মিক কোন ব্যাপার নয়, অনাদি। রূহ তো জড় জগতের নয়। তেমনি নয়, মালাকুতী বা ফেরেশ্তা জগতের, এমনকি তারও ঊর্ধ্বের জবারুতী জগতেরও নয় সে। বরং স্থান ও কালের ঊর্ধ্বে, সীমা ও সরহদ্দের ঊর্ধ্বে অনন্ত ও অসীম ‘লাহুত’ জগতের সে বাসিন্দা। সেখানে পরম-প্রেমাস্পদের মীলন-তৌতাতে মশগুল মাতোয়ারা ছিল সে। সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মহাযাতনায় সে ক্লিষ্ঠ। এই প্রাণবংশীর মূলতো সেই বাঁশের ঝাড়। তাই এ বংশীর যে সুরধ্বনিÑ সেতো বিচ্ছেদ-বিরহের কান্না। যতক্ষণে না এই নশ্বর দেহের অবসান ঘটবে, এই পিঞ্জরের বন্দিদশা থেকে প্রাণপাখি মুক্ত না হবে ততক্ষণে তো পরম প্রেমাস্পদের সাথে তার মিলনও হবে না সম্ভব। একমাত্র মৃত্যুই দিতে পারে সেই মুক্তি। তাই রূমীর কাছে মৃত্যুর রূপ ভিন্নÑ



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জালাল

১৩ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন