Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নির্বাচনী হাওয়া, নির্বাচনী চিন্তা-৪

| প্রকাশের সময় : ১০ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক
নির্বাচন ও নিরাপত্তা ইত্যাদি প্রসঙ্গে লেখালেখির অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে, সচেতন নাগরিক মহলের সঙ্গে তথা সম্মানিত পাঠক স¤প্রদায়ের সঙ্গে মত বিনিময় করা। মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে, আজকের কলামের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আলোচনা এই মত বিনিময় নিয়েই করছি। এই কলামটি যেটি আপনি এখন পড়ছেন, সেটি আপনি মুদ্রিত পত্রিকায় পড়ছেন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে নিজের বাসায় অথবা চা-নাস্তা খাওয়ার পরে আরামে বসে অথবা অফিসের টেবিলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে অথবা দুপুরে মধ্যাহ্নের অবসর সময়ে অথবা বিকালে অফিস থেকে আসার সময় কার-বাস ইত্যাদি যানবাহনের ভেতরে বসে অথবা রাত নয়টা-দশটার সময় দিনের সব কাজ শেষ করে, নামাজ-কালাম শেষ করে ঘুমাতে যাওয়ার আগে। মফস্বল এলাকায় কিছু দোকান ও কিছু বাসায় বা অফিসে পত্রিকা রাখা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রামের সাধারণ মানুষ নিকটবর্তী চায়ের দোকানে গিয়ে পত্রিকা পড়েন বা পত্রিকার বিষয়বস্তু অবহিত হন। চা খান, গল্প করেন, সংবাদ বিশ্লেষণ করেন, কলাম বিশ্লেষণ করেন। এটি গেল মুদ্রিত পেপারের কথা। কিন্তু যারা অনলাইনে পড়ালেখা করতে অভ্যস্ত, তাঁরা মধ্যরাত্রি বারোটার পরপরই বা যে কোনো সময়, কলামটি পড়তে পারেন। কারণ, প্রত্যেকটি বড় বড় পত্রিকারই অনলাইন সংস্করণ রয়েছে। অনলাইনে মন্তব্য করাও সহজ। তাছাড়া হাজার হাজার তরুণ বা মধ্যবয়সী ব্যক্তি আছেন যাঁরা ফেসবুক চালান। তাঁরা মোবাইলের মাধ্যমে ফেসবুক চালান; মোবাইলের মাধ্যমেই অনলাইন পত্রিকায় প্রবেশ করে কলাম পড়েন, সংবাদ পড়েন, মন্তব্য করেন।
কলাম পড়ার পর কে কী করেন, এটি একটি অতি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। কলাম পড়ার পর যদি কারো পছন্দ হয়ে যায়, তিনি অনলাইন থেকেই কলামটির লিংক নিয়ে নিজের ফেসবুকে দিয়ে দেন। অনেকেই পুরো কলামটি ডাউনলোড করে দিয়ে দেন, যাতে করে ফেসবুক বন্ধুগণ পড়তে পারে। অর্থাৎ ডিজিটাল যুগ হওয়ার কারণে মত বিনিময়টি মোটামুটি দ্বিপক্ষীয় হয়ে গিয়েছে। আমি নিজেও কলামের বক্তব্যগুলো কোনো সময় হুবহু শতভাগ, কোনো সময় আংশিকভাবে খÐ খÐ করে আমার ফেসবুকে দেই, যাতে করে ফেসবুক বন্ধুগণও বক্তব্যটি সম্পর্কে অবহিত থাকেন। আমি ফেসবুকে দেওয়ার পর, অনেক ফেসবুক বন্ধু এটা শেয়ার করেন। অর্থাৎ ঐ ফেসবুক বন্ধু নিজে পত্রিকা থেকে কলামটি ডাউনলোড করেননি বা করার সুযোগ থাকে না, তিনি মনে করেন আমার ফেসবুক থেকে শেয়ার করাটাই সহজ কাজ। তবে এটিও সত্য যে, পেপারে কলামটি ছাপালেই সকল পাঠকই পড়বেন, এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। ফেসবুকে বক্তব্য দিলেই সকল ফেসবুক বন্ধু পড়বেন, তারও কোনো গ্যারান্টি নেই।
একটি খুবই সাদামাটা শতকরা হিসেব মোতাবেক, শিক্ষিত পত্রিকা পাঠকগণের মধ্যে শতকরা ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ পাঠক, এক বা একাধিক কলাম পড়েন; সংবাদের অতিরিক্ত। কিছু পাঠক আছেন যারা শুধু কলাম পড়ার জন্যই পত্রিকা কেনেন। আবার অনেক ক্ষেত্রেই একটি পত্রিকা হাতে হাতে ঘুরতে ঘুরতে পাঁচ-সাতজন পাঠকের হাতে যায়। বিশেষত মফস্বল এলাকায়। এটি গেল মুদ্রিত পত্রিকায় কলাম পড়ার কথা। অনলাইনে কলাম পড়ার শতকরা ভাগ অনেক বেশি; ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ অনলাইন পাঠক কোনো না কোনো কলাম পড়েন। এবার ফেসবুকের কথায় আসি। কলামটিকে, একটি পোস্ট বানিয়ে ফেসবুকে দিলেও যে, সকল ফেসবুক বন্ধুই পড়বেন, এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। দেখা যায় যে, বহু সংখ্যক ব্যক্তি খালি লাইক দেন।
ফেসবুকের পোস্টে লাইক দেওয়া একটি রহস্যময় ব্যাপার। অনলাইনে কলাম পড়ার পর, যদি অনলাইন পত্রিকা বন্দোবস্ত রাখে, তাহলে সেখানে মন্তব্য দেওয়া যায়; যদি না রাখে তাহলে দেওয়া যায় না। তবে যদি একই বক্তব্য ফেসবুকে আসে, সেখানে মন্তব্য দেওয়ার জায়গা থাকে। অনেকে মন্তব্য না দিয়ে রিঅ্যাকশন দেন বা লাইক দেন। ফেসবুকের লাইক শব্দের মানে মনে করলাম: পছন্দ। একটি রহস্যময় প্রশ্ন হলো, কোনো একজন পাঠক, কী লাইক করে, লাইক বাটনে প্রেস করলেন সেটি বোঝা খুব মুশকিল। ফেসবুক যারা আবিষ্কার করেছেন, ফেসবুকের পৃষ্ঠার লে-আউট বা পৃষ্ঠার ছক যারা বানিয়েছেন, তারা নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে আরও উন্নতি করবেন।
নিঃসন্দেহে আমি সম্মানিত পাঠক স¤প্রদায়ের সঙ্গে মত বিনিময়ে আগ্রহী। পত্রিকার কলামের মাধ্যমে সম্মানিত পাঠক স¤প্রদায়ের সাথে আংশিক মত বিনিময় হয়। এক্ষণে আমার পক্ষ থেকে উপস্থাপিত সারমর্ম হলো এই যে, সকল প্রকার সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও, পত্রিকায় কলাম লেখা, টেলিভিশন টকশোতে অংশগ্রহণ করা, ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া ইত্যাদি কাজ, মতামত আদান-প্রদানের অন্যতম স্বীকৃত উপকারী মাধ্যম। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই খুশি হই এবং স্বাগত জানাই আমার লেখার উপর সকল মন্তব্যকে এবং প্রশ্নকে। এই কলামের নিচেই আমার ইমেইল দেওয়া আছে। আর ইংরেজি ভাষায় বা ইংরেজি অক্ষরে আমার নাম (সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম) লিখলে আমার ফেসবুক আইডি যাওয়া যায়। বহুল প্রচারিত ইনকিলাব পত্রিকার পাঠকগণের সঙ্গে আমাদের মত বিনিময় আরও যেন জোরালো হয়, আমি সেই বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করলাম।
এখন মূল বিষয়ে আলোচনা শুরু করছি। উপরের কয়েকটি অনুচ্ছেদে কলাম ছাপানো, কলাম পাঠ করা ইত্যাদি প্রসঙ্গে কিছু কথা বললাম। কিছু সীমাবদ্ধতার কথা বললাম। অতীতেও, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইনকিলাবে কলাম লিখেছি, তবে ধারাবাহিক লেখা এটিই প্রথম। আজকের কলামের বক্তব্য পূর্ণভাবে উদ্ধারের স্বার্থে বলতে চাচ্ছি যে, গত তিনটি কলামও একই সুতায় গাঁথা। সুতাটি হলো: নির্বাচনকালে নিরাপত্তা, সেনাবাহিনীর ভূমিকা ইত্যাদি। যেহেতু দশ বা বারো বা চৌদ্দ বা ষোলো, বা আঠারো মাস পরেই পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা, সেহেতু নির্বাচন নিয়ে আলাপ-আলোচনা পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছে। এখন থেকে তিন বছর সাত মাস আগে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে যেই নির্বাচন হয়েছিল, সেইটার তারিখ থেকেও বছর দেড় বছর পেছনে গেলে দেখা যাবে যে, নির্বাচন নিয়ে আলোচনা, কর্মকাÐ, প্রতিবাদ, আন্দোলন ইত্যাদি শুরু হয়ে গিয়েছিল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে, তথা এক বছর দেড় বছর আগে কিন্তু ঐরূপ আলোচনা শুরু করা সম্ভব ছিল না। কারণ, তখন মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীনের তত্ত¡াবধায়ক সরকার ছিল। তার আগে ২০০১ সালের অক্টোবরে যেই নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেইটার বেলায়ও, প্রায় দেড় বছর আগে থেকেই আন্দোলন, কথাবার্তা, লেখালেখি প্রতিবাদ আলোচনা ইত্যাদি চালু হয়ে গিয়েছিল। আবার ব্যতিক্রম ছিল ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে। যাহোক, আমি যেই পয়েন্টটি হাইলাইট বা উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরতে চাচ্ছি সেটা হলো এই যে, পার্লামেন্ট নির্বাচন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এটির ভালোমন্দ দিক নিয়ে, সময় হাতে নিয়ে আলাপ আলোচনা শুরু করা ভালো। আজকে থেকে মাত্র কিছুদিন আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মহোদয়ও, তাঁদের ভাষায়, নির্বাচনের রোড ম্যাপ প্রকাশ করেছেন। রোড ম্যাপ প্রসঙ্গে আমরা আলোচনা আগামীতে কোনো একসময় অবশ্যই করবো ইনশাআল্লাহ। আজকের আলোচনা নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা প্রসঙ্গেই মাত্র। এবং এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব বা কর্ম।
জাতির খেদমতে সেনাবাহিনীর অবদান প্রসঙ্গে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি। বিগত কোনো একটি কলামে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দর্শন বা তত্ত¡ আলোচনা করেছি। সেটি হলো স্বাভাবিক অবস্থায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ সরকারের হুকুমে, বাংলাদেশের বেসামরিক প্রশাসনকে বিভিন্ন নিয়মে সহায়তা করে; বা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক দায়িত্ব পালন করে। এখন থেকে নয়-দশ বছর আগে, মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীনের তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আমলে একটি ভালো কাজ হয়েছিল। কাজটি করেছিলেন তৎকালীন নির্বাচন কমিশন। কাজটি ছিল ভোটার আইডি কার্ড প্রণয়ন করে জনগণের হাতে পৌঁছিয়ে দেওয়া। দেড় বছরের কম সময়ের মধ্যে সমগ্র ভোটার স¤প্রদায়ের হাতে একটি করে কার্ড পৌঁছানোর বিরাট দায়িত্বটি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল সেনাবাহিনীর সদস্যগণের সম্পৃক্ততার কারণে। ভুলত্রুটি ছিল; কিন্তু কাজটি ছিল দারুণ। যখনই ঘূর্ণিঝড় বা বন্যা হয়, জনগণের খেদমতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। দুর্গম এলাকায় রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পুরো সেনাবাহিনীকে না জড়ালেও, সেনাবাহিনীর বিশেষ বিশেষ অংশকে জড়ানো হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহ দমন, শান্তি আনয়ন, শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন, জনগণকে অব্যাহত নিরাপত্তা প্রদান, সকল উন্নয়ন কর্মকাÐের নিরাপত্তা প্রদান ইত্যাদি কাজ সেনাবাহিনী করেই যাচ্ছে। পাঁচ-সাত বছর আগে সাভারের রানা প্লাজায় যে মারাত্মক দুর্ঘটনা হয়েছিল, সেই সময় সেনাবাহিনীর স্থানীয় অংশ উদ্ধার তৎপরতায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। জড়িত থাকবে না কেন? বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া। জন্মলগ্নেই স্বাধীনতার জ্বলন্ত শিখা তাদের চেতনায়-কল্পনায়-মানসপটে ভাস্বর হয়েছিল এবং আজ অবধি ভাস্বর আছে। জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পথ চলার প্রথম দীক্ষা, প্রথম অনুশীলন ছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সেটি ছিল গণযুদ্ধ, সেটি ছিল জনযুদ্ধ, সেটি ছিল রণাঙ্গণের যুদ্ধ। জনগণকে সাথে নিয়ে জনগণের জন্যই খেদমত তথা দেশসেবার অভিজ্ঞতা ১৯৭১ সাল থেকেই উজ্জ্বল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক-সদস্যগণ গ্রাম বাংলার ছেলেমেয়ে। বাংলাদেশের শিক্ষিত ১৮-২০ বছরের তরুণগণের মধ্য থেকেই, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসারগণের উৎপত্তি। অতএব, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং জনগণের খেদমতের জন্য উদগ্রীব থাকবে এটিই স্বাভাবিক।
এখন আমি সেনাবাহিনী কর্তৃক জাতির প্রতি খেদমতের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণটি তুলে ধরতে চাই। সেনাবাহিনী কর্তৃক জনগণের খেদমতে নিবেদিত কর্ম অনেক প্রকারের। দু’একটি উদাহরণ উপরের অনুচ্ছেদে দিয়েছি। সবচেয়ে বড় উদাহরণটি হচ্ছে, শান্তিকালীন সময়ে জাতীয় নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণের খেদমতে সর্বদাই নিয়োজিত ও নিবেদিত হয়েছে। আমি ব্যক্তি জীবনে ১৯৭০ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত সকল পার্লামেন্ট নির্বাচনে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম বা ভূমিকা রেখেছি বা অংশীদার ছিলাম। একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। ১৯৮৬ সালে আমি মিরপুর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত, ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজে একজন ডাইরেক্টিং স্টাফ বা প্রথম শ্রেণির প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলাম। ভোটের দিন ভোট দিতে গিয়েছিলাম নিকটস্থ স্কুলে। ভোট দিতে পারিনি; কারণ, আমার এবং আমার স্ত্রীর ভোট অন্য কেউ ইতোমধ্যেই দিয়ে দিয়েছিল! ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে অবস্থা দেখেছি। সেনাবাহিনী প্রসঙ্গে আলোচনায় ফিরে যাই। কোনো কোনো সময় ব্যতিক্রমী ভূমিকাও রাখতে হয়েছে একমাত্র জাতীয় স্বার্থে, একমাত্র জনগণের কল্যাণে। মাছি মারা কেরানীর মতো গৎবাঁধা নিয়মে হাঁটলে বড় কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়। এই প্রসঙ্গে ১৯৯০-৯১ সালের একটুখানি স্মৃতিচারণ আগেও করেছি, তাও প্রয়োজন বিধায় আবার করবো আগামী কোনো একটি কলামে ইনশাআল্লাহ।
সেনা মোতায়েন: অতীত ও বর্তমানের সম্পর্ক নিয়ে এখন আলোচনা করবো। এটুকু লিখেই আজকের কলামটি শেষ করবো। তথ্য প্রযুক্তির যুগে, ডিজিটাল যুগে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, অতীতের সবকিছুই হুবহু প্রয়োগ করা যাবে না, এটি যেমন সত্য, সাথে সাথে এটিও সত্য যে, যে কোনো চিকিৎসা বা যে কোনো ব্যবহারের বা যে কোনো আচরণের বা যে কোনো মূল্যায়নের মৌলিক নীতি বা মূলনীতি অতীতে যা থাকে, বর্তমানেও সেটির অনেকটাই বহাল থাকবে বা প্রাসঙ্গিক থাকবে। অর্থাৎ মৌলিক নীতি বা মূলনীতি হঠাৎ করেই পরিবর্তন হয় না। এই প্রেক্ষাপটেই আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমার পক্ষ থেকে নির্মোহ মূল্যায়নে, আমার অভিজ্ঞতার আলোকে, অন্যতম শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসনীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন ছিল বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ এর অস্থায়ী সরকারের আমলে, ১৯৯১ সালের ফেব্রæয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দফতরে, জেনারেল স্টাফ ব্রাঞ্চ-এর অধীনস্থ, মিলিটারী অপারেশন্স ডাইরেক্টরেইটের পুরানো ফাইলপত্র ঘেঁটে ১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে অথবা ফেব্রæয়ারি মাসের শুরুর দিকে প্রকাশ করা বা ইস্যু করা নির্বাচন সংক্রান্ত পলিসি লেটার ঘাঁটলে, এটি বোঝা যাবে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কতটুকু আন্তরিকভাবে ওই নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করার জন্য অগ্রগামী ছিল। ঠিক একই সময়ে অর্থাৎ জানুয়ারি ১৯৯১ বা ফেব্রæয়ারি ১৯৯১-এর কোনো এক সময় তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম-সচিব আব্দুল হামিদ চৌধুরীর তত্ত¡াবধানে, বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশ করা বা জারি করা নির্বাচন সংক্রান্ত পরিপত্র আবিষ্কার করে যদি ঘাঁটা যায়, তাহলেও পাঠকগণের নিকট এটা অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রচুর আন্তরিকতার সঙ্গে, পরিকল্পনা করেছিল এবং তাগাদা দিয়েছিল।
আমি মনে করি, সকল কর্মের বা খেদমতের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে, জনগণকে সুযোগ প্রদান। আগামী কম-বেশি সতেরো-মাস পরে অনুষ্ঠিতব্য পার্লামেন্ট নির্বাচন; কোন প্রকারের সরকারের অধীনে হবে সেটিই এখন দারুণভাবে আলোচিত বিষয়। তবে এই কলামের পাঠক বা চিন্তাশীল সকল সচেতন নাগরিকের নিকট আমার আবেদন থেকেই যাবে যে, তাঁরা যেন একটি কথা বিবেচনা করেন। কথাটি হলো এই: কোন রাজনৈতিক দল জিতবে বা কোন রাজনৈতিক দল হারবে সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়; বিবেচ্য বিষয় হলো সকল যোগ্য ভোটার যেন অবাধে, নিজের ভোট নিজে দিতে পারে এবং সেই ভোটের ফলাফল যেন প্রভাবান্বিত না হয়।
যেই লক্ষ্য প্রসঙ্গে উপরের অনুচ্ছেদে বললাম, সেই লক্ষ্য অর্জনে আমাদের করণীয় কী? আমাদের অবজেক্টিভ বা লক্ষ্য নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর, আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে এই অবজেক্টিভ বা লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যে সকল পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি, তার মধ্যে একটি হলো, এমন একটি সরকার বা সরকার পদ্ধতি বহাল করা যে নির্বাচন কমিশনের উপর অযাচিতভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। যে সকল পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি তার মধ্যে আর একটি হলো, সেনাবাহিনী মোতায়েন করা। সেনাবাহিনী মোতায়েনের উদ্দেশ্য: অশান্তি সৃষ্টিকারী ব্যক্তিদেরকে এলাকা থেকে দূরে রাখা, হোন্ডা বাহিনী, গুÐা বাহিনীকে এলাকা থেকে দূরে রাখা, রাজনৈতিক মাস্তানদেরকে এলাকা থেকে দূরে রাখা, আইনশৃংখলা পরিবেশের উন্নতি করা এবং এই সকল কর্মকাÐের সম্মিলিত ফলস্বরূপ মানুষের মনে এই আস্থা দেওয়া যে, মানুষ ভোট কেন্দ্রে যেতে পারবে, ভোট দিতে পারবে এবং ফলাফলে ভেজাল হবে না।
আমাদেরকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, সব সিদ্ধান্তই এখন হবে না। কিছু সিদ্ধান্ত নির্বাচনের আগে নিতে হবে, এখন নয়। আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচন ১৭ বা ১৮ মাস পরে হবে বলেই আমরা ধরে নিচ্ছি। সেই সময় বাংলাদেশের আইনশৃংখলা পরিস্থিতি কীরকম হয়, পুলিশ বাহিনীর আইজি মহোদয় কে হন, র‌্যাব বাহিনীর মহাপরিচালক কে হন, গুম-খুন ইত্যাদির ফ্রিকোয়েন্সি বা হার কীরকম থাকে, যে চার-পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনে আগামী বছরের শুরুতেই নির্বাচন হবে সেগুলোর পরিচালনা ও ফলাফল কেমন হয় এসব কিছুর উপরেই নির্ভর করবে সেনা মোতায়েনের ব্যাপ্তি ও নিবিড়তা। ইতোমধ্যে পত্রিকায় লিখেই চলেছি, অদূর বা দূর ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা না করে আমার কথাগুলো আমি বলে যাচ্ছি। যে সকল সম্মানিত পাঠক, যে সকল আগ্রহী পাঠক, যে সকল পরিশ্রমী তরুণ কথাগুলোকে সংরক্ষণ করবেন, তাঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা থাকলেও চূড়ান্ত উপকারিতা পাবেন সংরক্ষণকারী নিজে। কারণ, সবসময় সব কথা বের হয় না। ব্যাখ্যা দিব না শুধু মন্তব্যটিই করলাম: ‘বর্ষাকালে তুফান ছাড়া বৃষ্টি পাওয়া যায়, কিন্তু অক্টোবর-নভেম্বর অথবা মার্চ-এপ্রিল মাসে বৃষ্টি আসে সিডর আইলা নার্গিস ইত্যাদির সঙ্গে।’ আমি নিবেদন করে রাখছি যে, ২০০০ সালের পার্লামেন্টের সরকারি দল (আওয়ামী লীগ) এই কথা বাজারে ছেড়ে দিয়েছিল যে, নির্বাচনে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই। সেই ২০০০ সালে বা ২০০১ সালে এই নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল; অনেক লেখালেখি হয়েছিল। ফলশ্রæতিতে, ২০০১ সালের আগস্ট মাসে যেই তত্ত¡াবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল তারা এবং ২০০৮ সালে বিদ্যমান তত্ত¡াবধায়ক সরকার, উপযুক্তভাবে, সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনকালে, নির্বাচন কমিশনের আদেশ মোতাবেক দেশের খেদমত করা।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নির্বাচন

২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ