শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
সংক্ষিপ্ত জীবনকথা
রূহুল আমীন খান : হঠাৎ সেখানে দরবেশী পোষাকের এক আগন্তককে দেখে কিছুটা বিরক্ত হলেন। আগন্তুক সে দিকে ভ্রƒক্ষেপ না করে সুসজ্জিত দুর্লভ কিতাবগুলির দিকে ইশরা করে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন। ইনঁহামাচিস্ত অর্থাৎ এগুলো কি? মাওলানা রূমী তাচ্ছিল্য ভরে উত্তর করলেন : ‘তু চে’দানি?’ ‘তুমি এর কি বুঝবে’? অর্থাৎ এসব হচ্ছে দর্শন বিজ্ঞানের গ্রন্থ তুমি এর কি বুঝবে? খ্যাপা দরবেশ তৎক্ষণাৎ কিতাবগুলো পার্শ্বস্ত কূপে নিক্ষেপ করলেন। কিছু বুঝে ওঠবার আগেই বহু যতেœ ও চেষ্টায় সংগৃহিত কিতাবসমূহ কূপে নিমজ্জিত ও ধ্বংস হতে দেখে রূমী দুঃখে ক্ষোভে, ক্রোধে বেশামাল হয়ে পড়লেন। তাঁর এ অবস্থা দেখেও দরবেশ নির্বিকার। তিনি ধীর পদক্ষেপে আবার এগিয়ে গেলেন কূপের কিনারায় এবং পানির তলদেশ থেকে এক এক করে তুলে আনলেন কিতাবসমূহ। মাওলানা বিস্ময়ে বিস্ফোরিত চোখে দেখলেন কোন একটি কিতাবের সামান্যতম ক্ষতি হয়নি, এমনকি ভিজেও যায়নি একটি পাতাও। যথা পূর্বং তথা পরং যেমনটা ছিল ঠিক তেমনটাই রয়েছে। বিস্ময়বিহŸল কণ্ঠে দরবেশকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি ইন্ঁহামা চিস্ত? এটা কি ব্যাপার? দরবেশ নিরুত্তাপ নিরুদ্বেগ কণ্ঠে উত্তর দিলেনÑ ‘তু চে’ দানি? ‘তুমি এসবের কি বুঝবে?’ অর্থাৎ এসব সূ²াতি সূক্ষè আধ্যাত্মিক বিষয়াবলীর তাৎপর্যের তুমি কি বুঝবে? মাওলানা রূমী তাঁর কথা ও কাজের সমুচিত জবাব পেয়ে গেলেন হাতে হাতে এবং সেই সঙ্গে অন্তর রাজ্যে ঘটে গেল তাঁর মহাবিপ্লব। দ্বিধা হীন চিত্তে নিজেকে সমর্পণ করলেন তিনি কামিল মুর্শিদের চরণে। ছাড়লেন মাদরাসা, পরিত্যাগ করলেন লাইব্রেরী, বিসর্জন দিলেন জাগতিক জ্ঞান-সাধনা। পতঙ্গের মত ঝাপ দিলেন ইশকে ইলাহীর তীব্র হুতাশনে। আকণ্ঠ পান করলেন মারিফতে রব্বানীর শরাবন তহুরা। এত দিনকার ভক্ত অনুরাগীরা হারিয়ে ফেলল তাদের চিরপরিচিত অতিপ্রিয় মাওলানা জালাল উদ্দীনকে। তিনি আর উস্তাদের আসনে আসীন হয়ে কুরআন, হাদীস, তাফসীর, ফিকহ দর্শন হিকমতের তালীম দেন না। করে না মসজিদের ইমামতী। খানকার মজলিসে আগ্রহী শ্রোতাদের শুনান না আর প্রজ্ঞা পান্ডিত্যপূর্ণ সুললিত কণ্ঠের ওয়াজ। ফাতোয়া ফরায়েয নিতে আসা প্রার্থীরা ফিরে যায় নিরাশ হয়ে। ব্যাকুল চিত্তে ইন্তেজার করতে লাগল সবাই, আবার বুঝি ফিরে আসেন তিনি পূর্বাবস্থায়। কিন্তু না। বরং ক্রমেই বর্ধিত হতে লাগল মত্ততা। তারা বলাবলি করতে লাগল ঐ বেটা দরবেশই সব নষ্টের মূল। তারা যারপরনাই বিরক্ত হল শামসুত্তাবরীযের ওপর। ভাবতে লাগল এই লোকটি যাদুকর হবে হয়ত। এই অলিক ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা নানা ভাবে তাকে বিরক্ত ও উত্যক্ত করতে লাগল। ফলে কৌনিয়ায় অবস্থান করা তার পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠল। অবশেষে তিনি সবার অগোচরে চুপিসারে কৌনিয়া থেকে পালিয়ে গেলেন (৬৪৩ হিজরী, ১লা শওয়াল)।
শামসের অন্তর্ধানে রূমী বেচাইন, বেকারার হয়ে পড়লেন। শায়খের বিরহে তাঁর অবস্থা হয়ে পড়ল অত্যন্ত নাযুক। ভাল করতে গিয়ে মন্দ হল দেখে ভক্তেরা অনুতপ্ত হল, খুঁজতে লাগল তাঁকে কিন্তু লাপাত্তা। বেশ কিছু দিন পরে দামেশ্ক থেকে শামসের এক চিঠি এল মাওলানা রূমীর কাছে। এতে তাঁর অস্থিরতার মাত্রা অনেকটা প্রসমিত হল। মাওলানা উত্তরে অপূর্ব ছন্দবদ্ধ কবিতায় শামসের কাছে পরপর ৪ খানা পত্র পাঠালেন। এতে তুলে ধরলেন তার বিরহ-ব্যাকুল হৃদয়ের অস্থিরতা। তিনি তাঁকে উদাত্ত আহŸান জানালেন কৌনিয়ায় প্রত্যবর্তনের। এক পত্রে মাওলানা লিখলেন :
<>
এসো হে আমার হৃদয়ের জ্যোতি শীঘ্র এসো। চিরবাঞ্ছিত মহাকাক্সিক্ষত শীঘ্র এসো। ভক্তগণ তারীযীকে কৌনিয়া ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিলেন, এজন্য ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি টিম গঠন করে এর নেতৃত্ব দিলেন মাওলানার জ্যেষ্ঠপুত্র সুলতান ওলাদের ওপর। এতে মাওলানা অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। যথা সময় কাফেলা দামেশ্ক পৌঁছল এবং অনেক খোঁজাখুঁজির পর আত্মগোপনকারী তাবরীযীকে এক সরাইখানায় আবিষ্কার করল। সুলতান ওলাদ তাঁর খেদমতে মাওলানার আবেগ ও নিবেদন পূর্ণ এক খানা পত্র এবং তাঁর পক্ষ থেকে হাদিয়া স্বরূপ প্রেরিত সহস্র ¯¦র্ণমুদ্রা তাবরীযীর খেদমতে পেশ করলেন। তিনি ওলাদ ও তার কাফেলাকে দেখে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন এবং বললেন, এই চারাখন্ডের কোনই আবশ্যক নাই, মাওলানার খবর ও চিঠিই যথেষ্ট। বললেন :
<>
“শীষ ও দানার ফাঁদে পড়ে না চতুর পাখি’। অবশেষে তিনি কাফেলার সঙ্গে যাত্রা কররেন কৌনিয়া অভিমুখে। মাওলানা রূমী বিপুল সমারোহে কৌনিয়া শহরের দ্বারদেশে শায়খ তাবরীযীকে অভ্যর্থনা জানালেন। দীর্ঘ বিরহের পর আশিক মাশুকের মিলন ঘটল। ভক্তেরা ধারণা করেছিল তাবরীযীকে পেলে রূমী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবেন কিন্তু অবস্থা দাঁড়াল তার বিপরীত। পীরের মুহব্বতে আত্মহারা রূমী সব ছেড়ে পীরকে নিয়েই রইলেন মশ্গুল। ভক্তদের রোষ গিয়ে পড়ল আবার শায়খ শামসুত্তাবরীযের ওপরে। এবার তারা তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করল। গঠন করল গুপ্ত ঘাতক দল। এদের মধ্যে ছিল মাওলানা রূমীর মেঝ পুত্র আলাউদ্দীনও।
শামসের জীবনাবসান
গভীর রাত। রূমী ও শামস্ তাঁদের কক্ষে ইশ্কে ইলাহীতে মশগুল। হঠাৎ বাহির থেকে এক জন তাবরীযীকে উচ্চস্বরে আহŸান জানাল কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। তিনি শান্ত কণ্ঠে মাওলানাকে বললেন, দুনিয়ার মুসাফিরখানা থেকে বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে সুতরাং যাওয়া আবশ্যক। এই সঙ্গে তিলাওয়াত করলেন :
<>
‘সৃজন এবং (মৃত্যুর) আদেশ প্রদানের ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই, আর কতই না মহিমাময় বিশ্বজগতের প্রতিপালক সেই আল্লাহ।’ তিনি কামরা থেকে বেরিয়ে আসতেই সশস্ত্র ঘাতকরা তার ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। তাদের একজন তার বুকে ছুরি বসিয়ে দিল, তিনি জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। সেই চিৎকারে ঘাতকরা বেহুশ হয়ে পড়ল। হুঁশ ফিরে এলে তারা দেখতে পেল শামস আর নেই, সেখানে পরে আছে কেবল মাত্র কিছু রক্ত। পরে শামসকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। অবশ্য কোন কোন জীবনীকার স্বাভাবিক ভাবেই তিনি ইন্তেকাল করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। এই ঘটনা ঘটে ৬৪৫ হিজরী সনে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।