শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
মাহমুদ কামাল
লেখাটির শিরোনাম‘ হুমায়ূন আহমেদ এখনও জনপ্রিয়।’ তার লেখা তো বটেই ব্যক্তি হুমায়ূনও পাঠকের হৃদয় থেকে নেমে যাননি। এখনও জনপ্রিয় মানে এই নয় ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তার নাম থাকবে না। জীবদ্দশায় অনেক ‘পÐিত’ নানাভাবে তার লেখার সমালোচনা করেছেন। কেউ কেউ এক সময়ের জনপ্রিয় লেখক সৌরিন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন গুপ্তের উদাহরণ টেনে বলেছেন, নতুন পাঠক তাদের লেখা ছুঁয়েও দেখে না। কথাটি সত্য। কিন্তু তারা শরৎচন্দ্রের নাম বলেননি। শরৎচন্দ্র তখনও এবং এখনও জনপ্রিয়। জনপ্রিয় হলেই সমকাল কেটে গেলে ভবিষ্যতে সেই লেখক অপাংক্তেয় হয়ে যাবেন ্এরকম মন্তব্য ব্যর্থ লেখকদেরই। ঈর্ষাপরায়ণ লেখক কিংবা সাধারণ মানুষ অনেক ক্ষেত্রে মন্তব্যের বেলায় কোনও যুক্তির ধার ধারেন না। হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তি জীবনের প্রসঙ্গ তুলেও গালিগালাজ করা হয়েছে। এত কিছুর পরও পাঠকের কোল থেকে তিনি নামেননি। বর্তমানে তার সমান জনপ্রিয় লেখকেরও কোনও উদাহরণ নেই।
তিনি কেন এত জনপ্রিয়? এ নিয়েও কম লেখা হয়নি। তার লেখার চরিত্রগুলো মধ্যবিত্ত শ্রেণির, লেখার মধ্যে তিনি হাস্যরস যোগ করেন এবং অতি সাধারণ চরিত্রও তার লেখায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এই বিষয়গুলোই তার জনপ্রিয়তার মাপকাঠিÑ এ ভাবেই তার লেখার মূল্যায়ন করা হয়েছে। সব চাইতে যে বিষয়টি আলোকপাত করা দরকার তা হলো তার রচনা রীতি অর্থ্যাৎ লেখার ভাষা। এ প্রসঙ্গে একটু ব্যক্তিগত বিষয় আলেকপাতা করতে চাই। তিরিশ বছর আগেএই লেখক বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে অনার্স পরীক্ষায় তৃতীয় পত্রে চল্লিশ নম্বরের ‘বাংলাদেশের উপন্যাস’ প্রবন্ধের আলোচনা লিখতে গিয়ে ধান ভানতে শিবের গীত গেয়েছিল। বিষয়টি একান্ত নিজের। তবে এই আলোচনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলেই তার বর্ণনা করা হচ্ছে। প্রশ্নটির উত্তর লিখতে গিয়ে বাংলাদেশের উপন্যাসের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের উপন্যাস এদেশে কেন জনপ্রিয় তার একটি তুলনামূলক ব্যখ্যা দেয়ার চেষ্টা ছিল। পশ্চিমবঙ্গের উপন্যাসিকদের লেখার ভাষা প্রাঞ্জল এবং ঝরঝরে। অহেতুক কাঠিন্য নেই এবং সামাজিক বিষয় বর্ণনা বাস্তব সম্মত। পাশাপাশি আমাদের লেখকদের অনেকের লেখার ভাষা এমনই কংক্রীট যে অভিধান দেখে অর্থ বের করে সেসব গল্প-উপন্যাস পড়তে পাঠকের ইচ্ছা এবং সময় কোনটাই ছিল না। অবশ্যই এটি গড় মন্ত্যব্য নয়। পরীক্ষার সেই প্রবন্ধেএ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা ছিল। প্রবন্ধটি লিখে হল থেকে বের হওয়ার পর হৃৎকম্পন শুরু হয় এই ভেবে ঐ পত্রটি সম্ভবত অকৃতকার্যের মধ্যেই পড়ে যাবে। শিবের গীত হলেও সহৃদয় পরীক্ষক অসম্ভব নম্বর দিয়েছিলেন । বলতে চেয়েছি ভাষার প্রাঞ্জলতা বিষয়ে। গদ্যভাষা যে পাঠকের আয়ত্তের মধ্যেই থাকতে হবে এই বিষয়টি হুমায়ূন আহমেদ শুরু থেকেই বুঝেছিলেন।
শুরু ‘নন্দিত নরক দিয়ে হলেও ‘শঙ্খনীল কারাগার’ তার আগের রচনা। নন্দিত নরক তাকে নিন্দিত করার পরিবর্তে নন্দিতই করে। বের হওয়ার পরপরই উপন্যাসিক সেই সময়ের মর্যাদা সম্পন্ন লেখকশিবির পুরস্কার পেয়ে যান। আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।। নন্দিত নরকের কাহিনি,চরিত্র এবং লেখার ভাষা এই তিনটি বিষয়ের সমন্বয় সাধন নতুন লেখকের হাতে ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিল বলেই পাঠক তাকে গ্রহণ করে নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অচেনা হুমায়ূন আহমেদ জানান দিলেন “আমি বৃক্ষ হতে চলেছি।’
বৃক্ষ তিনি হয়েছেন। রীতিমত মহীরুহ। তার গদ্যভাষা লেখকজীবনের শুরুতে যেমন ছিল শেষেও তাই। এখানে ‘নন্দিত নরক’ এবং ‘শঙ্খ নীল কারাগার’ উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তার ভাষার প্রাঞ্জলতা বিষয়টি পরিস্কার করি।
আমাদের সংসারে কি একটা পরিবর্তন এসেছে। সুর কেটে গেছে কোথাও। নীলু আমার সমস্ত চেতনা এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। মা ভীষণ রকম নীরব হয়ে পড়েছেন। শংকিতভাবে চলাফেরা করেন। তাঁর হতাশ ভাবভঙ্গী, নিচু স্বরে টেনে টুনে কথা বলা সমস্তই বলে দেয় কিছু একটা হয়েছে। ( নন্দিত নরকে )।
মাঝে মাঝে বৃষ্টি নামে। এক ঘেয়ে কান্নার সুরের মত সে শব্দ। আমি কান পেতে শুনি। বাতাসে জাম গাছের পাতার সর সর শব্দ হয়। সব মিলিয়ে হৃদয় হা হা করে ওঠে। আদিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতায় কি বিপুল বিষন্নতাই না অনুভব করি। জানালার ওপাশের অন্ধকার থেকে আমার সঙ্গীরা আমায় ডাকে। একদিন যাদের সঙ্গ পেয়ে আজ নিঃসঙ্গতায় ডুবছি। ( শঙ্খ নীল কারাগার )।
ঈদ সংখ্যাগুলোতে আমরা প্রচুর পাঠযোগ্য উপন্যাস পাচ্ছি। এখন পাঠকসমাজও বিমুখ নয়। এ পথ তো হুমায়ূন আহমেদই তৈরি করে গেছেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।