Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যুক্তরাষ্ট্র ১৪ বছর আগে ইরাকে হামলা করেছিল : এখন সেখানে ইরানের কর্তৃত্ব-২

| প্রকাশের সময় : ১৯ জুলাই, ২০১৭, ১২:০০ এএম

টাইমস অব ইন্ডিয়া : এ প্রদেশে ইরানের মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গোষ্ঠিগত নির্মূলীকরণের অভিযোগ রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে শিয়া প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য সুন্নীদের তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা এবং সীমান্তে একটি বাফার জোন প্রতিষ্ঠা করা। আইএস দু’ বছরেরও আগে দিয়ালা থেকে আইএস বিতাড়িত হয়েছে। হাজার হাজার সুন্নী পরিবার এখনো নোংরা উদ্বাস্তু শিবিরে বাস করছে। তারা বাড়ি ফিরতে পারছে না। এখন ইরান তার ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলে শিয়া উত্থানকে কতটা জরুরি হিসেবে দেখে দিয়ালা তারই নজিরে পরিণত হয়েছে।
দিয়ালার সুন্নী প্রাদেশিক পরিষদের মহিলা সদস্য ও ইরানের স্পষ্টভাষী সমালোচক নিজাত আল -তাই বলেন, ইরান আমেরিকার চেয়ে অনেক বেশী স্মার্ট। তিনি তার বিরুদ্ধে কয়েকটি হত্যা চেষ্টার জন্য প্ররোচনা দাতা হিসেবে ইরানকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ভূমিতে তারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করেছে। আমেরিকা ইরানকে ঠেকাতে পারেনি। তারা ইরাকের শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করেছে এবং দেশটিকে ইরানের হাতে তুলে দিয়েছে। ইরানের আলকুদস ব্রিগেডের প্রধান মেজর জেনারেল কাসেম সোলায়মানি ও অন্যান্য ইরানি নেতারা ’৮০-র দশকে ইরাকের সাথে যুদ্ধের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। সোলায়মানি অধিকাংশ সময় রণাঙ্গনে ছিলেন। এ সময় বহু অফিসার নিহত হন, ফলে তিনি দ্রæত পদোন্নতি লাভ করেন।
বিরোধ নিরসন সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রæপ-এর ইরান বিশ্লেষক আলি ভায়েজ বলেন, ইরাক-ইরান যুদ্ধ ছিল সকল ইরানি নেতার গড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা লাভের সময়। যে শাতিল আরব জলপথ ছিল এ যুদ্ধের মূল কারণ সে সমস্যা আজো সমাধান হয়নি। যুদ্ধের বর্বরতা ইরান সরকারকে তখন থেকে প্রভাবিত করেছে ইরাকের ব্যাপারে পারমাণবিক অস্ত্রের নীতি অবলম্বন করতে। আইন প্রণেতা ও সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মোয়াফ্ফাক আল রুবাই বলেন, তাদের মনে এটি এক স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করেছে। তারা বাথিজম, সাদ্দাম ও ইরাক- ইরান যুদ্ধ বিষয়ে তারা দুঃস্বপ্ন পীড়িত।
বিশ্লেষকরা বলেন, সব চেয়ে বড় কথা, যুদ্ধের এই ক্ষতের উত্তরাধিকার ইরানিদের ইরাকে প্রাধান্য বিস্তারের উচ্চাকাক্সক্ষায় চালিত করেছে। বিশেষ করে শিয়া প্রধান ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে সর্বত্র ইরানি প্রভাব দৃশ্যমান।
ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়ারা নজফ ও কারবালার শিয়া পবিত্র স্থানগুলোর রক্ষক যা বাণিজ্য ও পর্যটন কেন্দ্র। স্থানীয় পরিষদগুলোতে ইরান সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণায় শিয়া ধর্মগুরু ও ইরানি ধর্মীয় নেতাদের সাথে সম্পর্কের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়। নজফের ঠিক বাইরের এক ব্যবসায়ী মুসতাক আল-আবাদি বলেন, যদি ইরাক সরকার শক্তিশালী হত তাহলে আমরা ইরানি পণ্য গ্রহণের বদলে আমাদের কারখানাগুলো খুলতে পারতাম। তিনি বলেন, আমাদের গুদামগুলো ইরানি পণ্যে ভর্তি, কারণ সরকার বেসরকারী খাতের বিকাশে , সীমান্তে প্রহরায় এবং ইরানি পণ্যে শুল্ক আরোপের ব্যাপারে কিছু করছে না।
দক্ষিণ ইরাকের একটি শহর হিলার একজন ব্যবসায়ী রাদ ফাযিল আল-আলওয়ানি ইরান থেকে আনা জিনিসপত্র ও ফ্লোর টাইলস পরিষ্কার করছিলেন। তিনি ডিটারজেন্টের বোতলগুলোতে মেড ইন ইরাক লেবেল লাগাচ্ছিলেন যদিও সেগুলো ইরানে তার কারখানায় তৈরি। সেখানে শ্রমিক সস্তা। তিনি বলেন, আমি উপলব্ধি করি যে আমি ইরাকের অর্থনীতিকে ধ্বংস করছি। তিনি বলেন, ইরাকি রাজনীতিকরা ইরানি চাপের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে এবং স্থানীয় শিল্পকে সমর্থন করতে অস্বীকার করে কোনো কিছু করা কঠিন করে তুলেছে।
নজফে হজরত আলি রা.এর সোনালি গম্বুজের মাজার পরিদর্শনের জন্য লাখ লাখ ইরানি ভক্ত প্রতিবছর সেখানে আসেন। মাজারগুলো পুনঃসজ্জা ও হোটেল তৈরির জন্য আসেন ইরানি নির্মাণ শ্রমিকেরা। ইরাকি কর্মকর্তারা তাদের অধিকাংশকেই ইরানি গুপ্তচর হিসেবে দেখেন।
স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, বাবিল প্রদেশে মিলিশিয়া নেতারা কৌশলগত সড়কগুলোর পাশে নিরাপত্তা ক্যামেরা, স্থাপনের একটি সরকারী প্রকল্পের কাজ নিয়েছেন। মিলিশিয়ারা হস্তক্ষেপ করার আগে একটি চীনা কোম্পানি এ কাজটি পেয়েছিল। এ এলাকার একজন সেনা ক্যাপ্টেন বলেন, এখন সেনাবাহিনী ও স্থানীয় পুলিশকে এ প্রকল্প থেকে এক পাশে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। দক্ষিণ ইরাকে ইরানের প্রাধান্যের বিরুদ্ধে অসন্তোষ রয়েছে। ইরাকি শিয়ারা ধর্মীয় ভাবে ইরানি শিয়াদের সাথে অভিন্ন, কিন্তু তাদের ইরাকি ও আরব হিসেবে আলাদা পরিচিতিও রয়েছে।
নজফের একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধর্মীয় নেতা শেখ ফাযির আল-বিদায়রি বলেন, ইরাক আরব লীগেরÑ ইরানের নয়। ইরাকে শিয়ারা সংখ্যাগুরু, কিন্তু বিশে^ সংখ্যালঘু। যতদিন ইরানি সরকার ইরাক সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করবে, ততদিন আমাদের কোনো সুযোগ নেই।
মরহুম ইরাকি রাজনীতিক আহমেদ চালাবির এক সাবেক সহযোগী ইনতিফাদ কানবার বলেন, ইরানিদের জন্য ইরাকে দুর্নীতি চালু রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
মিলিশিয়াদের দীর্ঘ হাত
দশকের পর দশক ধরে দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল জলাভূমি এলাকা দিয়ে ইরান ইরাকে অস্ত্র ও বোমা তৈরীর সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। নতুন রিক্রুট করা তরুণদের সীমান্ত দিয়ে আনা নেয়া করেছে , তাদের এক নিরাপদ স্থান থেকে আরেক নিরাপদ স্থানে নিয়েছে। ইরানে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তারপর লড়াইয়ের জন্য তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। প্রথমে শত্রæ ছিলেন সাদ্দাম, তারপর আমেরিকা।
এখন ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর এজেন্টরা দক্ষিণ ইরাক থেকে প্রকাশ্যে যোদ্ধা সংগ্রহ করে। বাসভর্তি রিক্রুটরা সহজেই সীমান্ত পেরিয়ে যায়, সীমান্ত চৌকিগুলো অবশ্যই ইরান কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। একদিকে থাকে তাদের অনুগত ইরাকি মিলিশিয়ারা, অপরদিকে তাদের নিজেদের রক্ষীরা।
ইরান যখন ইরাকে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য মিলিশিয়া বাহিনী তৈরী করছিল , একই সাথে সে অসন্তুষ্ট ইরাকি শিয়া তরুণদের নিয়ে তাদের পক্ষে সিরিয়ায় লড়াইয়ের জন্য একটি বাহিনী গঠন করে।
মোহাম্মদ খাদিম নামের এক ৩১ বছর বয়স্ক গার্ড বাহিনীর সদস্য বলেন, আমার টাকা দরকার। টাকা আয়ের জন্যই অধিকাংশ যুবক সিরিয়ায় লড়াই করতে গেছে। তিনি নজফে বিপ্লবী গার্ডের নিয়োগকর্তার সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তাকে বাসে করে দক্ষিণ ইরাক, সেখান থেকে ইরানে নেয়া হয়। তেহরানের কাছে অন্যদের সাথে তিনি সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তাদের সবাইকে ইমাম হোসেন রা.-এর শাহাদাতের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ইরানি অফিসাররা বক্তৃতা করতেন। সুন্নী সেনাদলের হাতে ইমাম হোসেনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শিয়া ধর্মীয় মতাদর্শের উদ্ভব হয়। অফিসাররা আরো বলতেন, ইমামকে হত্যাকারী শিয়াদের একই শত্রæ এখন সিরিয়া ও ইরাকে রয়েছে।
শিয়া ধর্মীয় মতাদর্শ রক্ষার ইরানের গুরুত্ব আরোপ কিছু লোককে এ উপসংহারে পৌঁছে দেয় যে ইরাকে ইরানি ধরনের ধর্মীয় শাসন কায়েম করাই ইরানের লক্ষ্য। কিন্তু একটি দৃঢ় বিশ^াস আছে যে এটা ইরাকের ক্ষেত্রে কোনো কাজ করবে না যেখানে রয়েছে বিরাট সংখ্যক সুন্নী আদিবাসী। আর ইরাকের শীর্ষ শিয়া ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি আল-হুসেইনিসহ ইরাকি ধর্মীয় নেতারা ইরানি ব্যবস্থার বিরোধী।
ইরান মিলিশিয়া ক্ষমতাকে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে চায়, ততটা যতটা তারা লেবাননে হিজবুল্লাহর সাথে করেছে। ইরাকে মিলিশিয়া নেতারা আগামী বছর পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগেই রাজনৈতিক সাংগঠনিক কাজ শুরু করেছেন। এপ্রিল মাসে কায়েস আল-খাজালি নামের এক শিয়া মিলিশিয়া নেতা ইরাকি কলেজ ছাত্রদের এক সমাবেশে বক্তৃতা কালে যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্ক ও সউদি আরবের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তাদের প্রতি আহবান জানান। তারপর মিলিশিয়া নেতার সঙ্গী এক কবি মঞ্চে আসেন ও কাসেম সোলায়মানির প্রশংসা করে কবিতা পাঠ করেন।
ছাত্রদের জন্য এটা ছিল কফিনে শেষ পেরেক। মুহূর্তের মধ্যে ইরান বিদায় হও, ইরান বিদায় হও ¯েøাগানে ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে শুরু করে। ছাত্রদের ও খাজালির দেহরক্ষীদের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়। দেহরক্ষীরা শূন্যে গুলি ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
বিক্ষোভে উপস্থিত দক্ষিণ ইরাকের দিওয়ানিয়ার আল -কাদিসিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র মুস্তাফা কামাল বলেন, আমাদের বিক্ষোভের কারণ ছিল ঐ কবিতা। কামাল ও তার সতীর্থ ছাত্ররা দ্রুতই বুঝতে পারেন যে এ সময় ইরানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কত মারাত্মক হতে পারে। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইরান


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ