হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ
বলা হয়, ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সব নাগরিক সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করে। ভারতও বিশ্বে নিজেকে এভাবেই তুলে ধরে। মোদী সরকার এসে শ্লোগান দিয়েছে, ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’। সবদিক থেকে ভারতকে ‘শাইন’ বা উজ্জ্বল করে তোলার ব্রত নিয়ে শাসন কাজ পরিচালনা করছেন তিনি। অথচ এই উজ্জ্বলতার শ্লোগানের নিচে যে অন্ধকার সৃষ্টি হচ্ছে, তা বেমালুম হয়ে যাচ্ছেন। তার দেশে যে নৃশংস ও বর্বর কর্মকাÐ ঘটে চলেছে, তা সামাল দিতে পারছেন না। ভারতে যে গণতান্ত্রিক অধিকার সমান নয়, সব নাগরিকের সুযোগ-সুবিধা অভিন্ন নয় এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা শব্দগুলো শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে সেদিকে খেয়াল নেই। এক গরু নিয়ে যে নিষ্ঠুর কর্মকাÐ চলছে, তার কোনো নজির নেই। বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের দাবীদার দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলমানদের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় তাদের অধিকার খুবই সীমিত। তাদের অনেকটা দ্বিতীয় শ্রেণী বা তার নিচের সারির নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রথম সারির চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ এতটাই কম যে দূরবীণ দিয়েও মুসলমানদের খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গণতন্ত্রের পূজারী দেশটিতে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের সরকারি চাকরি পাওয়া কঠিন। ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার কথা যদি ধরা হয়, তবে দেখা যাবে দেশটিতে এসব নামেই আছে বাস্তবে নেই। যদি থাকত, তবে মুসলমানরা এত হামলা, নিপীড়ন, নির্যাতন, বর্বরতা ও হত্যার শিকার হতো না। এক গরুর গোশতকে কেন্দ্র করে যে নৃশংসতা উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা দেখাচ্ছে, তাতে বিশ্ববাসীর বিস্ময়ের অবধি নেই। গরুর গোশত বহন, বিক্রিকে কেন্দ্র করে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের উপর যে অকথ্য নির্যাতন এবং হত্যাকাÐ চালাচ্ছে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। গত ২৯ জুন বিজেপি শাসিত ঝাড়খÐে আলিমুদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে নির্মমভাবে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা পিটিয়ে হত্যা করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি একটি মারুতি গাড়িতে করে গরুর গোশত নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ অভিযোগের উপর ভিত্তি করে তাকে গাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তার আগে ২০ জুন একই রাজ্যে উসমান আনসারি নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার বাড়ির বাইরে থেকে এক মরা গরু উদ্ধার করা হয়েছে। আহত অবস্থায় উসমানকে পুলিশ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিতে নিতে তার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, মারুতি গাড়িতে করে আলিমুদ্দিন কিসের গোশত নিয়ে যাচ্ছিলেন, তা অজানা থেকে গেছে। পুলিশ বলছে, উদ্ধার হওয়া গোশতের নমুনা ফরেনসিক ল্যাবরেটিরিতে পরীক্ষা করার পর বোঝা যাবে, কিসের গোশত ছিল। অর্থাৎ ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের প্রতি এতটাই ভয়ংকর হয়ে উঠেছে, যে কোনো ছুঁতোয় তারা মুসলমানদের উপর ঝাপিয়ে পড়ছে, হত্যা করছে। এটা কি ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের নমুনা?
দুই.
বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে ধর্মনিরপেক্ষতার দাবীদার কংগ্রেস সরকারের আমলে মুসলমানদের উপর নির্যাতন অনেকটাই বেড়ে যায়। মুসলমানরা এতটাই অতীষ্ঠ হয়ে পড়ে যে, কংগ্রেস সরকার বিদায় না হলে তাদের উপর নীপিড়ন ও নির্যাতন কোনোভাবেই সহনীয় পর্যায়ে আসবে না। নির্বাচনের সময় উগ্র হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদী তার মিষ্টি মিষ্টি কথার ঝড় তোলেন। মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বলেন। এতে মুসলমানরা আশ্বস্ত হয়েছিল এই ভেবে, মোদীর বিজেপি ক্ষমতায় এলে তার গায়ে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দুত্ববাদের যে দুর্গন্ধ লেগে আছে, তা দূর করতে চেষ্টা করবে। তার বদনাম ঘুচাতে হলেও উগ্রবাদ পরিহার করবে। মুসলমানরা কংগ্রেসের উপর এতটাই ত্যক্ত-বিরক্ত ছিল যে, তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে বিজেপিকে সমর্থন দেয়। মুসলমান অধ্যুষিত রাজ্যগুলোতে কংগ্রেসকে হটিয়ে বিপুল বিজয় অর্জন করে বিজেপি। অথচ এসব রাজ্য চিরকাল কংগ্রেসেরই দখলে ছিল। মোদী তার কথার কারিশমা দিয়ে মুসলমানদের আশ্বস্থ করে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। কংগ্রেসের এমন অবস্থা হয় যে বিরোধী দলে বসারও যোগ্যতা হারায়। কোনো রকমে ছোটখাটো দলের সাথে জোট করে বিরোধী দলে বসে। বলা যায়, বিজেপি অনেকটা করুণা করে কংগ্রেসকে বিরোধী দলে বসতে দেয়। কংগ্রেসের এই করুণ দশার অন্যতম মূল কারণ ছিল মুসলমানদের সমর্থন হারানো। যে মুসলমানরা বরাবরই কংগ্রেসের ভোট ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ছিল, সেই তারা দলটির দ্বারা নিগ্রহের শিকার হয়ে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। মোদী ক্ষমতায় আসার পর কিছুদিন মুসলমানরা স্বস্তিতে থাকলেও, তাদের এ স্বস্তি অল্প সময়েই কর্পুরের মতো উড়ে যায়। আসলে কয়লা ধুলে যে ময়লা যায় না, তার যথার্থতা প্রমাণ করে বিজেপি তার স্বরূপে ফিরে। প্রকাশ পেতে শুরু করে তার উগ্রতা এবং মুসলমান বিদ্বেষ। একটি পরিসংখ্যান দিলেই বিষয়টির যথার্থতা প্রমাণিত হবে। ইন্ডিয়াস্পেড নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে ২০১০ সাল থেকে বিগত ৮ বছরে মুসলমানরা কী হারে উগ্র হিন্দুদের হামলা ও হত্যার শিকার হয়, তার তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ সালের পর গরু সংক্রান্ত সহিংসতায় প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের ৮৬ শতাংশই মুসলমান। আর গরু নিয়ে মুসলমানদের উপর যত হামলা হয় তার ৯৭ শতাংশই নরেন্দ্র মোদীর শাসনামলে। এসব হামলার ৫২ শতাংশই হয় গুজব ছড়িয়ে। আমরা জানি, বিজেপি ও তার সমর্থক উগ্রবাদী অঙ্গ সংগঠনের টার্গেটই হচ্ছে গুজব ছড়িয়ে এবং ষড়যন্ত্র করে মুসলমানদের উপর হামলা ও হত্যা করা। আমরা যদি ২০০২ সালের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা বিবেচনা করি, তবে দেখব ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে পুরোপুরি গুজব রটিয়ে। সে সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ঐ বছরের ২৭ ফেব্রæয়ারি অযোধ্যা থেকে ট্রেনে করে এক দল হিন্দু সন্যাসি গোধরায় আসছিলেন। সেখানে ট্রেনটিতে কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে ৫৮ জন সন্যাসি মৃত্যুবরণ করে। রটিয়ে দেয়া হয় ট্রেনে আগুন দিয়েছে মুসলমানরা। মুহূর্তে গুজরাট জুড়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যায়। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের হত্যার লক্ষ্যে ঝাপিয়ে পড়ে। যেখানেই মুসলমান পায় কুপিয়ে, পুড়িয়ে, ইট দিয়ে মাথা থেতলে হত্যা করে। এমনকি গর্ভবতী মহিলার পেট কেটে বাচ্চা বের করে হত্যা করে। মুসলমানদের বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। প্রায় দুই হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়। অভিযোগ উঠে, ট্রেনে আগুন দেয়া এবং ঘটনার নেপথ্যে মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেন নরেন্দ্র মোদী। তদন্তে বিষয়টি ফাঁস হয়। বলা হয়, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করার জন্য। অর্থাৎ ট্রেনে আগুন দিয়ে গুজব রটিয়ে মুসলমানদের উপর দায় চাপিয়ে তাদের নির্মূল করাই ছিল ষড়যন্ত্রের মূল উদ্দেশ। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, বিজেপি ও তার উগ্রবাদী সংগঠন কতটা মুসলমান বিদ্বেষী। যে কোনো উসিলায় তারা মুসলমান হত্যা করার উদগ্র বাসনা পোষণ করে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদী গুজরাট দাঙ্গার অভিযোগ থেকে মুক্তি লাভ করেন। তবে তার এই শাসনামলে যে মুসলমানরা নিরাপদ নয় তা উল্লেখিত পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে। ঝাড়খÐে আলিমুদ্দি হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মোদী একটি বিবৃতি দিয়েছেন। গত ২৯ জুন তিনি গুজরাটের আহমেদাবাদে সবরমতি আশ্রমের শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বলেন, গরু রক্ষার নামে মানুষ হত্যা গ্রহণযোগ্য নয়। দেশকে অহিংসার পথে চলতে হবে। গো-সেবাই গো-ভক্তি। যদি কোনো ব্যক্তি ভুল করে থাকে তাহলে আইন তার নিজস্ব পথে কাজ করবে। কারোই আইন হাতে তুলে নেয়ার প্রয়োজন নেই। তার এই বক্তব্য যে ¯্রফে লোক দেখানো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ তার দলের সমর্থক উগ্র হিন্দুত্ববাদীরাই মুসলমানদের উপর হামলা ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। তিনি নিজের দলের নেতা-কর্মীদের এ ধরনের জঘন্য ঘটনা না ঘটানোর আহŸান না জানিয়ে শুধু দায়সারা একটি বক্তব্য দিয়ে দায় এড়িয়ে গেছেন। আবার গো সংক্রান্ত একটি নিবর্তনমূলক আইনও করেছেন। এই আইনে বলা হয়েছে, জবাইয়ের উদ্দেশে বিক্রির জন্য কোনো পশু বাজারে তোলা ও কেনাবেচা করা যাবে না। পশু মারা গেলে তা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। মরা গরুর চামড়া ছিলানো, হাড়গোড়সহ কোনো অংশই সংগ্রহ ও বিক্রি করা যাবে না। হাটে গরু উঠবে, রেজিস্ট্রেশন হবে, কেনাবেচা হবে, তবে তা কেবল কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য। গোশতের জন্য কেনাবেচা করা যাবে না। এই আইনের মাধ্যমে এটাই বোঝানো হয়েছে, ভারতের মুসলমানেরা গরুর গোশত খেতে পারবে না। এই আইনের মাধ্যমে কি একটি সম্প্রদায়ের প্রতি সুবিচার করা হলো? এটি কি গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নমুনা?
তিন.
গরু নিয়ে মুসলমানদের সাথে ভারতের উগ্রবাদী হিন্দুদের আচরণে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে তারা মানুষের চেয়ে গরুকে বেশি মর্যাদা দিচ্ছে। মানুষের জীবনের চেয়ে গরু বা পশুর জীবন অনেক মূল্যবান। তাই পশুর জীবন রক্ষা করতে গিয়ে মানুষ হত্যা করাই যেন তারা শ্রেয় মনে করছে। এই আচরণকে কি মানবিক বলা যায়? হিন্দু ধর্ম কি বলেছে, গরু বাঁচাতে গিয়ে অন্য ধর্মের মানুষ হত্যা করতে হবে? অথচ ভারতের নীতি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। তাহলে এক ধর্মের মানুষ যা বিশ্বাস করে, তাতে বাধা দেয়া হচ্ছে কেন? এটা কি তার নীতির খেলাপ নয়? ভারত সরকার গরু নিয়ে যে আইন করেছে, তাতে তো তাদের গরুর চামড়ার তৈরি কোনো জিনিসই ব্যবহার করা উচিত নয়। এমনকি গরুর চামড়া দিয়ে তৈরি জুতাও পরা ঠিক নয়। ভারতের জনগণ কি গরুর চামড়ার জুতা পরছে না? এতে কি গরুকে অসম্মান করা হচ্ছে না? আরেকটি দিক হচ্ছে, ভারত গরুর চামড়া রপ্তানি করে বিপুল আয় করে। এই চামড়া রপ্তানি করতে হলে গরু জবাই করা ছাড়া কি কোনো উপায় আছে? জবাই না করলে চামড়া রপ্তানি হবে কিভাবে? মুসলমানরা যদি গরু জবাই করে বা কোরবানি দেয়, তাহলে তাদের অন্যায়টা কোথায়? গরুকে যদি এতই সম্মান করতে হয়, তবে গরুর চামড়া রপ্তানিও তো বন্ধ করা উচিত। এসব বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা অন্ধের মতো মুসলমানদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে, যেখানে বোধ-বিবেচনা বলে কিছু নেই। তবে এটা স্পষ্ট যে, উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা গরু জবাইয়ের উসিলা দিয়ে চরম মুসলমান বিদ্বেষ এবং নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়েই এগুচ্ছে। তারা চাচ্ছে, দেশ ধর্মনিরপেক্ষ না থাকুক, এটা কেবল হিন্দুদের রাষ্ট্র হবে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের এই বাসনাকেই প্রকারন্তরে মোদী সরকার প্রশ্রয় দিয়ে আসছে। মুখে ‘এটা উচিত হচ্ছে না’, ‘অহিংসার পথে চলতে হবে’Ñএসব কথার কথা বলে দায় সারতে চাচ্ছে। যারা মুসলমানদের ধর্মীয় আচার-আচরণে বাধা দিচ্ছে এবং মৌলিক অধিকার হরণ করছে, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কেবল বলেছেন, কারো কোনো ভুল হয়ে থাকলে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। কারোই আইন তুলে নেয়ার প্রয়োজন নেই। তিনি মূল হোতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো কথা বলেননি। এতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা যে আরও প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে, তা তিনি বুঝেও না বোঝার ভান করছেন। মূল সমস্যা সৃষ্টিকারীদের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় আচার-আচরণের অধিকার রক্ষায় কোনো ভূমিকা পালন করছেন না। বরং পশুরু ওপর নিষ্ঠুরতা ঠেকানোর নাম করে পুরোপুরি ইসলামবিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছেন। অথচ তার ক্ষমতায় আরোহনের ক্ষেত্রে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর বিপুল সমর্থন রয়েছে। তবে এ কথাও ঠিক, ভারতের বেশিরভাগ হিন্দু উগ্রতা পছন্দ করে না। তাদের তুলনায় উগ্র হিন্দুত্ববাদীর সংখ্যা কম। এ বাস্তবতা সত্তে¡ও মোদী কেন এই উগ্র গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন, তা বোধগম্য নয়। এটা যদি তার রাজনৈতিক কৌশল হয়ে থাকে, তবে তা বড় রাজনৈতিক ভুলে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। কারণ এই উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা তাকে ক্ষমতায় আনেনি। ক্ষমতায় এনেছে এদের বাইরে থাকা বিশাল জনসাধারণ। মোদী হয়তো প্রকাশ্যে না হোক, অপ্রকাশ্যে ভারত হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হোকÑতা কামনা করতে পারেন। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের প্রশ্রয় এবং পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া থেকে তার এই আকাক্সক্ষার প্রকাশ ঘটছে। তার এই অব্যক্ত আকাক্সক্ষা কতটা বাস্তবায়ন হবে বা ভারতের সাধারণ মানুষ হতে দেবে কিনা, তাই এখন বিবেচনার বিষয় দাঁড়িয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে ভারতের যে চরিত্র, তা যদি অক্ষুন্ন থাকে তবে মোদীর গোপন এই খায়েশ হয়তো পূরণ হবে না।
চার.
ভারতে গরু নিয়ে যা হচ্ছে, তা সভ্য দুনিয়ায় কল্পনাও করা যায় না। অথচ মোদীর শাইনিং ইন্ডিয়ায় এমনই অন্ধকার যুগের বর্বরতা চলছে। ভারতের মতো ধর্ম নিয়ে উগ্রবাদী ও বৈষম্যমূলক রাজনীতি আধুনিক বিশ্বে বিরল। বিষয়টি যদি তার নিজ দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলেও একটা কথা থাকত। ভারতের মন্ত্রী থেকে শুরু করে বিজেপির নেতারা বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে প্রায়ই বক্তব্য-বিবৃতি এমনকি মিছিল পর্যন্ত করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তারা নিজ দেশে যেমন গরু জবাই বন্ধ করেছে, তেমনি বাংলাদেশেও গরু জবাই বন্ধের দাবি জানিয়েছে। ২০১৫ সালে মোদী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং তো বাংলাদেশের সীমান্তে এসে বিএসএফকে বাংলাদেশে গরু খাওয়া বন্ধ করার আহŸান জানান। এটা যে একটি স্বাধীন দেশের প্রতি চরম দৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ তা বলাই বাহুল্য। এ নিয়ে আমাদের সরকার তো বটেই দেশের তথাকথিত প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা কোনো প্রতিবাদ করেননি। অবশ্য গত রবিবার, গো-রক্ষা আন্দোলনের নামে মুসলিম হত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবাদ করা হয়। বক্তারা বলেন, এই সরকার দিল্লীর আশির্বাদপুষ্ট। বিরোধী দল এমনকি ইসলামপন্থী দলগুলোও ভারতের মুসলিম নিধনের ব্যাপারে চুপ রয়েছে। তারাও দিল্লীর আশির্বাদ নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। মুসলিন নিধন প্রতিরোধে এই ব্যর্থতা ক্ষমার অযোগ্য। গরু জবাই ও গরুর গোশত রাখা বা বহনের উসিলায় ভারতে মুসলমানদের উপর যে আক্রমণ চালানো হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে সে দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কিছুটা হলেও সোচ্চার হয়েছে। আমাদের দেশের শুভবুদ্ধির মানুষ তো তাদের সাথে সুর মিলিয়ে এর প্রতিবাদ করতে পারেন। এ কাজটুকুও তারা করছেন না। অন্যদিকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের উসিলা দিয়ে ভারতের বিভিন্ন সংগঠন বক্তব্য-বিবৃতি থেকে শুরু করে মিছিল নিয়ে সীমান্তে এসে প্রতিবাদ জানায়। ভারতে যে মুসলমানদের উপর যেখানে সেখানে আক্রমণ ও হত্যা করা হচ্ছে, এ ব্যাপারে আমাদের দেশের ইসলামপন্থী দল ও সংগঠনগুলো নিশ্চুপ রয়েছে। এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাইÑএ কথাটি যদি তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে থাকে, তবে তাদের নিশ্চুপ থাকা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। শুধু মুসলমান হিসেবে নয়, মানবতার খাতিরেও প্রতিবাদ করা উচিত।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।