Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

কল্পনা চাকমা নিখোঁজ এখনো রহস্যে ঘেরা

এ ইস্যুতে কেন্দ্র করে পার্বত্য অঞ্চল উত্তপ্ত করার পায়তার একটি একটি চক্র

| প্রকাশের সময় : ১২ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সাখাওয়াত হোসেন রাঙামাটি থেকে ফিরে : ২০ বছরের অধিক সময় ধরে কল্পনা চাকমার নিখোঁজ ইস্যুতে পার্বত্য অঞ্চলকে উত্তপ্ত করার চেষ্টা করছে একটি চক্র। আর এর ফায়দা লুটছেন স্বার্থান্বেষী একটি মহল। বিদেশিদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে তারা বিপুল পরিমান ফান্ড সংগ্রহ করছে। আর এসব অর্থ ব্যবহার করা হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলকে শান্ত করার চক্রান্তে এসম অভিযোগ করেছেন পাবর্ত্য অঞ্চলের সাধারন মানুষ।
কল্পনা চাকমা ইস্যু নিয়ে রাঙামাটির বিভিণœ শ্রেনী পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে যে, সভা-সমিতি,বক্তৃতা আর বিবৃতির মাধ্যমে বছরের পর বছর টিকিয়ে রাখা হচ্ছে এ ইস্যুটি। পাহাড়ি-বাঙালীর সৌহার্দ্যপুর্ন সম্পর্কের মাঝে এ ইস্যুতে ছড়ানো হচ্ছে ঘৃণার বিষবাষ্প। একইসঙ্গে দেশের অখন্ডতার ধারক-বাহক সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্নেরও চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে করে বাঙালী ও পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মধ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রতিবছর ১১ই জুন কল্পনা চাকমার নিখোজ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে উপজাতীয়দের কয়েকটি সংগঠন। ১৯৯৬ সালের এই দিনে কল্পনা চাকমাকে কেউ বলেন অপহরন করে গুম করা হয়েছে আবার কেউ বলেন স্বেচ্ছায় অন্তর্ধান হয়েছেন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মূলত কল্পনা চাকমাকে পুঁজি করে অনেকেই এখন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। তারাও আসলে কল্পনা চাকমার প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে জানতে চান। সরজমিনে রাঙামাটিতে কল্পনা চাকমা ইস্যু নিয়ে কথা বললে পাওয়া যায় নানা রকম তথ্য। কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল তা নিশ্চিত করতে পারেননি কেউই। তবে প্রতিটি তথ্যই প্রচার করা হচ্ছে নানা যুক্তি উপস্থাপন করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৬ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর সরকার সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আব্দুল জলিলকে সভাপতি করে তিন সদস্যর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি কল্পনা চাকমা নিজ ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক অপহ্নত হয়েছে বলে মতামত দেন। কিন্তু কার দ্বারা অপহ্নত হয়েছেন তা নির্নয় করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। এ প্রেক্ষিতে তারা কারও বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেনি। ১৯৯৭ সালের ১৭ই জানুয়ারি বাঘাইছড়ি থানার মামলাটি জেলার বিশেষ শাখায় হস্তান্তর করা হয়। এরপর ২০০৪ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর মামলাটি আবারও বাঘাইছড়ি থানা গ্রহণ করে দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে ২০১০ সালের ২১ শে মে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। সেখানেও মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা নিখোঁজ রহস্যের সঙ্গে সেনাবাহিনী বা অন্য কারো সম্পৃক্ততা খুঁজে পায়নি। মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা আদালতে নারাজী আবেদন করলে আদালত ২০১০ সালের ২রা সেপ্টেম্বর মামলাটি তদন্তে সিআইডির চট্রগ্রাম জোনকে নির্দেশ দেয়। সিআইডি দীর্ঘ ২ বছর তদন্ত করে ২০১২ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু কালিন্দী চাকমার তা মন:পুত না হওয়ায় তিনি আবারও নারাজী দেন। আদালত তার আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১৬ই জানুয়ারি রাঙামাটির পুলিশ সুপারকে তদন্তর ভার দিয়ে ৪ দফা নির্দেশনা দেয়। পুলিশ সুপার দীর্ঘ তদন্ত চালান। তদন্তর খাতিরে কল্পনা চাকমার দুই বড় ভাইয়ের ডিএনএ সংগ্রহের জন্য অনুমতি চাইলে আদালত ২০১৩ সালের ২২ শে ডিসেম্বর নমুনা সংগ্রহের আদেশ দেন। কিন্তু কালিন্দী কুমার চাকমা এবং লালবিহারি চাকমা (ক্ষুদিরাম) ডিএনএ দিতে রাজী হননি। তারা ২০১৪ সালের ৬ই মার্চ আদালতের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের আদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করেন। কিন্তু আদালত তার আদেশ বহাল রাখেন। পরে পুলিশ দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়েও কল্পনা চাকমার অপহরন সংক্রান্ত কোন তথ্য প্রমাণ এবং স্বাক্ষী পায়নি। এ প্রেক্ষিতে গত বছরের ১৫ই সেপ্টেম্বর মামলার কার্যক্রম বন্ধর জন্য আদালতে আবেদন করে। আবেদনটি এখন আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। এদিকে কল্পনা চাকমা ইস্যু নিয়ে কাজ করা একটি তদন্ত সংস্থা দৈনিক ইনকিলাবকে জানায়, ঘটনার তদন্তে পুলিশ কল্পনা চাকমার বাসায় গেলে তার ব্যবহার্য পোশাক থেকে শুরু করে বই-পুস্তক তেজসপত্র কিছুই খুঁজে পায়নি। এমনকি কল্পনা চাকমার মা বাধুনি চাকমা পর্যন্ত বলেছিলেন যে,কল্পিত অন্তর্ধানের পরও তার মেয়ে দু’বার তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালের ১লা আগষ্ট সে যোগাযোগ করেছিলো। কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনা নিয়ে মামলায় বলা হয়, ১৯৯৬ সালের ১১ জুনের দিবাগত রাত একটায় লেফটেন্যান্ট ফেরদৌসের নেতৃত্বে একদল সৈনিক কল্পনা চাকমাসহ তার দুই ভাইকে অপহরন করে। তার ভাইয়েরা পালিযে যেতে সক্ষম হলেও ২৩ বছর বয়সী কল্পনা চাকমাকে গুম করা হয়েছে। কালিন্দী কুমার চাকমা ঘটনার পরদিন ১২ই জুন বাঘাইছড়ি থানায় যে মামলা করে (মামলা নং-২/৯৬১,তারিখ-১২.০৬.১৯৯৬ ইং,ধারা-৩৪৬) সেখানে কিছু অপরিচিত লোকের কথা থাকলেও সেনাবাহিনী এবং গোলাগুলির কথা বলা হয়নি। অথচ বিশেষ মহলের ইন্ধনে ১৯৯৬ সালের ১৩ই জুন লালবিহারি চাকমা দাবি করে যে, রাতের আঁধারে কিংবা টর্চ লাইটের আলোয় লেফটেন্যান্ট ফেরদৌসসহ তিনজন সেনা সদস্যকে চিনতে পেরেছে। মামলায় এসব কথা যোগ করা হলে কয়েক দফা তদন্তে এর সত্যতা পায়নি সংশ্লিষ্ট তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
সংশ্লিষ্ট্র সূত্রে জানা গেছে, লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস ঘটনার দিন সকালে নির্বাচন উপলক্ষ্যে দায়িত্ব পালনের জন্য উগলছড়ি ক্যাম্পে আসেন। যা কল্পনা চাকমার বাড়ির কাছেই ছিলো। আর সেই ক্যাম্পে লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস একা নয়, ক্যা¤েপ তার উর্দ্ধতন কর্মকর্তা, একজন মেজরসহ আরও দুজন অফিসার এবং প্রায় ৯০ জন সৈনিক ছিলো। সেনাবাহিনীর সদস্যরা ছাড়াও নির্বাচন পরিচালনা কাজে নিয়োজিত প্রিজাইডিং অফিসার জ্ঞানময় চাকমা, পুলিশের সুবেদার ইদ্রিস আলীসহ ৬জন পুলিশ কনস্টেবল ওইদিন উগলছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালযে রাতযাপন করে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, এতজন লোকের মাঝে লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস কয়েকজন সৈনিক নিয়ে একটা অপহরনের ঘটনা ঘটালো, গোলাগুলি করলো অথচ কেউ গোলাগুলির শব্দ শুনেেলা না বা চিৎকার চেচামেচির শব্দ শুনলো না? অথচ কে না জানে পার্বত্য এলাকার রাতের নিস্তব্ধ নিরিবিলি পরিবেশে এ ধরণের শব্দ অনেকদূর পর্যন্ত শুনতে পাওয়ার কথা। বলা হয়, কল্পনা চাকমার ভাইদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছিলো। সেক্ষেত্রে কারও গায়ে গুলির আঁচড় পর্যন্ত নেই কেন?
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রশ্ন আসতে পারে, সেনা ক্যাম্পে বেশ কয়েকজন অফিসার থাকতে কেন লেফটেন্যান্ট ফেরদৌসকে নিয়ে এই অপপ্রচার। আসলে লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস এর ওপরে শান্তি বাহিনীর ক্ষোভ অনেক পুরনো। সে সময়ে বাঘাইছড়ি এলাকায় অনেকগুলো সফল অভিযানের নায়ক তিনি। একারনেই তার ওপরে প্রতিশোধ নিতেই এ অপহরন নাটকের দৃশ্যায়ন করা হয়।
রাঙামাটির ব্যবসায়ী হালিম মোহাম্মদ ও নিরুপম চাকমা বলেন, কল্পনা চাকমা ইস্যুতে বছরের পর লাভবান হচ্ছেন এমন পাহাড়ি সংগঠনগুলো সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ক্রমাগত অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে। এর ফলে পাবর্ত্য অঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়ি ও বাঙালীদের মধ্যে ক্রমে দূরত্বের সৃাষ্ট হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে পাহাড়ে শান্তি খোজে পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়বে বলে তারা মন্তব্য করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাঙামাটি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ