Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নজরুলের অনূদিত রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম

| প্রকাশের সময় : ২ জুন, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুসাফির নজরুল : বিচিত্র ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ওমর খৈয়াম (১০৪৮-১১২৩)-এর উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন বিষয়ক রচনাসমূহের মধ্যে রুবাইয়াৎও একটি। অষ্টাদশ ও উনবিশংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন ভাষায় তাঁর রুবাইয়াৎ প্রচার-প্রকাশ ও অনুবাদ শুরু হয়। আর এ রুবাইয়াৎ অনুবাদের কারণে উদার ও মুক্ত মনের মানব সম্প্রদায় ওমরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে এবং অনেক ক্ষেত্রেই অনেক অজানা তথ্যসমৃদ্ধ বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে সম্মক জ্ঞান লাভ করে। ওমর খৈয়ামের অনেক অজানা তথ্য ইউরোপের বিভিন্ন অনুবাদক ফারসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। বিশেষ করে ইংরেজিতে ফিটজেরাল্ড অসাধারণ অনুবাদ করেছেন।
বাংলা ভাষায় কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ছাড়াও কান্তি ঘোষ, ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯), নরেন দেব (১৮৮৮-১৯৭১), সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-১৯৭৪), সিকান্দার আবু জাফর (১৯১৯-১৯৭৫), শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ (১৯৩৪-১৯৯৫) অনেকে রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম অনুবাদ করেছেন। তবে কাজী নজরুল ইসলাম ফারসি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন, যা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে এক অপূর্ব ও অসাধারণ অবদান।
বাংলায় আর যারা রুবাইয়াৎয়ের অনুবাদ করেছেন তাদের চেয়ে কাজী নজরুল ইসলাম মূল কবির (ওমর খৈয়াম) দেশ ও কালের স্বাদ সঞ্চার করতে পেরেছিলেন বলে অধিক প্রশংসিত হয়েছে। আরবি-ফারসি শব্দের নিপুণ প্রয়োগ এবং তা মুসলিম সমাজে ব্যবহার ইতিপূর্বে তেমন দেখা যায় না। এর প্রচলন সম্পর্কে গবেষক শাহাবুদ্ধিন আহমদ লিখেছেন, ‘ফিটজেরান্ডের ধারণা ছিল, যুক্তিবাদী ওমর সুফী ছিলেন না, বরং ছিলেন নিয়তিবাদী। ওমরকে তিনি খুব চিন্তার মধ্যে অবস্থিত দেখেছেন, কিন্তু এই মতবাদ সবাই জানেননি। ফিটজেরাল্ড বলেছেন : ও ঈধহহড়ঃ ংবব ৎবধংড়হ ঃড় ধষঃবৎ সধু ড়ঢ়রহরড়হ অর্থাৎ ওমর যে ‘ঊঢ়রপঁৎবধহ’ তার এই মত পরিবর্তনের কোনো কারণ দেখেন না। এ দিক থেকে ওমরের সঙ্গে কাজী নজরুলের স্বভাবগত মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন ব্যাপার নয়। সমাজ জীবনে উত্তরের দৃষ্টিভঙ্গি রুবাইয়াৎ-এর অনুবাদ সম্পর্কে ভ‚মিকাংশে কাজী  নজরুল ইসলাম লিখেছেন : ‘ওমর খৈয়ামের ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে ফিটজেরাল্ডের কবিতায় যারা অনুবাদ করেছেন, তাঁরা সকলেই আমার চেয়ে শক্তিশালী ও বড় কবি। কাজেই তাঁদের মতো মিষ্টি শোনাবে না হয়তো আমার এ অনুবাদ। যদি না শোনায়, সে আমার শক্তির অভাব, সাধনার অভাব। কেননা, কাব্যলোকের গুলিস্তান থেকে সঙ্গীতালোকের রাগিনী দ্বীপে আমার দীপান্তর হয়ে গেছে।.... কাজেই আমার অক্ষমতার দরুন কেউ যেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ওমর খৈয়ামের ওপর চটে না যান। ওমরের রুবাইয়াৎ বা চতুষ্পদী কবিতা চতুষ্পদী হলেও তার চারটি পদই ছুটেছে আরবি ঘোড়ার মতো দৃপ্ত তেজে সমতালে ভন্ডামি, মিথ্যা বিশ্বাস, সংস্কার বিধি-নিষেধের পথে ধূলি উড়িয়ে তাদের বুক চ‚র্ণ করে। ওমরের বোররাক বা উচ্চেঃশ্রবাকে আমার মতো আনাড়ি সওয়ার যে বাগ মানাতে পারবে, সে ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে লাগাম কষে প্রাণপণ বাধা দিয়েছি, যাতে সে অন্য পথে না যায়। (কাজী নজরুল ইসলাম, ভূমিকা, রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম)।
আওলাদ হোসেন তাঁর ‘‘ওমর খৈয়াম : মর্মবাণী ও জীবন রহস্য গ্রন্থে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে বলেছেন, ‘কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী।’’ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ :
‘পৌঁছে দিও হযরতেরে খৈয়ামের হাজার সালাম
শ্রদ্ধাভরে বিজ্ঞাসিও তাঁরে লয়ে আমার নাম
বাদশা নবী কাজি খেতে নাই তো নিষেধ শরীয়তে
কি দোষ করল আঙুর পানি? করলে কেন তায় হারাম?’
(কাজী নজরুল ইসলাম)
ওমর খৈয়াম ছিলেন স্বাধীনচেতা, বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন কুসংস্কার, ভন্ডামি গোঁড়ামি ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। অপরদিকে কাজী নজরুল ইসলামও ছিলেন বিদ্রোহী কবি, মানবতার কবি, ভন্ডামি, গোঁড়ামি প্রতিবাদী। অপরদিকে কাজী নজরুল ইসলামও ছিলেন বিদ্রোহী কবি, মানবতার কবি, ভন্ডামি- গোঁড়ামি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী। এখানে একটি উদাহরণ দিলে তা আরো স্পষ্ট হবে :
‘নাস্তিক আর কাফের বলো তোমরা লয়ে আমার নাম
কুৎসা গøানির পঙ্কিল স্রোতে বহাও হেথা অবিশ্রাম।
অস্বীকার তা করব না যা ভুল করে যাই, কিন্তু ভাই
কুৎসিত এই গালি দিয়েই তোমরা পাবে স্বর্গধাম।’
(কাজী নজরুল ইসলাম)
রোমান্টিক মনোভাব এবং দার্শনিক মনোভাব মিলে ওমর খৈয়ামের চতুষ্পদী কবিতাগুলো অপূর্ব ক্যাব্যিক রসে পরিপূর্ণ করে তুলেছে। কবি ওমর এবং দার্শনিক ওমর তাঁর দু’টি সত্তাকে একত্রিত করেছেন এই গ্রন্থটিতে। কবিতা রচনা করেছেন এবং দার্শনিক ওমর এসে তাতে মত প্রকাশ করেছেন। তাই ওমর খৈয়ামের কবিতাগুলা গভীরভাবে উপলব্ধি করার মতো।
উপরের চতুষ্পদীটির প্রতি লক্ষ করলে স্পষ্ট বোঝা যাবে যে, কবি ওমর এখানে যুগিয়েছেন অপূর্ব শব্দের সমাহার এবং ছন্দ। অন্যদিকে দার্শনিক ওমর এসে তাতে প্রকাশ করেছেন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। আর এ জন্য প্রতিটি ‘রুবাই’ লাভ করেছেন  চরম সার্থকতা।
কেউ কেউ মনে করেন ভাবুক ও চিন্তাবিদ ওমর খৈয়াম অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যেই রুবাইগুলো রচনা করেন। রাজনীতিবিদ চার্চিল যেমন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় স্কেচ রচনায় হাত দিয়েছিলেন। ওমর খৈয়াম অবকাশ যাপনের সময় কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে অথবা যে কোনো কারণেই রুবাইসমূহ রচনা করেন না কেন তবুও এই রুবাইগুলোর মধ্যে ওমরের সুগভীর মুক্ত জ্ঞানবুদ্ধি ও মননশীল দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।
. (অসমাপ্ত)



 

Show all comments
  • হাশেম ১৩ নভেম্বর, ২০১৭, ৭:১৯ পিএম says : 0
    ওমর খৈয়াম অসাধারন কবি
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন