Inqilab Logo

শনিবার ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০১ রবিউল সানী ১৪৪৬ হিজরী

কৃষিনির্ভর অর্থনীতির ভিত দুর্বল হচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিমে

| প্রকাশের সময় : ৮ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বাজার ব্যবস্থাপনার অভাবে কৃষক পাচ্ছে না কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্য সুদের কারবারীরা অভাবকে পুঁজি করে গরীবকে করছে আরো গরীব


মিজানুর রহমান তোতা : গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণশক্তি কৃষির উন্নয়ন শক্তিশালী হচ্ছে না। কোন কোন ক্ষেত্রে বিরাজ করছে নাজুক অবস্থা। মাঠে মাঠে বিভিন্ন ফসলের সবুজের অপরূপ সৌন্দর্য তৈরী করার ধারক কর্মবীর কৃষক ফসল উৎপাদনে বিরাট সফলতা আনতে সক্ষম হলেও আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারছেন না। এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কোন কোন এলাকায় পাহাড়ি ঢল ও বøাস্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ায় বোরো উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পুরণ হয়নি। তাছাড়া সামগ্রিকভাবে বাজার ব্যবস্থাপনার অভাবে কৃষক পাচ্ছেন না কৃষিপণ্যের উপযুক্ত মূল্য। লাভবান হচ্ছেন কৃষকের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে উৎপাদিত ফসলে মধ্যস্বত্বভোগীরা। দিনে দিনে তারা অভাবগ্রস্ত ও দায়দেনায় জড়িয়ে পড়ছেন। ফলে দুর্বল হয়ে পড়ছে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির ভিত। এই চিত্র যশোর-খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের।
যশোর, খুলনা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মাগুরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের বক্তব্য, কৃষিনির্ভর অর্থনীতির ভিত দুর্বল হওয়ায় অস্থিরতার সৃষ্টি হচ্ছে। কৃষক হচ্ছেন হতাশাগ্রস্ত। কৃষিশ্রমিকরা বাধ্য হচ্ছেন পেশাবদল করতে। অর্থনীতিবিদরা এর জন্য ফসলের উপযুক্ত মূল্যপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা ছাড়াও সুদের কারবারী ও ক্রেডিট প্রোগ্রামের এনজিওদের অপতৎপরতাকে দায়ি করেছেন। কারণ এমন কোন গ্রাম খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে ক্রেডিট প্রোগ্রাম নেই। গরীব কৃষক ছাড়াও ক্ষুদে ব্যবসায়ী, দোকানী ও স্বল্প আয়ের মানুষকে ঋণ দিয়ে সুদের কারবারীরা অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে। তারা গরীবকে আরো গরীব করে দিচ্ছে। ব্যাঙের ছাতার মতো প্রতিটি গ্রাম এমনকি পাড়া মহল্লায় গজিয়ে উঠেছে এনজিও কিংবা বিভিন্ন নামের সুদের কারবারী। যাদের কারো রেজিস্ট্রেশন আছে, কারো নেই। তার উপর রয়েছে মহাজনী সুদ ব্যবসা। শুধু কৃষক নন, গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার এবং খেটে খাওয়া মানুষের কথা, অনেক জমিজমা আছে কিংবা বিদেশে রয়েছেন এমন কেউ কেউ আর্থিকভাবে ভালো আছেন এটি সত্য কিন্তু সিংহভাগই মানুষই আর্থিক কষ্টে রয়েছেন। তারা চোখেমুখে ঘোর অন্ধকার।
কৃষি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতি বিশারদগণ বলছেন, কৃষিখাতে সরকারের বহুমুখী পদক্ষেপে দেশে কৃষিজাত আয় বৃদ্ধির সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কৃষিতে আসছে শতভাগ সাফল্যও। সরকারের নির্দেশনাও আছে কৃষিনির্ভর তৃণমূল অর্থনীতির কাঠামো মজবুত করার। কিন্তু বাস্তবে কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের সকল কর্মকর্তা একযোগে আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হওয়া এবং সমন্বয়ের অভাবে কৃষকের সার্বিক স্বার্থ সংরক্ষিত হচ্ছে না বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া গ্রামে গ্রামে এনজিও ঋণ ও সুদের কারবারীদের যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ। অবাবকে পুজি করে তারা ব্যবসা করছে। অথচ দেখার কেউ নেই। যশোরের শার্শার ডিহি ইউনিয়নের শালকোনা গ্রামের কৃষক মোঃ আলম বললেন, কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বাস্তবে সহজ সরল কৃষকের সমস্যা কোথায়, সমাধানের পথ কি, ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন কিনা, না পেলে কি কারণে, দায়দেনা করে সর্বস্বান্ত হচ্ছে কিনা-সেসবের খোঁজ খবর কেউই রাখে না। এসব কারণে কৃষক দিনে দিনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সবচেয়ে ক্ষতি করছে সুদে ঋণ। সুদ হিসেবে টাকায় টাকা, ধান, পাটসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য কিংবা জমি লিখে দেওয়ার ঘটনা রয়েছে অসংখ্য। চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ বাড়তে বাড়তে জমিজমা হারানোর সংখ্যা বাড়ছে। কয়েকজন কৃষক জানালেন, তাদের কোন সংগঠন নেই যে দাবি আদায়ে সোচ্চার হবেন। তারা আক্ষেপ করে বললেন, সুইপার, কুলি মুটে মুজুর রিকশা ও ভ্যান চালকদের সংগঠন আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য কৃষকের স্বার্থে কথা বলার মতো কিংবা দাবি আদায়ের সত্যিকারার্থে কেউ নেই। রাজনৈতিক নেতারা বলেন, কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণ ও জনকল্যাণের কথা, কিন্তু আসলে কি সব রাজনৈতিক নেতা সমানতালে ভুমিকা রাখেন? বোরো ধানে বøাস্ট রোগ দেখা দিল, কৃষি কর্মকর্তারা আগে ও পরে কোন ভুমিকা রাখেননি। এতে কৃষকের লোকসান হয়েছে। অনেক জমির ধান চিটা হয়েছে, অসময়ের বৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে। শুধু ধানের ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না-এ অভিযোগ অধিকাংশ কৃষকের। সারের ক্ষেত্রে ডিলার আছে, ব্যবসা করছে, কৃষক পাচ্ছেন না সুবিধা।
ঝিনাইদহের ইরফান আলী, খুলনার কপিলমুনির আব্দুল কুদ্দুস ও যশোরের বাবুল আকতারসহ বেশ কয়েকজন কৃষক অভিযোগ করলেন, ‘আমরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করি, দেখি স্বপ্ন, কিন্তু প্রতিবার কমবেশী লোকসান হয় নানা কারণে। আমরা খেটে মরে যায় আর বসে বসে মধু খায় মধ্যস্বত্বভোগীরা।’
কৃষির সামগ্রিক উন্নয়নে কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণ ও সুখ-দুঃখের ভাগিদার হওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তা ও বাজার কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের অমনোযোগিতা কৃষকদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে। কৃষি বিশেষজ্ঞ ও অথনীতিবিদদের কথা, খাদ্যে উদ্বৃত্ত অঞ্চল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কৃষিতে বিপ্লব ঘটানোর সুযোগ ছিল। নিত্যনতুন প্রযুক্তি ও গবিষণার ফসল মাঠে পৌঁছে দিয়ে কৃষিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নেয়ার উপয্ক্তু পরিবেশও বিদ্যমান। অথচ কৃষিখাতটি পিছিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির ভিত দুর্বল হওয়াটা অশনীসংকেত। গ্রামগঞ্জে কৃষির অর্থনীতির উপরই নির্ভরশীল সিংহভাগ মানুষ। শুধুমাত্র কৃষিপণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে না উঠায় কৃষকদের হতাশা বাসা বাঁধছে। প্রতিটি আবাদ মৌসুমে উৎপাদক চাষী সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী, মুনাফালোভী ও আড়তদারদের হাতে জিম্মি থাকেন। ফসলের বাম্পার ফলনের সুবিধা চাষী ও ভোক্তাদের চেয়ে তুলনামুলকভাবে বেশী পায় সিন্ডিকেট চক্র। এসব বিষয়ে জরুরিভাবে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে আরো খারাপের দিকে যাবে সার্বিক কৃষিনির্ভর অর্থনীতি-এই আশংকা কৃষি বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদের।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দক্ষিণ-পশ্চিম

৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭
২৮ আগস্ট, ২০১৭

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ