শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
আশরাফ পিন্টু : একজন তরুণ লেখক। কিছু লিখতে চায় সে। কিন্তু কোথাও কাহিনি খুঁজে পায় না। যে কাহিনী সে লিখতে চায় তা যেন পূর্ববতী লেখকদের কাহিনির সাথে মিলে যায়। গতানুগতিক হয়ে পড়ে তার গল্পের কাহিনি। সে চায় নতুন কিছু লিখতে; আনতে চায় কাহিনীতে স্বকীয়তা। কিন্তু কোথায় সেই কাহিনি...?
সে প্রথমে গ্রামের মেঠো পথে হাঁটা দেয়। এখানে নাকি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সবুজ-নিটোল মনোরম সব কাহিনি। সে প্রথমে বটবৃক্ষের কাছে যায়। বটবৃক্ষকে বলে কাহিনির খোঁজ দিতেÑ যে কাহিনি হবে সম্পূর্ণ নতুন, কারো গল্প উপন্যাসের সাথে সে কাহিনির কোনো মিল থাকবে না।
বটবৃক্ষ শান্তভাবে বলে, আমি তো নিশ্চল স্থবির অক্ষম এক জীব। আমার জীবনের কাহিনিতে তো কোনো বৈচিত্র্য নেই; পথিক আমার সুশীতল ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত হয়ে। আবার সেই পথিকই যাবার সময় আমার ডাল ভেঙে নিয়ে যায়। এ কাহিনি তোমার ভালো লাগবে না জানি। কারণ এতে কোনো নতুনত্ব নেই। তার চেয়ে তুমি মানুষের কাছেই ফিরে যাও। সেখানেই পাবে তুমি বৈচিত্র্যময় অনেক কাহিনী।
কিন্তু লেখক মানুষের কাহিনি লিখতে চায় না। লেখক চায় প্রকৃতির কাহিনি- যেখানে পাওয়া যেতে পারে নতুনত্ব। লেখক বটবৃক্ষের কাছে থেকে বিমুখ হয়ে নদীর কাছে যায়।
নদী বলে, মানুষের মতো আমার চলৎশক্তি আছে, আছে গতিশীলতা। কিন্তু আমার কাহিনি তোমাকে তেমন বৈচিত্র্য দিতে পারবে না। আমার পানি তোমরা অর্থাৎ মানুষেরা নানা কাজে ব্যবহার করো, জমিতে ফসল ফলাও; তোমাদের জীবন বাঁচে সে ফসল খেয়ে। আবার সেই পানিকেই তোমরা দূষিত করো। মরণ ডেকে আনো সবার। তাই বহু বুদ্ধিমান মানুষের কাছেই তুমি ফিরে যাও। সেখানেই পাবে তুমি ভালো-মন্দ অনেক বৈচিত্র্যময় কাহিনি।
তবুও তরুণ লেখক মানুষের কাছে যায় না। মানুষের প্রতি বিতৃষ্ণ এ লেখক প্রকৃতির মাঝেই খুঁজে পেতে চায় বৈচিত্র্যময় কাহিনি। লেখক ধীরে ধীরে সূর্যের কাছে যায়। অনেক প্রতিকুলতার মধ্যদিয়ে সে সূর্যের কাছে পৌঁছে।
সূর্য তাকে পেয়ে খুব বাহবা দেয়। তার অভিনব চিন্তার কথা শুনে কিছুটা অবাকও হয়। সূর্য তেজোদ্দীপ্ত স্বরে বলে, আমার তেজের জন্যেই মানুষ আমার ধারের কাছে ঘেঁষতে পারে না। আমার ক্ষতি করতেও ভয় পায়। কারণ আজকাল তেজেরই জয়-জয়াকার। তোমাকে আমি দুটো পথ দেখিয়ে দিতে পারি। প্রথমত, তুমি আমার তেজ নিয়ে লিখতে পারো। একটু চিন্তা করে পুনরায় সূর্য বলে, কিন্তু এ লেখাও হবে গতানুগতিক- ক্ষণস্থায়ী। কেননা এমন তেজোদ্দীপ্ত লেখা ইতোপূর্বে অনেক কবি-সাহিত্যিক লিখে গেছেন।
সূর্য কিছুক্ষণ থেমে দম নেয়। তারপর শান্ত স্বরে বলে, আমার যেমন তেজ আছে তেমনি আছে স্নিগ্ধ মায়াময় বর্ণালি রং। তুমি এই বর্ণালি রঙে মন রাঙিয়ে লিখতে পারো। আর এটাই তোমার জন্য হবে উত্তম পন্থা।
লেখক পরিশেষে পাহাড়ের কাছে যায়। পাহাড় সব শুনে ধীর-স্থিরভাবে বলে আমিও তোমাকে তেমন কোনো নতুন কাহিনি দিতে পারব না। আমার বিশাল দেহ থেকে তোমরা অর্থাৎ মানুষেরা মাটি কেটে নাও; এতে আমার তেমন ক্ষতি না হলেও ভবিষ্যতের জন্যে তোমরাই ক্ষতির দিকে ধাবিত হচ্ছো। তবে তোমাকে আমি একটা উপদেশ দিতে পারি- তুমি আমার মতো ভাবুক হও। বটবৃক্ষের মতো পরোপকারী হও. সূর্যের বিভিন্ন বর্ণালির রঙে মন রাঙিয়ে নদীর স্রোতের মতো কল্পনার গতি বাড়িয়ে দাও। তবে শুধু কল্পনা নয়, এর সঙ্গে বাস্তবতারও প্রয়োজন আছে। আর এ জন্যে তোমাকে শহরে যেতে হবে। সেখান থেকে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করো এবং এসব কাছে লাগিয়ে তুমি তখন হয়ত নতুন কোনো কাহিনি লিখতে পারবে।
পাহাড়ের কথায় লেখক শহরে আসে। রাজপথ দিয়ে হাঁটতে থাকে বাস্তব কাহিনির খোঁজে; যাকে কল্পনার রং লাগিয়ে তৈরি করবে নতুন কাহিনি। লেখক নিমগ্ন চিত্তে হাঁটতে থাকে, হাঁটতে থাকে...। মাঝে-মধ্যে চারপাশের দৃশ্যাবলীও দেখে চোখ তুলে - যা থেকে...।
চলার পথে পিছন থেকে একটি ট্রাক এসে আচমকা লেখককে পিষে দিয়ে চলে যায়। মাথা থেকে গলিত মগজ বের হয়ে পড়ে । লেখকের আর কাহিনি লেখা হয় না। হয় না নতুন গল্প লেখা।
তবে একটা নতুন কাহিনির সৃষ্টি হয় লেখকের মৃত্যুর পর; যে কাহিনি সে লিখে যেতে পারেনি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।