Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রবীন্দ্র-নজরুলের বোশেখ বর্ণনা

| প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ড. গুলশান আরা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনার বৈশিষ্ট্য, বৈচিত্র্য এবং সংখ্যা বিস্ময়কর। মানুষ ও বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে নিগূঢ় সম্পর্কের যে চিরবন্ধন নানাভাবে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রসৃষ্টিশেলে। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত জীবনসাধনার মূলে প্রকৃতি বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রকৃতি এবং ষড়ঋতু বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। ঋতুবৈচিত্র্যের লীলায় বর্ষা তাকে প্রচন্ডভাবে আলোড়িত-আন্দোলিত করলেও অন্যান্য ঋতুও তার অনুভবে নাড়া দিয়েছিল আপন শুষমায়। এ প্রসঙ্গে ঋতুচক্রের প্রথম ঋতু গ্রীষ্ম কিভাবে তার মানসচেতনাকে সমৃদ্ধ করেছে তা আলোচনা করে দেখা যেতে পারে।
বাংলা সন বা সালের প্রথম মাস বৈশাখ। বিশাখা নক্ষত্রের নাম অনুসরণে বৈশাখ। বৈশাখ আবার রবীন্দ্রনাথের জন্মমাস। স্বাভাবিকভাবেই এ মাসের প্রতি তিনি দুর্বল। এই দুর্বলতায় বৈশাখকে নানাভাবে নানা প্রসঙ্গে মূর্ত করে তুলেছেন তার সৃষ্টি সম্ভারেÑ বৈশাখ বর্ণনা ঋদ্ধ করেছে রবীন্দ্র সাহিত্য।
আজকের দিনে পহেলা বৈশাখের সূচনা সংগীত হিসাবে যে গানটিকে অবধারিত হিসেবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে তা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের লেখা- ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’। এটি ছাড়া বর্ষবরণ যেন সম্পূর্ণই হয় না। তাছাড়া গ্রীষ্মের একটি অতি চমৎকার এবং অতিবাস্তব চিত্র তিনি এ গানখানিতে তুলে ধরেছেনÑ শ্রোতা শোনার সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে যেন দেখতে পান বৈশাখের রুদ্ররূপÑ
‘তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক \...
মুছে যাক গøানি, ঘুচে যাক জরা
অগ্নি¯œানে শুচি হোক ধরা।’
আরেকটি গানে দেখা যায় বৈশাখের প্রচÐতাকে তিনি নমস্কার জানাচ্ছেনÑ
নমো নমো, হে বৈরাগী।
তপোবহ্নির শিখা জ্বালো জ্বালো
নির্বাণহীন নির্মল আলো
অন্তরে থাক জাগি \
বৈশাখের খরবায়ের মধ্যদিনে যখন পাখির গান বন্ধ হয়ে যায় তখন রাখাল বালককে কবি অনুরোধ করছেনÑ
‘মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি,
হে রাখাল, বেনু তব বাজাও একাকী \...
সহসা উচ্ছ¡সি উঠে ভরিয়া আকাশ
তৃষাতপ্ত বিরহের নিরুদ্ধ নিশ্বাস।
অম্বর প্রান্তে যে দূরে ডম্বরু গম্ভীর সুরে
জাগায় বিদ্যুতছন্দে আসন্ন বৈশাখী
হে রাখাল, বেনু যবে বাজাও একাকাী \’
বৈশাখের ঝড়-ঝঞ্ঝায় ভীত না হতেও তার আহŸানÑ
‘ওই বুঝি কাল বেশাখী
সন্ধ্যাÑ আকাশ দেয় ঢাকি।
ভয় কীরে তোর ভয় কারে, দ্বার খুলে দিস চার ধারেÑ...
যা নড়ে তায় দিক নেড়ে, যা যাবে তা যাক ছেড়ে,
যা ভাঙা তাই ভাঙবে রে যা রবে তাই থাক বাকি \’
কবির দৃষ্টিতে বৈশাখ শুধু ধ্বংসই করে না- তার ছন্দে তিনি শুনতে পান প্রিয়ার চরণের ছন্দÑ
‘বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া আসে মৃদু মন্দ।
আনে আমার মনের কোণে সেই চরণের ছন্দ \...
বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া বহে কিসের হর্ষ
যেন রে সেই উড়ে-পড়া এলোকেশের স্পর্শ \’
বৈশাখ যেন কোন অতলের বাণী শুনিয়ে যায় বিশ্বের কানে কানে, সৃষ্টির আনন্দে পৃথিবী হয় আত্মহারাÑ
‘বৈশাখ হে, মৌনী তাপস, কোন্্ অতলের বাণী
এমন কোথায় খুঁজে পেলে।
তপ্তভালের দীপ্তি ঢাকি মন্থর মেঘখানি
এল গভীর ছায়া ফেলে \’
হঠাৎ তোমার কণ্ঠে এ যে আশার ভাষা উঠল বেজে,
দিলে তরুণ শ্যামলরূপে করুণ সুধা ঢেলে \’
শুধু সংগীতেই নয়Ñ গল্প, কবিতা, উপন্যাস সমস্ত সৃষ্টিকর্মে বৈশাখকে এনেছেন রবীন্দ্রনাথÑ ‘বলাকা’ কবিতায় যখন তিনি বলেনÑ ‘পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ’, তখন বৈশাখ আমাদের কাছে উপস্থাপিত হয় ‘বেগের আবেগে’। অচিন্ত্যনীয়- অদৃশ্য এক গতি আমাদের অনুভূতিতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। আমরা অনুভব করি সেই বেগের আবেগেই পৃথিবী গতিময় হয়েছে, গতিময় হয়েছে পৃথিবীর প্রতিটি অণু-পরমাণু।
একবার তিনি লিখেছেনÑ ‘নব জীবনের দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ।’
তাকেই আবার বলতে শুনিÑ
পঁচিশে বৈশাখ চলেছে
জন্মদিনের ধারাকে বহন ক’রে
মৃত্যুদিনের দিকে।
এ তো গেল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বৈশাখ ভাবনা নিয়ে সামান্যতম কথা। এবার দেখা যাক আমাদের জাতীয় কবি, মহান কবি কাজী নজরুল ইসলাম কতখানি ভেবেছেন বৈশাখকে নিয়ে।
এ কথা সর্বজনবিদিত যে বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম এক বিস্ময়কর প্রতিভার নাম। ভাব-ভাষা, অভিনব সুর ব্যঞ্জনা এবং বিচিত্র শব্দ চয়নে তিনি বাংলা সাহিত্যে যোগ করেছেন নতুন মাত্রা। নজরুলকাব্য আলোচনা করলে দেখা যায় বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক অনুষঙ্গের মধ্যে ঝড় বিশেষ করে বৈশাখের কালবৈশাখী তার প্রিয় প্রসঙ্গের মধ্যে অন্যতম। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নি-বীণার’ উৎসর্গ পত্রে ‘দুর্বাসা হে! রুদ্র তড়িৎ হানছিলে বৈশাখে’Ñ থেকে শুরু করে প্রথম কবিতা ‘প্রলয়োল্লাস’, বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী, ‘রক্তাম্বর ধারিণী মা’তে ঝড় এসেছে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায়।
‘প্রলয়োল্লাসে’ ‘বজ্র শিখার মশাল জ্বেলে’ যে ভয়ঙ্কর আসছে তাকে দেখে ভয় না পেয়ে সেই ‘কালবোশেখীর’ জন্য জয়ধ্বনি করতে বলেছেন, কেন না ‘ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির-সুন্দর’। তাই কবির আহŸানÑ ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়।’ ...
কবি দেখতে পাচ্ছেন-
‘ঐ যে মহাকাল সারথি রক্ত তড়িৎ চাবুক হানে,
রণিয়ে ওঠে হ্রেষার কাঁদন ব্রজ-গানে ঝড়-তুফানে!’
কিন্তু তাতে আফসোস নাই বরং কবি আমাদের জানাচ্ছেন-
‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? প্রলয় নূতন সৃজন-বেদন।
আসছে নবীন, জীবন-হারা অসুন্দরে করতে ছেদন!...
কাল ভয়ঙ্করের বেশে আবার ঐ আসে সুন্দর।-
নজরুল রচিত বৈশাখী পঙ্ক্তিমালা বাংলা সাহিত্যে অনন্য সংযোজন। বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’তে নিজেকে উল্লেখ করেছেন- ‘মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস।’ বৈশাখী ঝড় আসে দুর্বার গতিতে, নিজেকে সেই গতির সঙ্গে তুলনা করেছেন এভাবে-
‘আমি ঝঞ্ঝা আমি ঘূর্ণি
আমি পথ সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি।’
বিদ্রোহাত্মক কবিতাগুচ্ছ নজরুলকে সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত করেছেÑ জনপ্রিয় করেছে। অবশ্য এর কারণও আছে- সমসাময়িক বাঙালি মানসে যে অস্বস্তি যে অশান্তি বিরাজ করছিল তা যথাযথভাবে ফুটে উঠেছিল তার লেখায়। এর প্রভাবে ঝিমধরা সমাজে নবজাগরণ এলো- মানুষ আলস্য ত্যাগ করে নড়েচড়ে বসলো। নজরুলের কথার বা বাণীর প্রতিফলন নিজের মধ্যে প্রত্যক্ষ করে তরুণরাও অনুভব করলো-
‘ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
স্বর্গ মর্ত্য করতলে।’
পুরো ‘আগমনী’ কবিতাটিই যেন ঝড়ের ছন্দে লেখা। ঝড়ের নৃত্যপাগল দাপট এর পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে রণবাদ্যের তাল তুলেছে- ‘আগমনী’তে ঝড় প্রসঙ্গও এসেছে দারুণ দাপটে-
‘ওঠে ঝঞ্চা ঝাপটি দাপটি সাপটি
হু- হু- হু- হু- হু- হু শন শন।’
‘রণ-ভেরী’ কবিতায় নজরুল মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দেন মুসলমানের কাছে জানের চেয়ে মানসম্মান অনেক বড়। আর তখনি তার মনে আসে ঝড়-ঝঞ্ঝার উপমা- তিনি ঝঞ্ঝার সাথে মুসলিম পাঞ্জার শক্তির তুলনা করে লেখেন-
‘ধরি ঝঞ্ঝার ঝুঁটি দাপটিয়া শুধু মুসলিম পাঞ্জায়
ঝন-নন-নন-রণ-ঝন-ঝন-ঝঞ্ঝনা শোনা যায়।’
‘কিয়ামত’ রাত্রির বর্ণনায় ঝড়-ঝঞ্ঝা-প্রলয় বিভিন্ন ব্যঞ্জনায় এসে খেয়া পাড়ের তরণী’ কবিতায়-
প্রলয়েরি আহŸান ধরিল কে বিষাণে?
ঝঞ্ঝা ও ঘন দেয়া স্বনিলরে ঈশানে।’
নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ বিদ্রোহের, ‘দোলন-চাঁপা’ প্রেমের কাব্য। মহৎ কবি নজরুল প্রেমের কবিতায় ঝড় তুলেছেন নব ব্যঞ্জনায়। প্রেমিকার কাছে প্রেমিকের আগমন ঝড়ের মতন- দমকা বাতাস যেমন জানান দেয় ঝড় এসেছে, তেমনি প্রেমিকার মনে প্রশ্ন- ‘ওকে খোলে দুয়ার মাগো? ঝড় বুঝি মা তারই মত ধাক্কা মারে?’
নজরুলের বিখ্যাত প্রেমের কবিতা ‘পূজারিণী’। পূজারী প্রেমিক যখন বারবার-পূজারিণী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেÑ হচ্ছে বেদনার্ত, আশাহত এখন তার সেই বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখা দিলেন সর্বকালের, সর্বংসহা সেরা আশ্রয়স্থল মুক্তধারা মা। ক্ষণিকের জন্য হলেও মা ভুলিয়ে দিলেন যন্ত্রণা কাতরতা- ‘এরি মাঝে কোথা হতে ভেসে এল মুক্তধারা মা আমার
সে ঝড়ের রাতে....
প্রিয়াকে অভিশাপ দিতেও নজরুল ব্যবহার করেছেন ঝড়ের উপমা-
‘আসবে ঝড়, নাচবে তুফান, টুটবে সকল বন্ধন,
কাঁপবে কুটির সেদিন ত্রাসে, জাগবে বুকে ক্রন্দন
টুটবে সকল বন্ধন
বুঝবে সেদিন বুঝবে।’
নজরুল ঝড়ের দাপট ছড়িয়ে দিয়েছেন জীবনের পরতে পরতে। তার মতে, প্রকৃতি ও জীবনে ঝড়ের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। দু’চারখানা ঘর ঝড়ে উড়ে যাবে বলে- ঝড়ের তান্ডব সৌন্দর্য আসবে না? ঝড়ের তান্ডব নজরুলের লেখনীতে উঠে এসেছে প্রলয়, সুন্দর রূপে, প্রবর্তকের দ্যোতনায়-
বৈশাখী ঝড় সুর হাঁকায়
প্রবর্তকের ঘুর চাকায়...
গর্জে ঘোর
ঝড় তুফান
আয় কঠোর
বর্তমান।’
সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গতির বেগ আনায়নে তিনি বৈশাখী ঝড়ের তাÐব কামনা করেন। আগেই উল্লেখিত হয়েছে, ঝড় নজরুলের প্রিয় প্রসঙ্গের একটি। ‘ঝড়’ নামে কবিতা লিখেছেন, ‘ঝড়’ তার কাব্যের নাম, ‘ঝড়োগান’ কবিতার শিরোনাম। কীর্তন ঢঙে লেখাÑ এ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
‘আমি সাইক্লোন আর তুফান
আমি দামোদরের বান
খোশ-খেয়ালে উড়াই ঢাকা
ডুবাই বর্ধমান।’
নিজের চেয়েও ভালবাসতেন গান। তার গানেও এসেছে ঝড়-
১। কে দুরন্ত বাজাও ঝড়ের ব্যাকুল বাঁশি।
২। বেনুকা কে বাজায় মহুয়া বনে
কেন ঝড় তোলে তার সুর আমার মনে।
৩। দীপ নিভিয়াছে ঝড়ে জেগে আছে মোর আঁখি।
৪। বৈশাখী ঝড়ে রাতে চমকিয়া উঠি জেগে
বুঝি অশান্ত মন আসিলে ঝড়ের বেগে
ঝড় চলে যায় কেঁদে ঢালিয়া শ্রাবণধারা
সেকি তুমি, সেকি তুমি?
নিজের জন্মক্ষণে উঠেছিল ঝড় সেই ঝড়ের খবর জানাচ্ছেন ‘আমার জন্মক্ষণে উঠেছিল ঝঞ্ঝা তুফানঘোর/ উড়ে গিয়েছিল ঘরের ছাদ ও ভেঙে ছিল গৃহদ্বার।’ তিনি মনে করেন ঐ ঝড়ের প্রভাব সারাজীবন বহন করে ফিরেছেন। সমগ্র নজরুল সাহিত্যেই ঝড়ের তান্ডবে আলোড়িত। তচনচ করে দেয় সৃষ্টি আনন্দে। কবিও সৃষ্টি-শীলতায় বিশ্বাসী-
‘ভুল করে যদি এসে থাকি ঝড়, ছিড়িয়া থাকি মুকুল,
আমার বরষা ফুটায়েছে তার অনেক অধিক ফুল।’



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন