Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আগামী জাতীয় নির্বাচন কি যথাযথভাবে হবে?

| প্রকাশের সময় : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কামরুল হাসান দর্পণ  : ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে একাদশ জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে এর আগেও চমক হিসেবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। চমকটি নির্ভর করছে পুরোপুরি ক্ষমতাসীন দল ও মহলের ওপর। তারা জাতিকে চমকে দিয়ে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিতে পারে। এ ধরনের কানাঘুষা রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুদিন ধরে রয়েছে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা প্রায়ই বলেন, ২০১৯ সালের জানুয়ারির এক দিন আগেও নির্বাচন হবে না। তাদের ঘোষণাই এখন পর্যন্ত সলিড মনে হচ্ছে। নির্বাচন যথাসময়ে হোক বা আগাম হোকÑ নির্বাচনের একটা ঢামাঢোল যে উঠেছে, তা বোঝা যায়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রস্তুতির তোড়জোড় থেকে তা আঁচ করা যাচ্ছে। গত বছর থেকেই দলটি সাংগঠনিক প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে একাধিকবার নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নেতা-কর্মী এবং মন্ত্রী-এমপিদের এলাকায় গিয়ে কাজ করার কথা বলেছেন। দেশের বৃহত্তম বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপিও বিভিন্ন সময়ে বলেছে, সে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও তার নির্বাচনী প্রস্তুতি কীভাবে নেয়া হচ্ছে, তা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। অনেকে বলেন, বিএনপি ভেতরে ভেতরে সাংগঠনিক কাজ গোছাচ্ছে এবং প্রস্তুতি নিচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তার প্রস্তুতি নিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। বেগ পেতে হবে না কেন? ক্ষমতাসীন দল তাকে যেভাবে জালের মধ্যে আটকে ফেলেছে এবং নেতা-কর্মীদের দৌড়ের ওপর রেখেছে, তাতে গুছিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া কষ্টকরই বটে। তার মতো পরিস্থিতিতে যদি আওয়ামী লীগও পড়ত, তাহলে হয়তো একই পরিস্থিতি হতো। অবশ্য তার মতো এমন ছন্নছাড়া পরিস্থিতি আওয়ামী লীগ হতে দিত কিনা, তা নিয়ে অনেকে সন্দেহ পোষণ করে। কারণ রাজনীতির ক্ষেত্রে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ অনেক অভিজ্ঞ এবং বয়স্ক একটি দল। তার আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস পুরনো এবং কীভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়, তা ভালো করেই জানে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপি সরকার কর্তৃক ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচন সে ঠিকই ঠেকিয়ে দিয়েছিল, যা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ ও তার জোটের একতরফা এবং ভোটারবিহীন নির্বাচন বিএনপি ও তার জোট ঠেকাতে পারেনি। লাগাতার তিন মাস আন্দোলন করেও সে ব্যর্থ হয়। এখানেই দুই দলের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার পার্থক্যটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কেন ঠেকাতে পারেনি, তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা রয়েছে। বিএনপি নেতারা বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আওয়ামী লীগ ঠেঙ্গাড়ে বাহিনীতে পরিণত করে তাদের প্রতিহত করতে মাঠে নামিয়ে দেয়। এর ফলে তারা মাঠে নামতে পারেননি। তবে মানুষ দেখেছে, তাদের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের একজনকেও মাঠে দেখা যায়নি। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া মাঠে নামতে চাইলেও তাকে সরকার ইট-বালুর ট্রাক দিয়ে অনেকটা বন্দি করে রেখেছিল। সরকার আন্দোলন দমনে কঠোর হবে, এটা স্বাভাবিক। কোনো সরকারই আন্দোলনকারী দলের প্রতি নমনীয় হয় না। আন্দোলনকারী দলকে সরকারকে নমনীয় হতে বাধ্য করতে হয়। এটাই আমাদের দেশের রাজনীতির ধারা। সরকার কখনই বিরোধী দলকে মাঠ ফাঁকা করে আন্দোলন করতে দেয়নি। বিরোধী দলকে মাঠ ফাঁকা করে নিতে হয়। এ কাজটি বিএনপি ও তার জোট করতে পারেনি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। বিএনপিকে আন্দোলনে পরাজিত হতে হয়েছে। আর ইতিহাস সবসময়ই বিজয়ীর পক্ষে কথা বলে। পরাজিতের কথা তুচ্ছ হয়েই পড়ে থাকে। বরং পরাজিতের ললাটে বিভিন্ন ধরনের অপবাদ জোটে। যত ভুল এসে সামনে দাঁড়ায়। এমন করলে এই হতো, এমন করা উচিত ছিলÑ এ ধরনের নানা উপদেশমূলক বক্তব্য ও বিশ্লেষণ শুরু হয়। ৫ জানুয়ারির পর বিএনপি ও তার জোটের কপালে তাই জুটেছে। উল্টো অপবাদ নিতে হয়েছে বোমা মেরে মানুষ মারার। মারাত্মক এক অপবাদ। এ অপবাদ তাকে এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
দুই.
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগের দৃশ্যপট যদি আমরা বিবেচনা করি তাহলে দেখব, সে সময়ের সংসদের বিরোধী দল বিএনপি ও তার জোটের আন্দোলনে বিচলিত হয়ে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল, ঐকমত্যের সরকারে যোগ দিতে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ যে কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। বিএনপি ও তার জোট তা নাকচ করে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলন কী হয়েছে, তা আমরা সকলে জানি। আন্দোলনে ব্যর্থতার পর বিএনপির ওপর দিয়ে যে সুনামি বইয়ে দেয়া হয়েছে, তাও আমরা জানি এবং এ সুনামি এখনও বয়ে চলেছে। দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ারই এখন জেলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জার্মানিতে এক সভায় বলেই দিয়েছেন, দোষী প্রমাণিত হলে খালেদা জিয়ার শাস্তি হবেই। তাহলে পরিস্থিতি যা তাতে অনুধাবন করা যাচ্ছে, দোষী প্রমাণিত হলে তিনি আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন। অর্থাৎ খালেদা জিয়াবিহীন একটি নির্বাচন হতে পারে। দোষী প্রমাণিত না হলে তো কথাই নেই। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, খালেদা জিয়াবিহীন একটি নির্বাচন কেমন হবে? তিনি যদি জেলে থাকেন, তখন বিএনপির অবস্থা কী হবে? জেলে থাকা খালেদা জিয়া, মুক্ত খালেদা জিয়ার চেয়ে কি অধিক শক্তিশালী হতে পারবেন? এসব প্রশ্নের আগাম উত্তর দেয়া মুশকিল। কারণ পরিস্থিতি তখন কী হবে, তা এখনই অনুমান করা সম্ভব নয়। তবে সরকার বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে বিএনপিকে নিয়ে ইচ্ছামতো খেলতে পারবে। দল ভেঙে খ-িত অংশ নিয়ে নির্বাচনের উদ্যোগ নিতে পারে। তখন ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে এখন যেমন বলা হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে, তখনও বলবে, বলেছিলাম না, বিএনপি অংশগ্রহণ করবেÑ খ-িত বিএনপিকে দেখিয়ে বলবে, এই যে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। এ ধরনের আশঙ্কা থাকা অস্বাভাবিক নয়। এটা নির্ভর করছে পরিস্থিতির ওপর। তবে এটা নিশ্চিত, খালেদা জিয়া যদি জেলে থাকেন এবং নির্বাচন হয়, তবে বিএনপির ভোটারদের তো বটেই দল নিরপেক্ষ সাধারণ ভোটারদের কাছে নির্বাচন অনেকটা শূন্য শূন্য মনে হবে। নির্বাচনের প্রতি তাদের আগ্রহে ভাটা পড়তে পারে। কারণ, আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়েও শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা মানুষ বেশি উপভোগ করে। কে কার চেয়ে ভালো কথা বলে বা বক্তব্য দেয়, এ নিয়ে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিচার-বিশ্লেষণ এবং আলোচনা-সমালোচনা হয়। একজন আরেকজনকে যতই শত্রুজ্ঞান করুন না কেন, সাধারণ মানুষের আগ্রহ কিন্তু দলের চেয়ে তাদের প্রতি বেশি থাকে। এ কথা অনস্বীকার্য, যে দল ক্ষমতায় থাকে সে যে কোনো পর্যায়ে একধাপ এগিয়ে থাকে। আর বিরোধী দল একধাপ পেছনে থেকে তার কর্মকা- শুরু করে। ক্ষমতাসীন দলের সমান সমান বা তাকে ছাড়িয়ে যেতে হলে যথেষ্ট রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও কৌশল অবলম্বন করতে হয়। সরকারি দলের চেয়ে চিন্তা-ভাবনায় এগিয়ে থাকতে হয়। সিংহ এক পা পিছায় শিকারের ওপর হামলে পড়ার জন্য। এই পিছানোতে যদি বড় ধরনের হেরফের হয়, তবে শিকার তার নাগালের বাইরে চলে যায়। রাজনীতির ক্ষেত্রটাও অনেকটা এরকম। বিএনপির বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, দলটি দুই ধাপ বা তার অধিক পিছিয়ে রয়েছে। এ অবস্থায় সরকারি দলকে অতিক্রম করা তার পক্ষে অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ সরকারি দলই সিংহ হয়ে তাকে শিকার করে চলেছে। সরকারের এই থাবা থেকে বাঁচতে হলে বিএনপিকেও অত্যন্ত কৌশলী হতে হবে এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিএনপির এ ধরনের কৌশল আছে কিনা, তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। আপাত দৃষ্টিতে দলটিকে গোছগাছ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে। অবশ্য এর মধ্যে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন কীভাবে হবে তার একটা রূপরেখা তৈরি করছে। ইতোমধ্যে পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে যা এসেছে তাতে দেখা যায়, দলটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন নিয়ে সরকারের সাথে আলাপ করতে চায়। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে সংলাপে বসতে চিঠি দেয়ার কথা ভাবছে। এছাড়া দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ছাড় দিয়ে ‘নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকার’-এর রূপরেখা তৈরির কাজ শুরু করেছে। পত্রিকান্তরে যেটুকু খবর প্রকাশ হয়েছে, তাতে দেখা যায়। রূপরেখায় নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের মেয়াদ হবে তিন মাস। তখন সংসদ বহাল থাকতে পারে। এই সময় প্রধানমন্ত্রী ছুটিতে থাকবেন। এতে স্বপদে বহাল থেকে ছুটিতে থাকার মাধ্যমে নির্বাচন প্রভাবিত না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হবে। নির্দলীয় ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখা যাবে। যার ১০ ভাগ টেকনোক্রেট কোটায় স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী ছুটিতে থাকলে প্রেসিডেন্ট মন্ত্রীদের দিয়ে কাজ করাতে পারবেন। বিএনপি কর্তৃক নির্বাচনকালীন চূড়ান্ত রূপরেখায় এরকম প্রস্তাবনা থাকতে পারে। যদি তাই হয়, তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কি এ প্রস্তাব মানবে? এখন ক্ষমতাসীন দলের যে মনোভাব এবং আচরণ, তাতে তাদের কাছে এ রূপরেখাকে ‘মামা বাড়ির আবদার’ মনে হতে পারে। একটু ঘুরিয়ে বললে, যে প্রস্তাব ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন দল দিয়েছিল এবং বিএনপি তা নাকচ করে আন্দোলন করেছিল, ঘুরেফিরে সেই প্রস্তাবই এখন সে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ যেহেতু সে আন্দোলন যেভাবেই হোক অতিক্রম করতে পেরেছে, তাই এখন সে তা মানবে কেন? দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলে দিয়েছেন, নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। সংবিধান নির্দেশিত পথেই আগামী নির্বাচন হবে। সংবিধানে যেভাবে নির্বাচনের কথা বর্ণিত আছে, সে আলোকেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই। ক্ষমতাসীন দলের এ মনোভাব থেকে বুঝতে বাকি থাকে না, তারা বিএনপির সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা করতে রাজি নয় এবং হবে কিনা সন্দেহ। বিএনপির সমর্থকরা অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতেই পারেন, এই রূপরেখাই যদি বিএনপি দেবে, তবে ৫ জানুয়ারির আগের একই প্রস্তাব গ্রহণ করল না কেন? গ্রহণ করলে তো এত রক্তপাত ও দলের ক্ষতি হতো না! ‘বিএনপি কি তাহলে ধন হারাইয়া বুঝিল, কী ধন হারাইল।’ দলটি কি সামনে না হেঁটে পেছনে হাঁটল এবং হটল? বিএনপি বলতে পারে, যে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় নাই, তা সময়ের প্রেক্ষিতে গ্রহণযোগ্য ছিল না। আর যা সময়ের কারণে গ্রহণযোগ্য ছিল না, তা যে চিরতরে বাতিল হয়ে যাবে, এমন কথারও কোনো মানে নেই। এখন সময় হয়েছে, তাই এ ধরনের প্রস্তাব দেয়া যায়। রাজনীতিতে শেষ বলে কোনো কথা নেই। তবে রাজনীতিতে যথাসময়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে যে কত বড় খেসারত দিতে হয়, তা নিশ্চয়ই দলটি এখন বুঝতে পারছে। তাছাড়া সরকারের সে সময়ের প্রস্তাবটি যে ভুল ছিল, তাও তো দলটি আন্দোলনের মাধ্যমে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি। বরং এখন এ প্রস্তাব দিয়ে সরকারের সে সময়ের প্রস্তাবকেই সঠিক বলে প্রমাণ দিচ্ছে। তাদের এ প্রস্তাব এখন অনেকটা সরকারের কাছে অনুনয়-বিনয় হিসেবে পরিগণিত হওয়া স্বাভাবিক। তবে এ কথাও ঠিক, প্রস্তাবটি যেহেতু আওয়ামী লীগের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি দিয়েছে, কাজেই এ প্রস্তাব একেবারে উড়িয়ে দেয়াও ঠিক হবে না। এ প্রস্তাব না হোক, নির্বাচনকে কীভাবে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা যায়, এ নিয়েও সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার স্পেস রাখা দরকার। একেবারে দরজা বন্ধ করে দেয়া ঠিক হবে না। এতে ‘অতি গর্বে হতো লঙ্কার’ কারণ হতে পারে। কারণ বিএনপির এ প্রস্তাবের সাথে আরও অনেকে তো একমত হতে পারেন। তাছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সরকারের এক সময়ের প্রস্তাবই তো বিএনপি দিয়েছে। তাহলে অসুবিধা কোথায়?
তিন.
বলার অপেক্ষা রাখে না, ক্ষমতাসীন দল এখন নিজের অবস্থান সুসংহত করে নিয়েছে। মনে হতে পারে, সে অত্যন্ত আরামদায়ক অবস্থানে রয়েছে। তবে নির্বাচন যত ঘনায়মান হবে, এ অবস্থারও যে পরিবর্তন হবে, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এটি তার পক্ষে সহজ কোনো বিষয় নয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে পাঁচ বছর কাটিয়ে দিলেও আরেকটি এ ধরনের নির্বাচন করা তার জন্য খুব একটা সহজ এবং স্বস্তিদায়ক হবে না। কেউ কেউ হয়তো হতেও দেবে না। এই কেউ কেউ হচ্ছে, আমাদের ওপর খবরদারি করা বিদেশি শক্তিগুলো। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা, এই পঞ্চশক্তি কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচন গ্রহণও করেনি, স্বীকৃতিও দেয়নি। তারা বরাবরই অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে। যদি একই ধরনের নির্বাচন সরকার আবারও করতে চায়, তবে তা তারা হতে দেবে, এমন মনে করার কারণ নেই। তাদের বিদ্যমান ‘ইগো’তে পুনরায় আঘাত সহ্য করবে বলে মনে হয় না। দেখা যাচ্ছে, পঞ্চশক্তি ইতোমধ্যে বেশ নড়াচড়া শুরু করেছে। ভেতরে ভেতরে যে তারা সক্রিয় ছিল, তা হুট করেই প্রকাশ করেছে। তা না হলে বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ কেন নির্বাচন কমিশন গঠনকালে তারা প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাতের অনুমতি চাইবে? যদিও তাদের এই অনুমতি মেলেনি। তারপরও তারা থেমে নেই। আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হোকÑ এমন প্রত্যাশা নিয়ে তারা কার্যক্রম শুরু করেছেন। তারা নির্বাচন কমিশনসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করবেন। তাদের আগ্রহ হচ্ছে, আগামী নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা। সম্প্রতি মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া ব্লুম বার্নিকাট বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন শুধু ভোটের দিনে যা কিছু ঘটে তা নয়। বরং ভোটের আগেই দলগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ও বিতর্ক করার অবাধ সুযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মোট কথা, বিদেশিরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চান। পাশাপাশি সব দলের অংশগ্রহণও দেখতে চান। নির্বাচনের প্রায় দুই বছর আগে বিদেশিদের এই চাওয়া এবং তৎপর হয়ে ওঠার বিষয়টি যে আগামী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশাল প্রভাব ফেলবে, তাতে সন্দেহ নেই। তাদের এই চাওয়া-পাওয়া নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য অবমাননাকর এবং অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপের শামিল। তবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নকামী দেশে যেহেতু তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি যথেষ্ট থাকে এবং তা উপেক্ষা করা মুশকিল, তাই তাদের মতামত এবং কথার গুরুত্ব না দিয়ে পারা যায় না। এই যে তাদের মতামত দেয়া এবং তৎপর হয়ে ওঠাÑ এর সুযোগ কি আমাদের রাজনৈতিক দল বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি করে দিচ্ছে না? সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া নিয়ে যদি দুই দলের মধ্যে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকত, তাহলে কি বিদেশিরা এই সুযোগ পেত? যতদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয় নিয়ে আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল এবং ক্ষমতার সুষ্ঠু পালাবদল হয়েছে, ততদিন তো বিদেশিদের এই অতি উৎসাহী মনোভাব দেখা যায়নি। প্রতিটি নির্বাচন শেষে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল শুধু অভিনন্দন জানানোর মধ্যে। যখনই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ এবং বানচাল হওয়া শুরু হলো, তখনই তাদেরকে আমাদের রাজনীতিতে তৎপর হয়ে উঠতে দেখা গেল। যার সূচনা হয় ওয়ান-ইলেভেনের মধ্য দিয়ে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে যখন জবরদস্তিমূলক নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হলো, তার মধ্যেই একদিন সন্ধ্যায় দেখা গেল ওয়ান-ইলেভেন সরকার হাজির। রাজনৈতিক ক্যাচালে ত্যক্ত-বিরক্ত সাধারণ মানুষও তাকে স্বাগত জানাল। এতে রাজনৈতিক দলের সব কোন্দল এক সন্ধ্যাতেই মিলিয়ে যায়। এর ফলে যা হলো তা হচ্ছে, দুই নেত্রীকে জেলে যেতে হলো। তাদের মাইনাস করার প্রক্রিয়া শুরু হলো। ভাবা যায়, সেই সরকারের এ কূটচাল যদি সফল হয়ে যেত, তাহলে দুই দলের পরিস্থিতি কী হতো? যদিও সে সময় দুই দলের রাজনৈতিক দূরদর্শী সিদ্ধান্ত এবং জনমতের কারণে শেষ পর্যন্ত অনির্বাচিত ওয়ান-ইলেভেন সরকার সফল হতে পারেনি। এবারও কি ওয়ান-ইলেভেনের আগে বিদেশিদের যে তৎপরতা এবং আগ্রহ দেখা গিয়েছিল, তা দেখা যাচ্ছে না? বিদেশিদের নড়াচড়া দেখে সেরকম একটি আবহই যেন পরিলক্ষিত হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল হয়তো বলবে, সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতাসীন হওয়ার পথ আমরা চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছি। এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, এমন অনেক কিছুই তো আমরা অসম্ভব মনে করা থেকে কল্পনা করতে পারিনি, অথচ হয়ে গেছে। ওয়ান-ইলেভেনের মতো একটি সরকার হতে পারে, এটাও তো আমরা কেউ ঘূর্ণাক্ষরে ভাবিনি। কিন্তু হয়েছে তো! তদ্রুপ এমন একটি পরিস্থিতিরও তো সৃষ্টি হতে পারে, যা আমাদের চিন্তায় এখন নেই। হয়ে গেলে হয়তো, বুঝতে পারব। আর তা যদি হয়, তবে এর দায় কার ওপর বর্তাবে? ওয়ান-ইলেভেনের দায় কোন দলের কারণে, কার ওপর বর্তেছিল, তা আমরা জানি। আল্লাহ না করুন, যদি অন্য কোনো ফরমেটে এমন কোনো প্রক্রিয়া হয়, যাতে প্রধান দুই দলই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে তার দায় কার ওপর পড়বে? নিশ্চিতভাবেই প্রথমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ওপর। তারপর বিএনপির ওপর। ক্ষমতাসীন দল যদি মনে করে, এমন অশুভ কাজ হওয়ার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছি, তবে তা ভুল হতে পারে। কারণ ভূমিকম্প যখন হয়, তখন সবকিছুই নাড়িয়ে দিয়ে যায়। সবকিছুই ওলট-পালট হয়ে যায়। তাতে নিয়মকানুন থাকে না। আগামী নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের তৎপর ও অতি আগ্রহ থেকে এমন আলামতের ইঙ্গিত কি পাওয়া যাচ্ছে না?
চার.
যে দেশ রাজনীতি এবং রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, তার মূল বিষয়ই হচ্ছেÑ সরকার ও বিরোধী দলের পারস্পরিক সহাবস্থান এবং সমঝোতা। এর ব্যত্যয় ঘটলেই রাজনীতিতে অস্থিরতা এবং বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আপাত দৃষ্টিতে আমাদের বর্তমান রাজনীতি স্থিতিশীল মনে হচ্ছে। এ স্থিতিশীলতা যে স্বাভাবিক নয়, তা একজন সাধারণ মানুষও জানে। ক্ষমতাসীন দল বিরোধী রাজনৈতিক দলকে এমনভাবে কোণঠাসা করে রেখেছে যে তাদের নড়াচড়ার কোনো জায়গা নেই। এ কথা কে না জানে, দুর্বল বিড়ালকে যদি খাঁচায় বন্দি করে খোঁচানো হয়, তা বাঘের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। বিএনপিকে সরকার এখন যতই দুর্বল মনে করুক না কেন, যদি তাকে রাজনীতি করার সুষম স্পেস দেয়া হয়, তবে বোঝা যাবে সে দুর্বল না সবল। আর সরকারের প্রতি যেমন কোনো কোনো দেশের শক্ত ব্যাকআপ রয়েছে, তেমনি বিএনপির যে নেইÑ তা মনে করার কারণ নেই। এ কথা সবাই জানে সরকার প্রতিবেশী একটি দেশের কারণে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। তবে এই দেশের বাইরেও তো আরও বিশ্ব পরাশক্তির দেশ রয়েছে, সরকারের প্রতি যাদের নৈতিক সমর্থন নেই। তারা কি আগামী নির্বাচন ওই একটি দেশের ফর্মুলা মোতাবেক হতে দেবে? কারণ তাদেরও তো ‘ইগো’ এবং ‘স্বার্থ’ রয়েছে। তারা যে তাদের স্বার্থে কোনো কিছু করবে না, এটা কি গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়? এর আলামত তো এখন তাদের তৎপরতার মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে। আবার এটা ভাবারও কারণ নেই, তারা বিএনপির স্বার্থে কাজ করছে বা করবে। ওয়ান-ইলেভেনে আমরা দেখেছি, তারা শুধু তাদের স্বার্থেই কাজ করেছে। আগামী নির্বাচনে তারা যদি কোনো ভূমিকা রাখে, তবে তাও তাদের স্বার্থেই করবে। এতে ক্ষমতাসীন দল বা বিএনপি, যেই হোকÑ তাদের লাভ হবে না। কাজেই সময় থাকতে উভয়কেই সতর্ক এবং বুঝে আসতে হবে। সবার আগে বুঝতে হবে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নির্বাচন

২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ