Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাদক-সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় ওলামা মাশায়েখের সহযোগিতা চাইলেন -প্রধানমন্ত্রী

‘মুসলমানদের রক্তে রণক্ষেত্র হয় মুসলিম দেশ : লাভবান কারা?’

| প্রকাশের সময় : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বিশেষ সংবাদদাতা : সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ উচ্ছেদ করে দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে ওলামা-মাশায়েখসহ ইসলামী চিন্তাবিদদের সরকারের জঙ্গিবাদবিরোধী কর্মকাইমব জোরদারে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রী ওলামা সমাজের উদ্দেশে বলেন, আপনাদের কথা মানুষ শুনবে, আপনাদের কথা মানুষ নেবে। আমি আহ্বান করেছিলামÑ জনগণ এ ব্যাপারে সাড়া দিয়েছেন এবং বেশ কিছু কাজও করেছেন। আমি চাই এটা আরো ব্যাপকভাবে প্রচার করা। আমরা চাই আপনারা যদি মানুষকে ভালোভাবে বোঝান তাহলেই আমরা এ দেশ থেকে এই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ চিরতরে দূর করতে পারব এবং সে বিশ্বাস আমার আছে, যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বৃহস্পতিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়েজিত জাতীয় ইমাম সম্মেলন ও শিশু-কিশোর সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের সনদ ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
ধর্মীয় কর্মকা-ের পাশাপাশি আলেম-ওলামাদের অর্থনৈতিক কর্মকা-েও সম্পৃক্ত করতে সরকারের প্রাথমিক পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। অর্থনৈতিক কর্মকা-ের মাধ্যমে যাতে আয় বাড়ানো যায়, এ জন্য শুধুমাত্র আলেম-ওলামাগণের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে এমন একটি অর্থনৈতিক জোন তৈরি করার চিন্তা-ভাবনাও আমাদের রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের দিনে বড় একটি সমস্যা মাদকাসক্তি এবং অপরটি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ। এদের হাত থেকে আমাদের শিশুদের, যুবসমাজ তথা দেশবাসীকে রক্ষা করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনী কাজ করছে। গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। কিন্তু, সব থেকে বড় শক্তি মানুষের শক্তি। মানুষের ভেতর যদি সচেতনতা থাকে। মানুষ যদি এটার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তাহলে এই সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দেশ থেকে চিরতরে দূর হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকা- এবং সংঘাত বিস্তারের প্রেক্ষাপটে অস্ত্র বিক্রেতা দেশগুলোর দিকে আঙুল তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
তিনি বলেন, যেসব দেশ মুসলিম অধ্যুষিত, সেখানেই ‘মারামারি, কাটাকাটি, সেখানেই বোমাবাজি, খুনখারাবি’ হচ্ছে। সেখানেই অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু, এই অস্ত্রটা তৈরি করে কারা? আর লাভবান কারা হয়? রণক্ষেত্র বানাচ্ছে আমাদের মুসলমানদের জায়গাগুলো। রক্ত যাচ্ছে মুসলমানদের। আর ওই অস্ত্র তৈরি করে আর বিক্রি করে কারা লাভবান হচ্ছে? সেটা আপনারা একটু চিন্তা করে দেখবেন।
শেখ হাসিনা বলেন, দুর্ভাগ্য ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে কিছু লোক। তারা জঙ্গিবাদী আর সন্ত্রাসী কর্মকা- করে বলেই আমাদের পবিত্র ধর্মটা আজ মানুষের কাছে হেয় হচ্ছে। আজকে আন্তর্জাতিকভাবে এই ধর্মের মান-সম্মান ক্ষুণœ করছে, অন্যের চোখে এই ধর্মকে খাটো করে দিচ্ছে, ছোট করে দিচ্ছে।
ইসলাম ধর্মের শেষ বিচারে বিশ্বাসের কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শেষ বিচার আল্লাহ রাব্বুল আলামিন করবেন। কেউ যদি সৎ পথে থাকেন, সে বিচার তিনি করবেন। কেউ যদি ভুল পথে থাকে, সে বিচার তিনি করবেন। সেই বিশ্বাসটা কেন আমরা রাখতে পারি না। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস হারিয়ে কেন নিজেরাই হাতে তুলে নেই। মানুষ খুন করা আর সেটা আবার ধর্মের নামে।
ইসলামের কল্যাণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে তুলে ধরেন। ১৯৭৫ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু। দেশে প্রায় ৩ লাখ মসজিদে ৬ লাখ ইমাম ও মুয়াজ্জিন কর্মরত আছেন। প্রতিষ্ঠানটি ইমামদের ইসলামী বুনিয়াদি শিক্ষার পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এক লাখ ৮০ হাজার ৪২৯ জন আলেম এ পর্যন্ত ইসলামের মৌলিক বিষয়সহ আর্থ-সামাজিক, জনসচেতনতা এবং কম্পিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বল্প ব্যয়ে হজ করার জন্য বঙ্গবন্ধু ‘হিজবুল বাহার’ নামে একটি জাহাজ ক্রয় করেছিলেন, যেটাকে পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নিয়ে প্রমোদতরী বানায়। ধর্ম শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, আমরা শিক্ষাটাকে আরো সার্বজনীন করতে চাই, উন্নত করতে চাই। কারণ, আমি নিজে বিশ্বাস করি যে, শিক্ষাটা পূর্ণাঙ্গ হবে তখনই, যখন পার্থিব জগতের শিক্ষার সাথে সাথে ধর্মীয় শিক্ষাটাও সবাই গ্রহণ করতে পারবে। শিক্ষা নীতিমালায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ সময় আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে ‘দারুল আরকাম’ নামে মসজিদভিত্তিক বিশেষায়িত প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছি।
প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় মসজিদ নির্মাণের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে আমি যখন সউদী আরব গিয়েছিলাম, বাদশাহর সাথে আমার দেখা হয়। আমার মনের একটা ইচ্ছা আছে যে, আমরা সমস্ত উপজেলায় ও জেলায় মডেল মসজিদ এবং ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করব। যেখান থেকে ইসলামের সঠিক তথ্য ও ইসলাম সম্পর্কে মানুষ জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। স্থানীয় ইমাম ও মোয়াজ্জিনদের প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে, তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে। এই মসজিদ কমপ্লেক্সে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ভবনসহ মহিলাদের জন্য পৃথক নামাজকক্ষ, মুসলিম পর্যটক ও মেহমানদের বিশ্রামাগার থাকবে। এখানে হজযাত্রীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ইসলামী লাইব্রেরি ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এ কাজে সউদী সরকার আমাদের সহায়তা প্রদান করবে।
এক হাজারেরও বেশি মাদরাসার একাডেমিক ভবন নির্মাণের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৮০টি মাদরাসায় অনার্স কোর্স চালু করেছি। আমরা জাতীয় শিক্ষানীতিতে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের একটাই নিয়ত দেশের মানুষের কল্যাণ করা, মঙ্গল করা, তাদের উন্নত জীবন দেয়া এবং তাদের জীবনের সেই চাহিদাগুলো অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেয়া। অর্থাৎ মানুষ যেন মানুষের মতো জীবনযাপন করতে পারে তা নিশ্চিত করা। সেটা শহরেই হোক বা গ্রামেই হোক, তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের জীবনের চাহিদা যেন পূরণ করতে পারি মহান আল্লাহর কাছে সেই দোয়াই চাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি নামাজের পর সেই দোয়াই করি- আল্লাহ আমাদের হাত থেকে যেন কোনো অন্যায় না হয়, মানুষের জন্য যেন ন্যায় করতে পারি। মানুষের ভাগ্য যেন পরিবর্তন করতে পারি। তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা-চিকিৎসার সুযোগ যেন সৃষ্টি করতে পারি।
তিনি বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম ডিজিটালে রূপান্তরিত করা হয়েছে। একটি ডিজিটাল আর্কাইভ করা হয়েছে। দেশের সকল মসজিদ, মাদরাসা, খানকা ও দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংবলিত একটি ডাটাবেস তৈরির কাজ চলছে। প্রতিটি জায়গার হিসাবে যাতে হাতের মুঠোয় থাকবে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ ও ২০১৪ সালে শ্রেষ্ঠ ইমাম ও জাতীয় শিশু-কিশোর সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন।
ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি বি এইচ হারুন এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজলও উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ইমামের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মাওলানা ওহাবউল্লাহ এরশাদ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ধর্ম সচিব মো: আব্দুল জলিল।
হালাল খাদ্য ও পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন অনুমোদনপ্রাপ্ত একজন করে আলেম নিয়োগদানের বিষয়টি বিবেচনায় আছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এতে আলেম-ওলামাদের কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবে। বিদেশে বাংলাদেশের হালাল দ্রব্যের চাহিদা এবং গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মসজিদগুলোকে ইসলামী জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২৭ হাজার ৮৩২টি মসজিদ পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে। ৩৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২১ হাজার ৫২০টি মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার ও উন্নয়ন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, তার সরকার মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্পে ১ হাজার ৫০৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বরাদ্দ করেছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৭৬ হাজার ৬৬০ জন আলেম-ওলামার কর্মসংস্থান হয়েছে। ৯৬ লাখ ১৬ হাজার শিক্ষার্থী মসজিদভিত্তিক শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন। ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪ লাখ ৫০ হাজার কুরআনুল করীম বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার বায়তুল মোকাররম মসজিদে ১৭০ ফুট সুউচ্চ মিনার নির্মাণ করেছে। মসজিদটিতে ৫ হাজার ৬শ’ জন মহিলার নামাজ আদায়ের জন্য মহিলা নামাজ কক্ষ সম্প্রসারণ করা হয়েছে। চট্টগ্রামের জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদের সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ চলছে। চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ সম্প্রসারণ এবং আধুনিকীকরণের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।



 

Show all comments
  • ফারুক ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ২:১২ পিএম says : 0
    সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ উচ্ছেদ করে দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে সরকার এর আহবানে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • হাসান ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ২:২১ পিএম says : 0
    সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ উচ্ছেদ করে দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে সরকারকে আর সচেতন হতে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মুসলিম


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ