Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হাইব্রিড গণতন্ত্র আর কতদিন চলবে?

| প্রকাশের সময় : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কামরুল হাসান দর্পণ : সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের একটা আকাল চলছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মত প্রকাশ ও অধিকার বা জনগণের শাসন বলে পরিচিত গণতন্ত্র নামক পদ্ধতিটি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্রায় সব দেশেই এর দৈন্যদশা চলছে। গণতন্ত্রের অন্যতম দাবিদার যে যুক্তরাষ্ট্র, সেখানেও এর অবনমন ঘটছে। দেশটি এখন আর পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের দেশ নয়। শাসন ব্যবস্থাকে স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতি বা এলিট শ্রেণির কবল থেকে মুক্ত হয়ে অতি সাধারণ মানুষের মতামত নিয়ে খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতাব্দীতে দার্শনিক ক্লিসথেনিসের উদ্ভাবিত পদ্ধতির মাধ্যমে যে গণতন্ত্রের সূচনা হয়েছিল, তা এখন ‘হাইব্রিড’ অবস্থায় পরিণত হচ্ছে। আংশিক বা খ-িত অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে। গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে ‘রুল অব দ্য পিপল’ বা জনগণের শাসন। যেখানে সমঅধিকার, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, আইনের শাসন এবং আইনের চোখে সবাই সমান থাকবে। গণতন্ত্রের মূল চেতনা এটি। আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই দেখা যাবে, অধিকাংশ দেশেই বিভিন্ন শাসনামলে শাসন করত একনায়কবাদীরা এবং তারা নিজেদের এলিট ও উচ্চ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করত। এক ব্রিটেনই অনেক দেশ দখল করে শাসন করেছে। যারা শাসিত হতো, তাদের নিচু শ্রেণির মানুষ হিসেবে গণ্য করা হতো। ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসকদের দাপট এতটাই ছিল যে, প্রতিবাদ দূরে থাক, সাধারণ মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রকাশের কোনো অধিকার ছিল না। কেউ শাসকদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালে, তাকে একেবারে শূলে চড়িয়ে দেয়া হতো। প্রকৃতিগতভাবে মানুষ স্বাধীনচেতা। সে তার বিবেক-বিবেচনা এবং চেতনা দিয়ে ন্যায়-অন্যায়ের বিচার করতে চায়। স্বাধীনভাবে চলাফেরা এবং মত প্রকাশ করতে চায়। গণতন্ত্রের সূচনার আগে মানুষের এসব সহজাত বৈশিষ্ট্যর প্রকাশ শাসকরা কোনোভাবেই অনুমোদন দিত না। ফলে মানুষকে সবসময় টাইরেনি বা নিপীড়ক শাসকদের দ্বারা শাসিত হতে হতো। তবে শাসকবর্গ বা সে সময়ের সমাজের মধ্যে যে শুভবোধসম্পন্ন মানুষ ছিল না, তা নয়। তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ উপলব্ধি করে, এভাবে দাবিয়ে রাখার শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষকে অগ্রগামী এবং সুসভ্য করে তোলা সম্ভব নয়। তারা ভিন্ন চিন্তা করলেন। চিন্তা করলেন, সাধারণ মানুষের মতের ভিত্তিতে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করলে মানব সভ্যতাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে নেয়া যাবে। সে সময়কার নাগরিক সমাজের কারো কারো চিন্তাভাবনা থেকেই উদ্ভব ঘটে ‘রুল অব দ্য পিপল’ নীতির। যাকে বলে, জনগণের শাসন ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থায় প্রত্যেক মানুষ তার মতামত মুক্তভাবে ব্যক্ত করতে পারবে। তাদের সম্মিলিতি মতামতের ভিত্তিতে শাসন ব্যবস্থা চলবে। শাসন করবে এলিট শ্রেণি, তবে তা সাধারণ মানুষের মতামত নিয়ে। আজকের যে গণতন্ত্র এবং সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় শাসন পদ্ধতি, তার প্রথম উদ্ভব ঘটেছিল গ্রিকের এথেন্সে। এ জন্য একে এথেনিয়ান ডেমোক্রেসি বলে। পরবর্তীতে তা সংশোধন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রূপে আরও আধুনিক করে গড়ে তোলা হয়। এ জন্য গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে গণতন্ত্রের প্রয়োগ একেক দেশে একেক রকম দেখা যায়। ইংল্যান্ডে একরকম, আমেরিকায় আরেক রকম। তবে গণতন্ত্রের মূল অনুরণন একই। বিজ্ঞানী, লেখক এবং রাজনীতিবিদ বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন যখন আমেরিকার সংবিধান রচনা শুরু করেন, তখন এক সাধারণ মহিলা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে ডক্টর! আমরা কি পাচ্ছি? গণপ্রজাতন্ত্র, নাকি রাজতন্ত্র? জবাবে ফ্র্যাঙ্কলিন বলেছিলেন, গণপ্রজাতন্ত্র। যদি তোমরা তা ধরে রাখতে পার। আমেরিকার গণতন্ত্রের সূচনা এভাবেই হয়েছিল। দেশটির জনগণ কয়েকশ বছর ধরে গণতন্ত্রের এই স্বাদ আস্বাদন করে আসছে। এখন দেখা যাচ্ছে, দেশটির চলমান গণতন্ত্রও এখন ত্রুটিমুক্ত নয়।
দুই.
ক্ষমতায় যারা যান, তারা মনে করেন, দেশটি কেবল তাদের। যেভাবে খুশি সেভাবে দেশ চালাবে। বিশেষ করে আমাদের দেশের মতো উন্নয়নকামী দেশগুলোতে ক্ষমতাসীনরা গণতন্ত্র উদ্ভবের আগে এলিট শ্রেণি যেভাবে নিজেদের ইচ্ছামতো দেশ চালাত, শাসন কাজ চালানোর ক্ষেত্রে তারা সে ধারাই অবলম্বন করেন। জনগণের শাসনের খুব একটা তোয়াক্কা করেন না। এর কারণ তাদের মনোবাসনাই থাকে চিরকাল তারাই ক্ষমতায় থাকবেন। ক্ষমতা থেকে যাতে নেমে যেতে না হয়, এ জন্য ভিন্নমত যতই থাকুক, তা আমলে নিতে চান না। প্রয়োজনে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে দমননীতি অবলম্বন করেন। মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও কাজ করেন উল্টো। পিপলস রুলের ধারেকাছেও ঘেঁষেন না। অথচ সবকিছুতেই জনগণ শব্দটি লাগিয়ে দেন। বলে বেড়ান, জনগণ তাদের রায় দিয়েছে, জনগণ এ চায় ও চায়। এই করলে জনগণ মানবে না, ওই করলে প্রতিহত করবে। আমরা কাজ করছি জনগণের ভাগ্য উন্নয়ন ও তাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। এরকম গালভরা বুলি প্রচার করতে থাকেন। আমাদের দেশেই শাসক দলের কাছ থেকে এ ধরনের কথা মানুষ সুদীর্ঘকাল ধরেই শুনছে। এমনকি যে স্বৈরশাসক, তার মুখ থেকেও এ ধরনের কথা বের হয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দলে যারা থাকেন, ক্ষমতায় যেতে না পেরে তাদের দুঃখের অন্ত থাকে না। ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলের রাজনীতির এ ধারা দেখে একজন সাধারণ মানুষেরও বুঝতে অসুবিধা হয় না, তাদের উভয়ের লক্ষ্যই ক্ষমতাপ্রাপ্ত হওয়া। ক্ষমতা থেকে ক্ষমতাসীনরা কোনোভাবেই যেতে চায় না, আর বিরোধী দলগুলো ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বের মাঝে পড়ে থাকে জনগণ। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর গণতন্ত্র এখন এমনই। ক্ষমতায় যাওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্য থাকা স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হচ্ছে, যে জনগণের নাম ব্যবহার করে তারা ক্ষমতায় যেতে চায় বা যায়, ক্ষমতায় গিয়ে সেই জনগণের কোনো খবর থাকে না। উল্টো জনগণের সাথে টাইরেনিক আচরণ করা শুরু করে। তাদের শাসন এলিটদের শাসন ব্যবস্থায় রূপ লাভ করে। জনগণের কাছ থেকে ভোট নেয়ার সময় তাদের আচরণ থাকে একরকম, ক্ষমতায় গিয়ে হয়ে যায় তার বিপরীত। জনগণকে তখন জনগণ মনে করে না, প্রজা মনে করে রাজা সেজে বসে। আমাদের দেশের মানুষ প্রায় সব ধরনের শাসন ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই এগিয়েছে। সামন্তযুগীয় শাসন থেকে শুরু করে স্বৈরশাসন এবং মাঝে মাঝে অপূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। তবে জনগণের বহু কাক্সিক্ষত যে গণতন্ত্র তার স্বাদ খুব কমই পেয়েছে। এ নিয়ে তারা কম আন্দোলন-সংগ্রাম করেনি। দেখা যায়, যাদের নেতৃত্বে গণতন্ত্রায়ন ও গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন করেছে, তারাই ক্ষমতায় গিয়ে গণতান্ত্রিক আচরণ করতে কুণ্ঠিত হয়েছে। গণতন্ত্রের একটি উপাদান হলো নির্বাচন। যে নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে জনগণ তাদের শাসন কাজ পরিচালনার জন্য পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচিত করবে। দুঃখের বিষয়, এখন এ অবস্থাটা নেই। আমরা যদি বর্তমান শাসন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখবÑ এ শাসন ব্যবস্থায় জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে সরকার নির্বাচিত হয়নি। বিনা ভোটে সরকার পরিচালিত হচ্ছে। এ শাসন ব্যবস্থাকে ডেমোক্রেসি বলে না। একে বলা হয়, ডেমার্কি বা নির্বাচনবিহীন গণতন্ত্র। অবশ্য পরিপূর্ণ ডেমার্কি হলেও খুব খারাপ হতো না। কারণ এখানে যাদের সিলেক্ট করা হয়, তারা নির্বাচিতদের চেয়েও অধিক গণতান্ত্রিক হয়ে থাকে। তাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা জনগণের মতামত এবং স্বার্থকে অধিক গুরুত্ব দেবে এবং অধিক নিয়মতান্ত্রিক ও পক্ষপাতহীন হবে। অর্থাৎ ডেমার্কি সিস্টেমে লটারির মাধ্যমে যাদের সিলেক্ট করা হয়, তাদের দায়টা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের চেয়েও বেশি কার্যকর হতে হয়। এখানে বরং জনগণের প্রতি এক ধরনের দায়হীন পরিস্থিতি লক্ষ করছি। দুর্নীতি, অনিয়ম এবং আইনের শাসনের অভাবের মধ্য দিয়েই ডেমার্কি সিস্টেমের শাসন ব্যবস্থা চার বছর ধরে চলছে। এখানে কথা বলার সুযোগ কম, বিরোধী রাজনীতি অনুপস্থিত, পুলিশের ওপর নির্ভরশীল শাসন ব্যবস্থাÑ এমন অনেক অভিযোগই রয়েছে। যে গণতন্ত্রের জন্য দেশের মানুষ যুগের পর যুগ ধরে সংগ্রাম করেছে, তা খাঁচায় বন্দি করে রাখা হয়েছে। যা ছোঁয়া যায় না, অনুভব করা যায় না। অথচ শাসক দল ঠিকই গণতন্ত্রের কথা বলে যাচ্ছে। যেখানে ক্ষমতাসীন দলের শাসন ব্যবস্থা, রাজনীতি এবং অপরিণামদর্শী নীতি নিয়ে কথা বলা ও সমালোচনা করা যায় না, করলেই খড়গ কৃপাণ নেমে আসেÑ তা কী করে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা হয়? এমন এক খ-িত এবং ক্ষতবিক্ষত গণতন্ত্র নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের কথা বলার ক্ষেত্রেও কোনো সংকোচবোধ নেই। গণতন্ত্র নিয়ে তাদের এই নিঃসংকোচ কথাবার্তা হাস্যকর।
তিন.
সারা বিশ্বে এখন গণতন্ত্রের যে ক্রমাবনতি তার একটি চিত্র সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক জরিপে উঠে এসেছে। তাদের বৈশ্বিক গণতন্ত্র সূচক-২০১৬ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ আছে ‘হাইব্রিড’ গণতান্ত্রিক দেশের কাতারে। সার্বিক স্কোরও আগের বছরের মতো একই আছে। ১০-এর মধ্যে ৫.৭৩। ১৬৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪। হাইব্রিড গণতান্ত্রিক দেশ সেগুলোকেই বলা হয়, যেগুলোর স্কোর ৪ থেকে ৫.৯০-এর মধ্যে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ, সরকারের কার্যকারিতা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নাগরিক স্বাধীনতা শ্রেণিতে বাংলাদেশের স্কোর আগের মতোই রয়েছে। অর্থাৎ কোনো উন্নতি নেই। ইআইইউ এ পরিসংখ্যান তুলে না ধরলেও বাংলাদেশের একজন সাধারণ মানুষও জানে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পরিস্থিতি কী এবং কী অবস্থায় রয়েছে। এটা জানা বা বোঝার জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জরিপ বা প্রতিবেদন প্রকাশের প্রয়োজন নেই। চার বছর আগে ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পর গণতন্ত্রের ছুরত কি, তা বোধকরি দেশের মানুষের চেয়ে আর কারো বেশি জানার কথা নয়। যেখানে ডেমার্কি শাসন ব্যবস্থা চলছে, সেখানে শাসন ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার কথা থাকলেও তার চরম অবনতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভিন্নমত পোষণের জায়গা এতটাই সংকুচিত করা হয়েছে যে, বিরোধী রাজনৈতিক দল দূরে থাক একজন সচেতন ও সৃজনশীল মানুষ পর্যন্ত কথা বলতে সাহস পান না। টেলিভিশন টকশোগুলোর দিকে যদি তাকানো যায়, তবে সেখানে দেখা যায় সরকারপন্থি বুদ্ধিজীবীদেরই জয়জয়কার। বিরোধী দলের হয়ে কথা বলার মতো কোনো লোক দেখা যায় না। যারা সরকারের সমালোচনা করতেন এবং মনে হতে পারে তারা বিরোধী দলের পক্ষ হয়ে কথা বলতেন (অথচ তা তারা করতেন না), তাদেরকে পর্যন্ত টকশোগুলোতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখা হয়েছে। অর্থাৎ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সরকারের বিপক্ষে যায় এমন সমালোচনা অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। এগুলো ওপেন সিক্রেট হলেও মুখ ফুটে কেউ কিছু বলতে পারছে না। বলতে গেলেই নানা বাধা-বিপত্তি এমনকি হামলারও শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থাৎ একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের যে কথা বলার অধিকার রয়েছে, তা নেই বললেই চলে। সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলুক সে তা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছে না। এই যে গত ২৬ জানুয়ারি রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতা করে তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি যে অর্ধবেলা হরতাল ডাকল, তাতে পুলিশ যেভাবে হামলা চালিয়েছে এবং সাংবাদিক পিটিয়েছে, তা কি মত প্রকাশের পক্ষে যায়? গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে যে কেউ প্রতিবাদ করতে পারে। গ্রহণ করা না করা সরকারের এখতিয়ার। তার মানে কি তাকে পিটিয়ে লম্বা করে ফেলতে হবে? অথচ হরতালে পুলিশ তাই করেছে। মিছিল ও সমাবেশের মাধ্যমে একটি অহিংস প্রতিবাদে পুলিশ যেভাবে হামলে পড়ল, তা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক আচরণ তো নয়ই, বরং অসহিষ্ণুতার চরম বহিঃপ্রকাশ। এ কাজটি পুলিশ না করলেও পারত। প্রতিবাদকারীরা বড় জোর মিটিং-মিছিল করে তাদের কর্মসূচি শেষ করত। এর বেশি কিছু তো হতো না। সরকার যদি গণতান্ত্রিক মনোভাবসম্পন্ন হতো তবে সানন্দে এই প্রতিবাদ গ্রহণ করত। সরকার তা বরদাশত করেনি। এর কারণ কি? সরকার ভালোভাবেই জানে, তার ক্ষমতা আরোহণের বিষয়টি সহিভাবে হয়নি। জনভিত্তির ওপর সে দাঁড়িয়ে নেই। এ কারণে কোনো প্রতিবাদ এবং সে প্রতিবাদে জনগণের উপস্থিতি সে ভয় পায়। কারণ প্রতিবাদকারী এসব জনগণ তাকে ভোট দেয়নি। যে জনগণের রায় না নিয়ে ক্ষমতায় থাকে, তার ভয় থাকা স্বাভাবিক। সে নিজেও জানে, জনগণ তার সাথে ছিল না, এখনও নেই। জনগণকে সমবেত হতে দিলেই ভয় এবং লজ্জাÑ দুটোই তাকে পেয়ে বসবে। কাজেই জনগণ যাতে একত্রিত হতে না পারে, প্রতিবাদ করতে না পারেÑ এ ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই তার ক্ষমতায় থাকা ছাড়া গতি নেই। এটা অনেকটা অত্যন্ত দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে হুংকার দেয়া স্বৈরচারী সরকারের মতো।
চার.
বাংলাদেশের মানুষ অনেক ক্ষেত্রে সচেতন না হলেও তাদের রাজনৈতিক সচেতনতা বেশ টনটনে। রাজনীতির ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করা তাদের সহজাত প্রবৃত্তি। এর কারণ হচ্ছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক নানা ইস্যুতে সুদীর্ঘকাল ধরে তারা আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে। রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ব্যত্যয় ঘটলে, না খেয়ে হলেও তারা তা প্রতিষ্ঠায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। বর্তমানে রাজনৈতিক অধিকার সীমিত করা এবং সরকারের নানা নীতির সমালোচনার সুযোগ সংকুচিত করা হলেও ভেতরে ভেতরে তাদের প্রতিক্রিয়া ঠিকই হচ্ছে। তারা ভালো করেই জানে, যে গণতন্ত্রের জন্য তারা দীর্ঘ সংগ্রাম করে আসছে, তা এক প্রকার দমিয়ে রাখা হয়েছে। তবে তারা এটাও জানে, এ পরিস্থিতির অবসান একটা সময় হবে। কারণ আইয়ুব খানের দীর্ঘ এক দশকের দমন-পীড়নের শাসন ব্যবস্থা তারা দেখেছে। রাজনৈতিক অধিকারসহ মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের সময়কালের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে। শেষ দিন পর্যন্ত আইয়ুব খান ভাবতে পারেনি, তাকে ক্ষমতা থেকে অতি দ্রুত সরে যেতে হবে। আইয়ুব খান ঠিকই চলে গেছেন। তবে তিনি বাংলাদেশের জনগণের কাছে তার গণতন্ত্রহীন খারাপ শাসন ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। স্বাধীনতার পর এমন খারাপ শাসন ব্যবস্থা জনগণের সামনে একাধিকবার এলেও তা একটা দীর্ঘ সময় চলেছে বটে, তবে জনগণের কাছেই শেষ পর্যন্ত এ শাসন ব্যবস্থার পরাজয় হয়েছে। গণতন্ত্রের প্রশ্নে তাদের ভূমিকা আপসহীন। ক্ষমতায় যারাই থাকুক না কেন, গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের এই আকাক্সক্ষা বুঝতে না পারলে, ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। সাময়িকভাবে জোর-জুলুম করে হয়তো দমিয়ে রাখতে পারবে, তবে সুদীর্ঘকালের জন্য নয়। কারণ বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রের স্বাদ পেয়ে গেছে। তাদের এ স্বাদ বিস্বাদে পরিণত করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গণতন্ত্র

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ