Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রথম ভিক্ষুকমুক্ত জেলা নড়াইল

| প্রকাশের সময় : ২৮ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নড়াইল জেলা সংবাদদাতা : দৃষ্টিহীন লিটনসহ ৩৯ প্রতিবন্ধী এখন আর ভিক্ষার জন্য অন্যের কাছে হাত পাতেন না। জুলেখা বেগম ২৫ বছর ধরে ভিক্ষা করতেন। ভিক্ষুক পুনর্বাসনের টাকা পেয়ে ছেলেকে হোটেল করে দিয়েছেন। এখন আর ভিক্ষার জন্য রাস্তায় নামেন না। এভাবে নড়াইলে ৭৯৮ ভিক্ষুকের হাত এখন কর্মীর হাত। দেশে প্রথম ভিক্ষুকমুক্ত জেলা হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষায় নড়াইল। নড়াইলের রূপগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীবাহী বাসে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাদাম বিক্রি করেন দৃষ্টিহীন লিটন শেখ (৪৫)। অথচ এক বছর আগেও তিনি এখানেই বাসযাত্রীদের কাছে ভিক্ষার জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেন। সেই হাতেই এখন বাদামের ঝুড়ি আর বাটখারা। প্রতিদিন আয় করেন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। লিটন প্রায় ২২ বছর ভিক্ষা করেন।
লিটনের মতো ২০ জন দৃষ্টিহীন, দু’জন বধির ও দু’জন বোবাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ৩৯ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কেউ আর ভিক্ষা করেন না।
নড়াইলের তিনটি উপজেলা ও ৩৯টি ইউনিয়নে ৭৯৮ জন ভিক্ষুককে চিহ্নিত করে সব এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে নারী ৫৫৫ এবং পুরুষ ২৪৩ জন। প্রায় ১০ মাসের চেষ্টায় নড়াইল ভিক্ষুকমুক্ত জেলায় পরিণত হয়েছে। এখন দেশের প্রথম ভিক্ষুকমুক্ত জেলা হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষা। চলতি মাসেই (জানুয়ারি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নড়াইলকে ভিক্ষুকমুক্ত জেলা হিসেবে ঘোষণা করবেন বলে আশা করছেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
ভিক্ষুকদের কর্মমুখী ও পুনর্বাসন করতে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচটি গরু, পাঁচটি ওজন পরিমাপক যন্ত্র, ছয়টি সেলাই মেশিন, ৩০৭টি ছাগল, ৯১০টি হাঁস, ২৯০টি মুরগি, ১৩টি ভ্যান, ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য ২৫৩টি দোকান, দুই বান্ডিল টিন ও ছয় হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৪৭ লাখ টাকার পুঁজি সমিতির মাধ্যমে ঋণ সৃষ্টি করে ভিক্ষুকদের মাঝে বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে।
এদিকে, প্রাপ্যতার ভিত্তিতে ২৭৫ জনকে বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান এবং জিআর চালসহ ইজিপিপি ও ১০ টাকা কেজি দরের চালের সুবিধাও দেয়া হয়। এ ছাড়া আটজনকে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। ৭৯৮ জন পুনর্বাসিত ভিক্ষুককে দেখভালের জন্য একজন করে তদারককারী কর্মকর্তা নিয়োজিত আছেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য সহকারী, চৌকিদারসহ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের চাকরিজীবীরা স্বেচ্ছাশ্রমে পুনর্বাসিত ভিক্ষুকদের তদারক করেন।
জেলার বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড, ফেরিঘাট, হাট-বাজার, বাসাবাড়ি, শহর-বন্দর, গ্রামাঞ্চলসহ বিভিন্ন লোকালয় ঘুরে দেখা গেছে, ভিক্ষার জন্য এখন কেউ অন্যের কাছে হাত পাতেন না। ভিক্ষুক হিসেবে কাউকে দেখাও যায় না। হঠাৎ করে বাইরের জেলা থেকে কোনো ভিক্ষুক নড়াইলে এলে তাদের নিজ জেলায় ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়।
পুনর্বাসিত ভিক্ষুকদের মধ্যে কেউ বাজারে বিক্রি করছেন সবজিসহ বিভিন্ন কাঁচামাল। অনেকে আবার গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করছেন। স্কুল-কলেজের আশপাশসহ বিভিন্ন লোকালয়ে ছোট মুদি দোকান দিয়েছেন কেউ কেউ। এদেরই একজন জামাল হোসেন (৬৩)। ১১ বছর ধরে ভিক্ষা করতেন তিনি। এখন নড়াইলের রূপগঞ্জ বাজারে তরকারি বিক্রি করেন। জামাল হোসেন জানান, আগে ভিক্ষা করে প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পেতেন। এখন কাঁচামাল বিক্রি করে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা আয় করেন। তবু খুশি তিনি। কারণ, ভিক্ষাবৃত্তির মতো লজ্জাজনক কাজ ছেড়ে দিয়ে এখন নিজে আয় করেন। তার স্ত্রী ববিতা মিষ্টির প্যাকেট তৈরি করেন। নড়াইল-যশোর সড়কের পাশে সীতারামপুরের খাসজমিতে একচালা ঘরে বসবাস তাদের।
১৭ বছর ভিক্ষা করেছেন নাকসী গ্রামের উজেলা বেগম (৩৫)। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী হাটতে পারেন না। এডিসি স্যার নাকসীতে বিদ্যালয়ের সামনে আমাদের একটি মুদি দোকান করে দিয়েছেন। আমি দোকান চালাই এবং আমার স্বামী নড়াইল শহরে ফার্নিচার তৈরির ঘরে কাঠ ঘষাঘষির কাজ করেন। এখন আমরা ভিক্ষা করি না। আমার বড় ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী। আরো দুই সন্তানও লেখাপড়া করছে।’
রূপগঞ্জ বাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ী মুনছুর মোড়ল বলেন, ‘আগে যারা ভিক্ষা চাইত, তাদের অনেকেই আমাদের পাশে বসে সবজিসহ বিভিন্ন তরকারি বিক্রি করছেন।’ বাসযাত্রী রওশন আরা বলেন, হাত পেতে নয়, বাদামসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করে আয় করছেন অনেক দৃষ্টিহীন প্রতিবন্ধীব্যক্তিরা। এদের কাছ থেকে বাদাম কিনে ভালো লাগছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) নড়াইল জেলা শাখার আহŸায়ক খন্দকার শওকত বলেন, ইসলাম ধর্মেও ভিক্ষাবৃত্তিকে নিষেধ করা হয়েছে। নড়াইলের মতো পুরো দেশকে ভিক্ষুকমুক্ত করা প্রয়োজন।
নড়াইলকে ভিক্ষুকমুক্ত করার উদ্যোক্তা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সিদ্দিকুর রহমান। তার এই উদ্যোগের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালের ফেব্রæয়ারিতে ভিক্ষুকমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। সব এলাকা থেকে ভিক্ষুকদের তালিকা করে তাদের পুনর্বাসনের জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সহযোগিতায় ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন করা হয়। জেলার প্রবেশদ্বারসহ বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষুকমুক্ত সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়।’
জেলা প্রশাসক হেলাল মাহমুদ শরীফ বলেন, ‘জানুয়ারিতেই নড়াইল জেলাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হবে। আশা করছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নড়াইলকে ভিক্ষুকমুক্ত জেলা হিসেবে ঘোষণা দেবেন। এখন দিনক্ষণের অপেক্ষায় আছি।’



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রথম


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ