শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
কুতুবউদ্দিন আহমেদ : কবি অথচ পুরোপুরি কবি নন; বিদগ্ধজনেরা স্বীকৃতি দিতে চান না; তিনি একজন বিশুদ্ধ সমাজ পর্যবেক্ষক; সমাজের বাঁকে-বাঁকে তাঁর চোখ তির্যকভাবে নিবিষ্ট হয়; সামাজিক অসংলগ্নতার ঘোমটা মুহূর্তে টান দিয়ে খুলে ফেলেন; কালোকে তিনি কালো-ই বলতে চান, রহস্য করে ‘উজ্জ্বলশ্যাম’ বলতে নারাজ; সামান্য কবিত্ব ছিল; সেই কবিত্ব নানান প্রতিবন্ধকতায় পরিশীলিত হবার মতো সুযোগ পায়নি; শিক্ষিতজনের দুয়ারে অপাঙ্ক্তেয় হতে-হতেও বিলুপ্ত হননি; স্থান দখল করে নিয়েছেন সমাজের কুলিনস্তরে; উঁচুমার্গীয় লেখক না হয়েও অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখকের গুরুস্থানীয়; তিনি কবি ঈশ্বরগুপ্ত; যুগসন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। চাইলেই আমরা তাকে বাংলা সাহিত্যের পাতা থেকে ফুঁৎকারে হাওয়ায় মিলিয়ে দিতে পারি না।
বাংলা সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র খুব গুরুত্বপূর্ণ কবি নন কিন্তু বাংলা কবিতার পথ বিনির্মাণে রয়েছে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। উনিশশতকের তৃতীয় দশক থেকে পঞ্চমদশক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য কেবল ঈশ্বরগুপ্তময়; সাহিত্য সমাজে তাঁর প্রভাব ছিল অভাবনীয়। তিনি খুলে দিয়ে গেছেন বাংলা সাহিত্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখকের হৃদয়-কপাট। বাংলা ভাষার সংবাদপত্র বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও তিনি প্রধানত কবি। বিস্মৃতির অতল তলে তাঁর আর সকল কর্মযজ্ঞ হারিয়ে গেলেও বাংলা কবিতার বিশেষ অলংকৃত সিংহাসনটি কখনও হারাবার নয়।
কর্মজীবনে ঈশ্বরগুপ্ত একাধিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তৎকালে তাঁর কবিতার যথেষ্ট সমাদর ছিল। সংবাদপত্রের কাটতির জন্য তিনি বাধ্য হয়ে অনেক কবিতা লিখতেন। তাঁর কবিপ্রতিভাটাই ছিল সাংবাদিক ঘরানার। সাময়িকতাই সে-সকল কবিতার শ্রেষ্ঠ পরিচয়। সমাজের সত্যিকারের রূপ তিনি তুলে ধরেছেন অকপটে। তিনি কোনো রাখঢাক না করে পরিষ্কার বলে দিতে পারেন ঃ
তোমাদের এ দেশ এ সমাজ বড় রঙ্গভরা। তোমরা মাথাকোটাকুটি করিয়া দুর্গোৎসব কর, আমি কেবল তোমাদের রঙ্গ দেখি Ñ তোমরা এ ওকে ফাঁকি দিতেছ, এ ওর ঘরে মেকি চালাইতেছ, এখানে কাষ্ঠ হাসি হাস, ওখানে মিছা কান্না কাঁদ, আমি তাহা বসিয়া বসিয়া দেখিয়া হাসি। [ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিত্ব ঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়]
ঈশ্বরগুপ্তের জন্ম বাংলার [পশ্চিমবঙ্গের] কাঁচড়াপাড়ার শিয়ালডাঙায়। পিতা হরিনায়রণ দাশগুপ্ত শিয়ালডাঙার কুঠিতে মাসিক আটটাকা বেতনে চাকুরি করতেন। পিতার সীমিত আয়ের জন্য পরিবারে সচ্ছলতা ছিল না। আর্থিক কষাঘাতে তাঁকে জর্জড়িত হতে হয়েছে। মাত্র দশবছর বয়সে মাতৃহীন হন। বালক ঈশ্বরগুপ্ত বিমাতার সাহচর্য তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। তাই বলা যায় মনের দুঃখে এই এক অর্বাচীন বালক বাড়ি ছেড়ে কলকাতার জোড়াসাঁকোয় মাতামহের সংসারে আশ্রয় নেন।
গুপ্তকবি মাত্র পনের বৎসর বয়সে [১৮২৭] দ্বারপরিগ্রহ করেন। কিন্তু সেখানেও বিধি বাম, ভাগ্য তাঁকে নির্মম পরিহাস করেছে। স্ত্রী দেখতে অতিশয় কুৎসিত বিধায় জীবনে এই নারীকেও মেনে নিতে পারেননি। বলায় যায় নারীর প্রতি সমস্ত জীবনে এই কবির বিতৃষ্ণা রয়ে গেছে। তাঁর বিভিন্ন লেখায় বিষয়টি স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। বাঙালি রমণীকূলের উদ্দেশে তিনি বলেন ঃ
তোমরা বল, বাঙালির মেয়ে বড় সুন্দরী, বড় গুণবতী, বড় মনোমোহিনী Ñ প্রেমের আধার, প্রেমের সুসার, ধর্মের ভা-ার; Ñ তাহা হইলে হইতে পারে, কিন্তু আমি দেখি, উহারা বড় রঙ্গের জিনিস। মানুষে যেমন রূপী বাঁদর পোষে Ñ উভয়কে মুখ ভেঙানোতেই সুখ।
[ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিত্ব ঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়]
ঈশ্বরগুপ্ত দরিদ্রঘরের সন্তান। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি। তবে নিজ উদ্যোগে নানান অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছেন। লাভ করেছেন তৎকালীন বিদ্যুদ্সমাজের বিশেষ আনুকুল্য। ব্রাহ্মসমাজের সভ্য হবার সুবাদে রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রবাবুর ¯েœহধন্য হয়েছিলেন। ‘সংবাদ প্রভাকর’ সম্পাদনার মধ্য দিয়ে সে-যুগে বেশ প্রভাবশালী সাংবাদিক হয়ে ওঠেন। প্রখ্যাত সাহিত্যবেত্তা ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন ঃ
‘সংবাদ প্রভাকরে’র মারফতে তিনি এ যুগের সমগ্র বাঙালির মনে অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। কলকাতার অভিজাত ব্যক্তিরাও তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন, ইংরেজ শাসকও তাঁর পত্রিকার ও মতামতের মূল্য দিতেন। পুঁথিগত বিদ্যা তাঁর বিশেষ না থাকলেও জীবনের ব্যবহারিক ও বাস্তবক্ষেত্রে তাঁর সাধারণ জ্ঞান খুব তীক্ষ্ম ছিল। [বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত]
ঈশ্বরগুপ্ত মূলত বাস্তবতার কবি; দিনের আলোর কবি; আলো-আঁধারির কবি নন। সামাজিক অসামঞ্জস্যগুলোকে তিনি রঙ্গব্যঙ্গের মধ্যদিয়ে কটাক্ষ করেছেন। তাঁর কবিতায় আবেগের স্থান নেই; নিরাবেগই সেখানে প্রাণশক্তি। প্রেম তাঁর কাছে হাস্যকর শিরপীড়া ছাড়া আর কিছু নয়। নারীর প্রেমে তাঁর নীরাসক্তি থাকলেও স্বদেশপ্রেমের কবিতায় কিন্তু তিনি ঠিকই শতভাগ সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন। তৎকালে জনসাধারণ ঈশ্বরগুপ্তের স্বদেশপ্রেমের কবিতা পাঠ করে অনুপ্রেরণা পেত। তাঁর পূর্বে বাংলা ভাষার অন্য কোনো কবি এমন সুতীব্র দেশপ্রেমের কবিতা লিখে যেতে পারেননি ঃ
জননী ভারতভূমি আর কেন থাক তুমি
ধর্মরূপ ভূষাহীন হয়ে।
তোমার কুমার যত সকলেই জ্ঞানহত
মিছে কেন মর ভার বয়ে?
কিংবা
মাতৃসম মাতৃভাষা পুরালে তোমার আশা
তুমি তার সেবা কর সুখে।
কিংবা তাঁর বহুপঠিত সেই অমর পঙক্তিমালা :
মিছা মণি মুক্তা হেম স্বদেশের প্রিয় প্রেম
তার চেয়ে রতœ নাই আর।
সুধাকরে কত সুধা দূর করে তৃষ্ণাক্ষুধা
স্বদেশের শুভ সমাচার।
ভ্রাতৃভাব ভাবি মনে দেখ দেশবাসিগণে
প্রেমপূর্ণ নয়ন মেলিয়া।
কত রূপ ¯েœহ করি দেশের কুকুর ধরি
বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।
তৎকালে ঈশ্বরগুপ্ত ব্যঙ্গাত্বক কবিতা লিখে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। জনসাধারণ এগুলোকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিল। এই ব্যঙ্গ কবিতাগুলোর মধ্য দিয়ে তাঁর সমাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা, বাস্তব চিত্রাঙ্কনের ক্ষমতা, অসঙ্গতিগুলোকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া, মিশনারী, ইয়ংবেঙ্গল, মেয়েদের উগ্র আধুনিকতা ধারণ, বিধবাবিবাহের প্রচারক কেউ তাঁর কলমের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি। নিচে তাঁর এ-আক্রমণের কিছু দৃষ্টান্ত দেখানো হল :
খ্রিস্টানি রেওয়াজ ও তাদের অনুসারীদের ব্যঙ্গ :
ধন্য রে বোতলবাসী ধন্য লাল জল
ধন্য ধন্য বিলেতের সভ্যতা সকল ॥
দিশি কৃষ্ণ মানিনেক’ ঋষিকৃষ্ণ জয়
মেরি দাতা মেরিসুত বেরি গুডবয় ॥
ইংরেজি শেখা মেয়েদের তিনি ব্যঙ্গ করেছেন এভাবে :
আগে মেয়েগুলো ছিল ভাল ব্রতধর্ম কর্তো সবে।
একা বেথুন এসে শেষ করেছে আর কি তাদের তেমন পাবে ॥
ইয়ংবেঙ্গলদের উদ্দেশে তিনি লিখেছেন :
সোনার কাঙাল করে কাঙাল ইয়ং বাঙাল যত জনা।
সদা কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে কানে লাগায় ফোঁসফোঁসনা!
এরা না হিন্দু- না মোসলমান ধর্মধনের ধার ধারে না ॥
মেমসাহেবদের বর্ণনা :
বিড়ালাক্ষী বিধুমুখী মুখে গন্ধ ছুটে।
আহা তায় রোজ রোজ কত রোজ ফুটে ॥
মহারানী ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশে :
তুমি মা কল্পতরু আমরা সব পোষা গোরু
শিখিনি শিং বাঁকানো কেবল খাব খোল-বিচিলি ঘাস।
যেন রাঙা আমলা তুলে মামলা।
গামলা ভাঙে না।
আমরা ভুসি পেলেই খুশি হব ঘুঁসি খেলে বাঁচব না ॥
বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে আক্রমণ করে লিখেছেন :
অগাধ সাগর বিদ্যাসাগর তরঙ্গ তায় রঙ্গ নানা।
তাতে বিধবাদের কুলতরী অকূলেতে কূল পেল না ॥
ÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑÑ
সে যে অকুল সাগর দারুণ ডাগর কালাপানি বড় লোনা
যখন সাগরে ঢেউ উঠেছিল তখনি গিয়েছে জানা ॥
তপসে মাছ নিয়ে তাঁর রঙ্গরস :
কষিত কনক কান্তি, কমনীয় কায়।
গালভরা গোঁফদাড়ি, তপস্বীয় প্রায় ॥
মানুষের দৃশ্য নও, বাস কর নীরে।
মোহন মণির প্রভা, ননীর শরীরে ॥
ঈশ্বরচন্দ্রগুপ্তের একনিষ্ঠ শিষ্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধায়
প্রকৃতই বলেছেন :
ঈশ্বর গুপ্তের কাব্য চালের কাঁটায়, রান্নাঘরের ধুঁয়ায়, নাটুরে মাঝির ধ্বজির ঠেলায়, নীলের দাদনে, হোটেলের খানায়, পাঁঠার অস্থিস্থত মজ্জায়। তিনি আনারসে মধুররস ছাড়া কাব্যরস পান, তপসে মাছের মৎস্যভাব ছাড়া তপস্বীভাব দেখেন, পাঁঠার বোটকাগন্ধ ছাড়া একটু দধীচির গায়ের গন্ধ পান। ---
--- ঈশ্বরচন্দ্র সেই রসে রসিক, সেই সৌন্দর্যের কবি। যাহা আছে, ঈশ্বরচন্দ্র তাহার কবি। তিনি এই বাংলা সমাজের কবি। এই সমাজ, এই শহর, এই দেশ বড় কাব্যময়, অন্যে তাহাতে বড় রস পান না। তোমরা পৌষপার্বণে পিঠাপুলি খাইয়া অজীর্ণে দুঃখ পাও, তিনি তাহার কাব্যরসটুকু সংগ্রহ করেন। অন্যে নববর্ষে মাংস চিবাইয়া, মদ গিলিয়া, গাঁদাফুল সাজাইয়া কষ্ট পায়, ঈশ্বরচন্দ্র মক্ষিকাবৎ তাহার সুরা পান করিয়া নিজে উপভোগ করেন, অন্যকেও উপহার দেন। দুর্ভিক্ষের দিন Ñ তোমার মাতা বা শিশুর চক্ষে অশ্রুবিন্দুশ্রেণি সাজাইয়া মুক্তাহারের সঙ্গে তাহার উপমা দাও, তিনি চালের দরটি কষিয়া দেখিয়া তাহার ভিতর একটি রস পান। [ঈশ্বরগুপ্তের কবিত্ব]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।