শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
ড. আশরাফ পিন্টু
বন্দে আলী মিয়া একাধারে কবি, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, প্রবন্ধকার, চিত্রশিল্পী ও শিশুসাহিত্যিক। সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তিনি সরব বিচরণ করেছেন। সব মিলিয়ে তার দেড় শতাধিক গ্রন্থ রয়েছে। তবে তার বড় পরিচয় তিনি কবি; শুধু কবি নন, তিনি তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের একজন অন্যতম জনপ্রিয় কবিÑ তার গ্রন্থের পুনঃপুনঃ মুদ্রণ একথাই প্রমাণ করে। এখনও তার কবিতা ও শিশুাহিত্য সাধারণ পাঠকের কাছে জনপ্রিয়।
বন্দে আলী মিয়া একান্তভাবেই পল্লীপকৃতি ও গ্রামীণজীবনবোধ চিত্রায়নের কবি। তার কিছু পূর্বে আমরা জসীম উদদীনের কবিতায় পল্লীপ্রকৃতি ও গ্রামীণজীবন দৃশ্যায়নের সুবিস্তৃত ও সুপরিসরিত পরিচয় পাই। মূলত তিনি জসীম উদদীনের পল্লীপ্রৃতিকে আরো সম্প্রসারিত করেছেন। তবে জসীম উদদীনের কবিতার সঙ্গে তার কবিতার পার্থক্য এইযে, জসীম উদদীন পল্লীজীবনের সুখ-দুখ তথা পল্লীর জীবনবোধ যতটা গভরি ও নিবিড় ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বন্দে আলী মিয়া ততটাই পল্লীপ্রকৃতি ও জীবনযাত্রার চিত্রপট অঙ্কনে গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমনÑ
দুপুরের রোদে খাঁ খাঁ করে চরÑদূর গ্রামে মাখা কালি
উত্তর বায়ে শিশু-মরু হতে উড়ে যায় শুধু বালি।
অশথের তলে জলিধান লাগি গরীবেরা বেঁধেছে কুঁড়ে
কাঁচা যব-শীষ আলোর ডাকেতে অঅসিয়াছে মাটি ফুঁড়ে।
(ময়নামতীর চর)
এমন দৃশ্য বা চিত্রপট তার প্রায় প্রতিটি কাব্যের অধিকাংশ কবিতায় পাওয়া যায়। মূলত তিনি গ্রামীণ মানুষের জীবনযন্ত্রণার প্রকাশের চেয়ে গ্রামীণজীবন ও পল্লীপ্রকৃতির চিত্রপট অঙ্কনে বেশি আগ্রহী ছিলেন। বন্দে আলী মিয়ার প্রথম ক্যাগ্রন্থ ‘ময়নামতীর চর’ পড়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘তোমার ‘ময়নামতীর চর’ কাব্যখানিতে পদ্মাচরের দৃশ্য এবং জীবনযাত্রার প্রতক্ষ ছবি দেখা গেল।’ আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কমলীলতা’-তেও এমন চিত্রকল্প পাওয়া যায়Ñ
আঁকিয়া বাঁকিয়া চলে সুমুখেতে কলমডগাÑ
গেছে তার পরে পোঁতা ছিল হোথা জিগের লগা;
জলবোড়া সাপ কিলবিল করে পাতার আড়ে
জিব বের করে মিটমিট চায় বিলের ধারে।
পুরো কবিতাটিতে এমন চিত্রপট পাওয়া যায় যদিও সেখানে অন্তঃদৃশ্য উম্মোচনের চেয়ে বহির্দৃশ্যায়নেরই প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। তবে চন্দ মাধুর্য ও অন্যান্য গণাবলীতে কবিতাটি উৎকৃষ্ট। এ কবিতাটি সম্পর্কে জনৈক নিবন্ধকার বলেছেন, ‘‘কমলীলতা কবিতা বাংলাসাহিত্যের এক অপূর্ব সম্পদ। ইংরেজ কবি ওয়ার্ড ওয়র্থে ‘দি ডেফোডিলস’ কবিতার মতো বাংলাসাহিত্যে অনন্য। কমলীলতার মাধ্যমে কবি পল্লীবাংলার মর্মবাণীকে ব্যক্ত করেছেন। এক শাশ্বত চিরন্তন বিল ভাষার ফল্গু ধারায় ভেসে এসে অঅমাদের মনকে আলোড়িত করে।’’
কবি বন্দে আলী মিয়া পল্লীপ্রকৃতি অঙ্কনে যে কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন তা অনন্য। পল্লীর চিত্রায়নের পাশাপাশি লোকজীবনের সুখ-দুঃখ তথা প্রাত্যিহিক জীবনযাত্রার বর্ণনায় অনেক সময় তা হৃদয়স্পর্শী ও নান্দনিক হয়ে উঠেছেÑ
মলনের শেষে খামারের পরে চৈত্রালী পড়ে থাকে
সাপটিয়া সব ছালাতে ভরিয়া সাজাইয়া তা রাখে।
কৃষকের যত সাধ আর আশা ইহারে জড়ায়ে রয়
শীত আর রোদ ইহার লাগি সে করে নাই কভু ভয়।
দূর পথে যেতে দেখি চেয়ে চেয়ে চৈত্রের মাঠে হায়
সন্তানহারা জননীর মতো কাঁদিতেছে বেদনায়।
(চৈত্রালী)
‘‘গাঁয়ের ছবি’’ শিরনামের কবিতাটিতেও ফুটে উঠেছে দারিদ্র-পীড়িত গ্রামবাংলার কর্মময় জীবনের চমৎকার ছবিÑ
মাঠের কিনারে কাজীর পাড়ায় মোরগ দিতেছে ডাক
রাত নাই সে কুড়ানী মেয়ে কয়োড় করিছে ফাঁক।
পাঁতিহাঁসগুলো ওপাশের ঘরে প্যাঁক-প্যাঁক শুরু করে
ঘুম ভেঙে উঠি বাহিরেতে চায় রবে নাকো আর ঘরে।
কুড়ানী তাহার ছেঁড়া-কাঁথা গায়ে কাঁপিতে কাঁপিতে উঠি
পোষের বিহানে কনকন জাড় মাঠেতে চলিল ছুটি।
বন্দে আলী মিয়া লৌকিকজীবনের প্রেম-ভালোবাসা তথা রোমান্টিকতার চেয়ে লৌকিকজীবন ও পল্লীপ্রকৃতি চিত্রায়নে বেশি আগ্রহী ছিলেন। তিনি কল্পনা, রোমান্টিকতার চেয়ে বাস্তবতাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। তাই তার প্রেমের কবিতায়ও প্রকৃতির নিটোল ছবিফুটে উঠেছেÑ
বকুল বনে দেখেছিলাম ভোরের অরুণ লেখা
দেখেছিলাম পদ্মবনে তোমার হাসির রেখা।
চৈতিরাতে শুনেছিলাম ঝরাপাতার গান
ফুল ফুটানো নিশীথিনীর নীরব অভিমান।
(মনময়ূরী)
বন্দে আলী মিয়া তার কবিতাতে গ্রামীণজীবন ও পল্লীপ্রকৃতির চিত্র অঙ্কনে যেন স্বস্তির পরশ খুঁজে পেয়েছেন। তার বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা কিংবা স্তবকে এ চিত্রপট লক্ষ্যণীয়। কবির ‘‘ময়নামতীর চর’’ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে কবি ও সমালোচক আলাউদ্দিন আল আজাদ বলেছেন, ‘‘এই চিত্রধর্মিতা সর্বত্র আমরা দেখতে পাই এবং এগুলোতে সংকীর্ণ চিত্ততা, সাম্প্রদায়িক অনুভূতি কিংবা উন্নাসিকতা একবারেই অনুপস্থিত। বরং রয়েছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি গভীর মমতা ও মানবতাবোধ।’’
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।