Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

১০ টাকার চালে ৫৪ হাজার টন আত্মসাৎ

সিপিডি’র অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

| প্রকাশের সময় : ৮ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : দেশের হতদরিদ্রদের জন্য সরকারের বিশেষ খাদ্য সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে ওজনে ব্যাপক কারচুপির প্রমাণ পেয়েছে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি। তাদের অনুসন্ধান বলছে, তিন মাসে ৯০ কেজি চাল পাওয়ার কথা থাকলেও সুবিধাভোগীরা পেয়েছেন গড়ে ৭৯ কেজি। অর্থাৎ একেকজনের কাছ থেকেই মেরে দেয়া হয়েছে ১১ কেজি করে। এই হিসাবে এই কর্মসূচিতে আত্মসাৎ হয়েছে ৫৪ হাজার টনেরও বেশি। পরিবেশকরাই এই চাল মেরে দিয়েছেন। গতকাল রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে চলতি অর্থবছর নিয়ে এক পর্যালোচনায় এ কথা জানান সংস্থাটির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি আরো বলেন, আমরা গবেষণা করে দেখেছি হতদরিদ্র পরিবারগুলো তিন মাসে ৯০ কেজি চাল পাওয়ার কথা থাকলেও তারা পেয়েছে গড়ে ১১ কেজি কম। তারপর এ চাল কারা পাবে তা নিয়েও জটিলতা দেখা দিয়েছে কারণ আমদের দেশে হতদরিদ্রের সঠিক সংজ্ঞা নেই। সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন, নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক  ড. ফাহমিদা খাতুনও এ সময়  উপস্থিত ছিলেন।
উপকারভোগী ৪৯ লাখ পরিবার ঃ হতদরিদ্র মানুষদের জন্য বিশেষ খাদ্য সহায়তা হিসেবে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় কুড়িগ্রামের চিলমারীতে গত ৭ সেপ্টেম্বর ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধন হয়। এই কর্মসূচি উদ্বোধনের দিন জানানো হয়, প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে তিন মাস এই চাল দেয়া হবে। চিলমারীতে চালু হওয়া এই কর্মসূচি এরপর সারাদেশে চালু হয়।
সিপিডি জানায়, সরকার মোট ৫০ লাখ পরিবারকে সহায়তা দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে এই প্রকল্প চালু করে। তবে প্রথম ধাপে সহায়তা পেয়েছে ৪৯ লাখ ১০ হাজার পরিবার। এই কর্মসূচির আওতায় সরকার ৯ হাজার ৮৭৮ জন পরিবেশকের মাধ্যমে মোট ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৬৯৫ টন চাল বণ্টন করে। সিপিডির গবেষণা অনুযায়ী একেকজনের কাছ থেকে ১১ কেজি করে চাল আত্মসাৎ করা হলে মোট ৫৪ হাজার ১০ টন চাল মেরে দেয়া হয়েছে।   
 শুরু থেকেই অনিয়ম ঃ কর্মসূচি চালুর পর পরই হতদরিদ্রদের বাদ দিয়ে সম্পদশালীদেরকে তালিকাভুক্ত করা, চাল বিতরণ দেখিয়ে আত্মসাৎ এমনকি ওজনে কম দেয়ার অভিযোগ উঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে অনিয়মের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দেয়ার পরও অনিয়ম থামেনি। সিপিডি বলছে, অনিয়মের অভিযোগে সরকার ৪.৫ শতাংশ উপকারভোগীর নাম বাদ দেয়ার পাশাপাশি ১.৩ শতাংশ পরিবেশকের লাইসেন্সও বাতিল করে। এরই মধ্যে তিন মাসের কর্মসূচি শেষ হয়েছে। চলতি বছর এই কর্মসূচি চালুর আগেই গতবারের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে অনিয়মের বিরুদ্ধে আগেই ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। সেই সঙ্গে সিপিডি হতদরিদ্রদের পাশাপাশি পোশাক শ্রমিকদের জন্যও একই কর্মসূচি চালুর পরামর্শ দেয়। দেবপ্রিয় বলেন, আমি মনে করি তারা এ চাল পাবার দাবিদার। তাহলে পোশাক শ্রমিক আন্দোলন কিছুটা স্থিমিত হবে।
নরসিংদীর অভিজ্ঞতা ঃ অনুষ্ঠানে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল বিতরণে নরসিংদীর অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায় প্রতি উপকারভোগী ৯০ কেজির বদলে চাল পেয়েছেন ৮২ কেজি করে। বাকি চাল আত্মসাৎ করেছেন পরিবেশকরা। এই পরিবেশন নির্বাচনে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। পরিবেশকরাই নির্ধারণ করেছেন কাদেরকে চাল দেয়া হবে। এতে দেখা যায়, একজন পরিবেশকের অনেক বড় এলাকা দেয়ায় চাল সংগ্রহে তার খরচ বেশি হয়েছে। আবার চাল মাপার ক্ষেত্রে নির্ধরিত যন্ত্রের বদলে বালতির হিসাবে চাল দেয়ার জন্যই ওজনে কম পেয়েছেন উপকারভোগীরা। আর চাল বিতরণের ক্ষেত্রে পরিবেশকদের যে টাকা দেয়া হয়েছে, সেটাকেও অপর্যাপ্ত বলছে সিপিডি। নরসিংদীতে একেকজন পরিবেশক পেয়েছেন ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা করে।   
স্বচ্ছতা নিশ্চিতে পরামর্শ ঃ সিপিডি বলছে, হতদরিদ্রদের জন্য এই বিশেষ খাদ্য সহায়তা চালু হলেও হতদরিদ্র কারা-এই সংজ্ঞাই নির্ধারণ করা হয়নি। এই সুযোগেই ঘটেছে ব্যাপক দুর্নীতি। সেই সঙ্গে কোন কোন এলাকায় এই কর্মসূচি চালু হওয়া দরকার-এ বিষয়েও তথ্যের ঘাটতি ছিল। এই আলোকে আগামীকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে স্বচ্ছতা আনতে প্রথমেই হতদরিদ্রদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা দরকার। এরপর দারিদ্র্যের মানচিত্র অনুযায়ী এলাকা নির্ধারণ করে সেসব এলাকায় এই কর্মসূচি চালু করতে বলেছে তারা। পরিবেশক নিয়োগের ক্ষেত্রে আরও যাচাইবাছাই করার পাশাপাশি তাদের ওপর নরজদারির তাগিদও দিয়েছে সংস্থাটি।
সিপিডি বলেছে, বিগত অর্থ-বছরে আর্থিক খাতে সবচেয়ে সমস্যাগ্রস্ত ছিল ব্যাংকিং খাত। এ খাতে বিপুল পরিমাণে অলস তারল্য জমা হওয়ার পাশাপাশি বেড়েছে কুঋণ, হয়েছে বড় বড় কেলেঙ্কারি। ঘটেছে রিজার্ভ চুরির মতো ঘটনা। এ অবস্থায় আগামী দিনও ব্যাংকিং খাতের জন্য চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।
সিপিডি  বলেছে, বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়।  চলতি অর্থ-বছরও ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব ঘাটতি থাকবে। এর আগে ২০০৮ সালে রাজস্ব আদায়ে সর্বোচ্চ ২৬ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এ বছর এ হারে প্রবৃদ্ধি হলেও বড় অংকের রাজস্ব ঘাটতি থেকে যাবে।
এ সময় সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থ-বছরে ৪০ হাজার  কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি হতে পারে। গত অর্থ-বছর সিপিডি প্রায় ৩৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিল। বছর শেষে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছিল ৩৭ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। সুতরাং এটা প্রমাণিত সিপিডি সামগ্রিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে মত দিয়ে থাকে। তিনি বলেন, গত অর্থবছর রেমিট্যান্স, রফতানি আয় ও কৃষি ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল পর্যায়ে ছিল, যা বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থা। বর্তমান প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে বেশকিছু সংস্কার করতে হবে।
প্রতিবেদনে সিপিডি চলতি অর্থ-বছরের (২০১৫-১৬) কিছু সুপারিশও তুলে ধরে। এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে দেবপ্রিয় চারটি সুপারিশ করেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ব্যাংকিং খাত সংস্কারে কমিশন গঠন, সরকারি বিনিয়োগের গুণগত মান বাড়ানো, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার এবং আগের বছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাকে মানদন্ড ধরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রায় পরিবর্তন আনা।
এ সময় বলা হয়, গত কয়েক বছরের তুলনায় বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমবাজার এখন অনেকটা ভালো। ফলে বিদেশে কর্মসংস্থানও বেড়েছে, কিন্তু সে অনুপাতে বাড়েনি রেমিট্যান্স। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অপব্যবহারের কারণে বেড়েছে হুন্ডি ব্যবসা এবং রেমিট্যান্স কমেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ১০ টাকা

১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ