শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
শাহরিয়ার সোহেল
পৃথিবীর সর্বত্রই রয়েছে আহাজারি, এক বিষণ ক্রন্দনের সুর। সে সুর অন্য কোথাও নিয়ে যায় আমাদের। আমরা অন্যভাবে নিজেদের ভাবতে পারি। সে সুর মনের গহীনে বাজে মৃদুলয়ে, কখনো উচ্চকিত, কখনো ক্ষোভ, ঘৃণা, ভালোবাসা, সংগ্রামের সাথে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নারীবাদী শক্তিশালী কণ্ঠস্বরের মতো জাপান, ভারত ও চীনেও রয়েছে নারীবাদী শক্তিশালী কণ্ঠস্বর। তাদের চেতনা অন্যদের চেয়ে ভিন্ন নয়। পৃথিবীর যে কোন জায়গার অনুভূতিই এক, প্রকাশ ভঙ্গি ভিন্ন হতে পারে।
য়োসানো আকিকোর জন্ম ১৮৭৮, মৃত্যু ১৯৪২। স্বশিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আকিকো জাপানি কবিতায় নতুন ধারার প্রবর্তন করেন। বিংশ শতাব্দীতে তার বিপুল প্রভাব পড়ে জাপানি কবিদের ওপর। ১৯০৪-১৯০৯ সময়পর্বকে বলা হতো জাপানি কবিতায় আকিকো পর্ব। নারী শিক্ষার একজন প্রধান প্রবক্তা, আকিকোর রচনাবলির সংখ্যা চৌদ্দ খ-। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ট্যাংলেড হেয়ার আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত। এতে তিনি ট্যাংকা নামক এক ধরনের জাপানি কবিতা রচনায় উৎকর্ষের পরাকাষ্ঠা দেখান।
প্রসব বেদনা অতি কষ্টের আবার অনেক মধুর। এ শান্তি অথবা যন্ত্রণা শুধু নারীই পেতে পারে। কুমারী মেয়েরা বা পুরুষেরা কিছু সান্ত¡নার বাণী দিতে পারে; কিন্তু বাস্তব অতি সত্য, সেখানে ভালো বা মন্দ নেই। যার যন্ত্রণা সেই যত বোঝে; আর কেউ তেমন বোঝে না। য়োসানো আকিকো ‘প্রসব যন্ত্রণা’ কবিতায় তেমনটি বলেছেন।
আমি একা, সম্পূর্ণ একা
ঠোঁট কামড়ে, শরীর শক্ত করে
এক নিদারুণ অভিজ্ঞতার জন্য অপেক্ষমান
সত্য তো একটাই, আমি এক শিশুর জন্ম দেবি
এই সত্য আমার ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসবে
এর কোনো ভালো-মন্দ নেই, এ এক নিরেট বাস্তব
গর্ভযন্ত্রণার প্রথম ধাক্কাতেই
সূর্য ফ্যাকাসে হয়ে গেলে
সারা পৃথিবী স্তব্ধতায় ভরা
আর আমি একা, অসম্ভব একা
পাঞ্জাবি ভাষার প্রধান কবিদের একজন অমৃতা প্রীতমের জন্ম ১৯১৯ সালে। সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পাওয়া প্রথম ভারতীয় নারী কবি। কবিতা ছাড়াও গল্প, উপন্যাস লিখে থাকেন। নাগমণি নামে একটি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক। অসংখ্য গ্রন্থের রচয়িতা।
হাজার বছর ধরে পুরুষেরা নারীদের পুতুল বানিয়ে রেখেছে। স্ত্রী সেও পুতুল একখানা। পুরুষের ইচ্ছা হলেই তার চাহিদা মেটাতে হয়। কিন্তু নারীর ইচ্ছা থাকে একান্ত গোপন। পুরুষ হাজার অপরাধ করলেও নারী কিছুই বলতে পারে না। কারণ তার দেয়া ভাত তাকে স্তব্ধ করে দেয়, তার কণ্ঠ রোধ করে দেয়। স্বামী-স্ত্রী এক ছাদের নিচে থাকে, তবু তারা থাকে একে অপরের থেকে বহুদূরে। এমন নিরেট সত্য অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন অমৃতা প্রীতম তার ‘ভাতার’ কবিতাতে।
ভাতার আমার
আমি তো তোমার খেলার জন্য তৈরি
মাংসের পুতুল একখানা
আমি তোমার পানের জন্য
এক পেয়ালা তরুণ রক্ত
তোমার সামনে দাঁড়ানো আমি
আমাকে তোমার দু’হাতে বাঁধো
তোমার শরীরের আগুনে ছুড়ে ফেলো
চুম্বন, মর্দন
যা খুশি করো
ভাতার আমার শুধু
ভালোবাসা চেয়ো না
চীনের নতুন কবিদের মধ্যে অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর ঝ্যাং ঝেন। সাংহাই-এর মেয়ে ঝ্যাং সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য সুউডেন, জার্মানি এবং যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেছেন। দেশের সঙ্গেও যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। মাঝে বেশ ক’বছর চীনে একটি আধুনিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনও করেছেন। তার কবিতায় বিশ্বজনীনতা, নগরমনস্কতা ও নারীর নিঃসঙ্গতার অনুষঙ্গ লক্ষ করা যায়।
এমন অনেক সময় থাকে, যখন নারীদের ইচ্ছে করে না পুরুষের কাছে যেতে। কিন্তু পুরুষের ইচ্ছে হলেই নারীকে উপস্থিত হতে হয় তার কাছে। এ যেন নির্মম ভাগ্য দেবতার পরিহাস। অনিচ্ছায় মিলন, পীড়নের সামিল। পুরুষ পাখি তা বুঝেও বোঝে না। ঝ্যাং ঝেন ‘একটি আকাক্সক্ষা’ কবিতায় এমন সত্যের অবত্রণা করেছেন।
কিন্তু তার এই রঙের বাহার আমার জন্য
কেবলই পীড়নের কথা বলে
ঘাড়ে চুমু দিয়ে শুরু করে সে
তারপর সারা শরীরে ঢেলে দেয় জ্বলন্ত মদের ধারা
তার চুল মধ্যাহ্নের সূর্যালোকের মতো খাড়া
আমি মিনতি করি, সে তবু পাহাড় বেয়ে
উঠতে থাকে যেখানে আমার আত্মার বসবাস
তারপর ভেসে চলে যায় দূরে
শুধু শীর্ণ শরবনে পড়ে থাকে
আমাদের ব্যবহৃত দু’খানা দাঁড়
জাপান, ভারত ও চীনের নারীবাদী কবিরা শক্তিশালী কণ্ঠে গেয়েছেন মানবতার জয়গান। নারীদের প্রতি ধর্ষণ, অত্যাচার, বৈষম্য প্রভৃতির বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার। নারীদের জেগে ওঠার আহ্বান রয়েছে তাদের কবিতায়। যে সব পুরুষদের জন্য নারীরা অবহেলিত, তাদের বিরুদ্ধে এ সকল কবিদের রয়েছে দারুণ ঘৃণা-ক্ষোভ। নারীরা নিষ্পেষিত, নির্যাতিত। এ অবস্থা থেকে তাদের উত্তরণ দরকার। শুধু বসে বসে অশ্রু ফেলা নয়। অশ্রুই যেন হয়ে ওঠে শক্তিশালী বারুদ আর অন্যায়কে প্রতিরোধ করতে পারে যথাযথভাবে। এটাই জাপান, ভারত ও চীনের নারীবাদী কবিতাগুলোর মূল সুর। মূল ধ্বনি, মূল সুর একাকার হয়ে মিশেছে মনের সত্য সাগরে।
তথ্যসূত্র :
*নির্জন নিঃশ্বাস-অনুবাদ ও গ্রন্থনা-আলম খোরশেদ
*অন্য দেশের কবিতা- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
*কিউবিজম ও অনুষঙ্গ- ম. রফিকুল আলম
*সমকালীন শিল্প ও শিল্পী- নজরুল ইসলাম
*প্রকৃত শিল্পের স্বরূপ সন্ধান -ড. আব্দুস সাত্তার
*হোরেস-এর কাব্যতত্ত্বÑসুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়
*হোরেস-এর আর্স পোয়েটিকা (কাব্যকলাতত্ত্ব)-
সাধন কুমার ভট্টাচার্য
*সমালোচনার কথাÑশ্রী অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
*সাহিত্য-সুরেশ চন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত
*সাহিত্য সন্দর্শনÑশ্রীশ চন্দ্র দাশ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।